ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর-এর সাবেক উপাচার্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের গ্রেড-১ প্রফেসর। তিনি জানিপপ- জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান। ড. কলিমউল্লাহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষণে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০০৭ সালে অতীশ দীপঙ্কর স্বর্ণপদক এবং ২০১১ সালে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের লেজিসলেটিভ ফেলোশিপ অর্জন করেন। তিনি আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষক হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মিসর, মোজাম্বিক, জাম্বিয়া, নাইজেরিয়া, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, পাকিস্তান, ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব তিমুর লেস্টি ও গণচীনের হংকংসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দায়িত্ব পালন করেন। ২৮ অক্টোবর ঘিরে রাজনীতিতে তৈরি হওয়া অস্থিরতাসহ আগামী নির্বাচনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা।
কালবেলা : ২৮ অক্টোবর ঘিরে এক ধরনের উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। বিএনপিসহ কয়েকটি বিরোধীদল এদিন রাজধানীতে সমাবেশের ডাক দিয়েছে। মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছে আওয়ামী লীগও। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ : বিএনপি দীর্ঘ প্রস্তুতি নিয়ে দিনক্ষণ বেছে ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ ডেকেছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এদিনের আলাদা তাৎপর্যও রয়েছে। এই বিশেষ দিবসে বিরোধীধারার রাজনৈতিক দলগুলো যুগপদের আন্দোলনের বিষয়টি সামনে রেখে এই মহাযজ্ঞের আয়োজন করেছে। ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশকে ঘিরে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর। সেই আলোচনার নিরিখে একধরনের বিতর্কও জমে উঠেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি আনুষ্ঠানিক বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি মার্কিন দূতাবাস থেকেও একটি বার্তা প্রদান করা হয়েছে সেই বৈঠককে ঘিরে।
পরে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক মুশফিক ফজল আনসারী হোয়াইট হাউসের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশে ২৮ অক্টোবরে বিএনপির সমাবেশের বিষয়ে ম্যাথিউ মিলারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। সেখানে ম্যাথিউ মিলার নিশ্চিত করেছেন, বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সজাগ দৃষ্টি রয়েছে। ম্যাথিউ মিলার আরও বলেছেন- বাংলাদেশের শাসনতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করতে এবং নির্বিঘ্নে গণতান্ত্রিক অধিকার অর্থাৎ সভা-সমাবেশ করার অধিকার যাতে রক্ষিত হয় সে বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সজাগ দৃষ্টি রয়েছে।
এখানে স্পষ্ট, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান জানান দেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের শাসকদলকে এক ধরনের সতর্কবার্তা প্রদান করেছে। তারা বুঝিয়ে দিল, কোনো কিছুই তাদের নজরের বাইরে নেই। যুক্তরাষ্ট্রের কারিগরি দক্ষতার মাধ্যমে তারা চাইলে বাংলাদেশের প্রতি ইঞ্চি জমিতে নজরদারি করতে পারে। তারা তাদের স্পাই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে কার্যক্রম দেখতে পারে। কোথায় কী ঘটছে সেটা তাদের নজরের বাইরে নয়। সুতরাং উল্টাপাল্টা কোনো কিছু করে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করে কেউ পার পাবে তেমনটা ভাবার সুযোগ নেই।
কালবেলা : আগামী নির্বাচন নিয়ে সরকার এবং বিরোধীদলকে অনড় অবস্থানে দেখা যাচ্ছে। এ অবস্থায় কোন পথে আগামী নির্বাচন?
ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ : বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক সংস্থা। নির্বাচন আয়োজন করা তাদের দায়িত্ব। নির্বাচন কমিশনার আলমগীর জানিয়েছেন, তারা ২৯ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করতে চান। সেটা করতে না পারলে সাংবিধানিক শূন্যতা দেখা দেবে। আমরা জানি নির্বাচনী প্রচারণার জন্য ন্যূনতম ১৫ দিন প্রয়োজন হয়। এর বাইরেও সময় বৃদ্ধি করা যেতে পারে, তবে এর কম নয়। যেহেতু জানুয়ারি মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা সেহেতু নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে তপশিল ঘোষণা করা হতে পারে বলে ধরে নেওয়া হয়েছে। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ের আগে হাতে যে সময়টুকু রয়েছে বিরোধীদল এবং শাসক দল তার সর্বোত্তম ব্যবহার করতে চাইবে। এই সময়ের মধ্যে তারা ওভার্ট এবং কোভার্ট মুভগুলো সম্পন্ন করতে চাইবে। অর্থাৎ অনড় অবস্থান অথবা এগিয়ে যাওয়া যে কোনো একটি ফয়সালা, এই সময়ের মধ্যে করতে চাইবে দুই পক্ষ। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় আমাদের শাসক দল এবং বিরোধীদলগুলোর মধ্যে যদি এ সময়ে কোনো অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চলে, যদি মতবিনিময় ও সংলাপ হয় তাহলে হয়তো কোনো সমাধান নিয়ে আসা সম্ভব। তবে এই সমাধানটা এত সহজে হবে কি না সেটা নিয়ে অনেকের মনে সন্দেহ রয়েছে।
ধীর গতিতে হলেও আরও একটি দাবি ক্রমান্বয়ে জোরদার হচ্ছে। সেটি হলো, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড। এই স্বল্পতম সময়ে যদি বিরোধীদলগুলোর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দাবি মেনে নেয় শাসক দল, যদি এই স্বল্প সময়ের জন্য একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়, তবুও শাসকদলের অ্যাডভান্টেজ রয়ে যাবে। সুতরাং সেটাও হবে অসম লড়াই। ফলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করাটা হবে সময়ের দাবি। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হলে একটি লম্বা সময় পরেই নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। আইনগত ভিত্তি কী হবে সেটাও এর মধ্যে নির্ণিত হতে হবে। কারণ বাংলাদেশ রাষ্ট্র সাংবিধানিক শূন্যতার অনুমতি দিতে পারে না। এমনকি কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই সেটা সম্ভব নয়। আর এই কারণেই ১৫ ফেব্রুয়ারির ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনের ফলাফলও পরবর্তীতে সকলেই মেনে নিয়েছিলেন।
কালবেলা : বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সঠিক সময়ে আগামী নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা কতটা?
ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ : বাংলাদেশ একটি মিরাকেলের দেশ। সেই মিরাকেল বিবেচনা করলে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার একটি ক্ষীণ সম্ভাবনা থেকেই যায়। শেষ পর্যন্ত সবাই একটি সিদ্ধান্তে এসে মীমাংসার ভিত্তিতে সবার অংশগ্রহণে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতেই পারে। এ ছাড়া ১৯৯৬ সালের মতো নিয়ম রক্ষার জন্য স্বল্প সময়ের একটি নির্বাচনও করা যেতে পারে, যার উদ্দেশ্য হবে পরবর্তীতে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আয়োজন করা। অথবা একটি লম্বা বিরতির পর নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করে তারপর একটি নির্বাচনের আয়োজন করা যেতে পারে। সবকিছুই নির্ভর করবে আমাদের দেশের রাজনৈতিক শক্তিগুলোর ঐকমত্য এবং আন্তর্জাতিক সকল পক্ষের সন্তুষ্টির ওপর।
কালবেলা : নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কীভাবে তৈরি হবে?
ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ : এখানে সরকারের চেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে শাসক দল, যারা এখন ক্ষমতায় রয়েছেন, তারা যখন ক্ষমতায় থাকবেন না তখনও তারা মেজর অ্যাক্টর হবেন। সুতরাং তারা কতটুকু ছাড় দিতে প্রস্তুত সেটাও বিবেচনায় নিতে হবে। পাশাপাশি যারা বিরোধী অবস্থানে রয়েছেন তারা কতটুকু ছাড় পেলে সন্তুষ্ট সেই জায়গাটাও নির্ণিত হতে হবে। বর্তমান শাসক দল টানা প্রায় ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার কারণে প্রশাসন থেকে শুরু করে রুট লেভেল পর্যন্ত সরকারের অনুগ্রহভোগী একটি শ্রেণি তৈরি হয়েছে। এই শ্রেণিটার পরিধি ব্যাপক এবং তারা সরকারের প্রতি অনুগত। ফলে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসেই অনেক কিছু করে ফেলবেন সেই সুযোগ নেই। কারণ কম্বল বাছলে পুরোটা উজাড় হয়ে যাবে।
আর এ কারণেই ভিন্ন রকমের চিন্তা করতে হবে। যেমন হতে পারে ল্যাটারাল এন্ট্রির ব্যবস্থা করা। হতে পারে কনট্রাক্ট বেসিসে পদায়নের ব্যবস্থা করা। যারা চিহ্নিত ভিন্ন মতাবলম্বী রয়েছেন, এমনকি যারা অবসরে রয়েছেন তাদেরও পদায়নের ব্যবস্থা করা। অর্থাৎ বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর অনুগ্রহভোগী এবং ভিন্ন মতাবলম্বীদের একটি ব্যালেন্স তৈরি করা। এটা যে একেবারে অসম্ভব তা মনে করার কোনো কারণ নেই। এর জন্য দরকার কেবল সদিচ্ছা এবং মতৈক্য।
কালবেলা : প্রশাসনিকসহ অন্যান্য সংস্কারে কত সময় লাগতে পারে বলে মনে করেন?
ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ : ১৫ বছরে যে পাহাড়টি তৈরি হয়েছে সেটা সংস্কার করতে অন্তত পাঁচ বছর সময় তো প্রয়োজন। একটি শক্ত ও মজবুত পাহাড়ে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে অতিক্রম করতে এটুকু সময় তো লাগবেই, যা কি না ভেবেছিলেন মাও সেতুংয়ের বোকা বুড়ো।
কালবেলা : চলতি বছরে যে আন্দোলন হয়েছে তা ছিল শান্তিপূর্ণ। সমাধান না আসলে আগামীতে রাজনীতি অতীত অবস্থায় অর্থাৎ সহিংসতার পথে ফিরে যাবে বলে মনে করছেন কী?
ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ : মহাত্মা গান্ধীকে হঠাৎ ভালোবেসে ফেলায় মাঠের বিরোধীদলকে নানা রকমের সমালোচনার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এটি একটি চমৎকার আধুনিক প্রচলন। অসহিংস আন্দোলনকে নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য বলে মনে করে আন্তর্জাতিক মহল। ফলে বিরোধীদলের আন্দোলনগুলোকে এখনো আমরা অসহিংস রূপে দেখছি। সুতরাং একটি সমাবেশকে কেন্দ্র করে তাদের এতদিনের অর্জনকে সহসা ধূলিসাৎ করতে চাইবেন বলে আমার মনে হয় না। শান্তিপূর্ণভাবে সভা সমাবেশের আয়োজন করা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটি সর্বসম্মত অধিকার। ফলে এর মধ্যে হয়তো তারা সীমাবদ্ধ থাকবেন। তবে এর মধ্যে নানা রকমের চোরা গুপ্তা কাজ হতে পারে। ভিন্ন দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করা কিংবা ঘটনাক্রম ভিন্ন দিকে পরিচালনা করার চেষ্টা হতে পারে। এসব ব্যাপারে সমাবেশের আয়োজকদের সতর্ক থাকতে হবে। শাসক দলকেও এখানে সহযোগিতা করতে হবে।
কালবেলা : এবারের নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করার জন্য পশ্চিমা বিশ্ব সক্রিয়। আগামী নির্বাচনে তার কোনো প্রভাব দেখা যাবে কী?
ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ : বাহ্যিকভাবে মনে হচ্ছে সরকারের অবস্থানে কোনো পরিবর্তন নেই। তবে এই অবস্থানের পরিবর্তন যে ক্রিয়াশীল সেটা দেখা যাচ্ছে। পুলিশের ভূমিকা আগে যেরকম ছিল এখন আর সেরকম নেই। অন্যান্য জায়গায় পুলিশ আগে যে ধরনের আক্রমণাত্মক ভূমিকা পালন করেছিল এখন সেরকম আক্রমণাত্মক অবস্থানে নেই। বিরোধীদলের মিছিল বা সভায় শাসকদলের অঙ্গ-সংগঠন যেভাবে হামলে পড়ছিল এখন আর সেরকমটা ঘটতে দেখা যাচ্ছে না। ফলে সবার আচরণে এক ধরনের পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া আমেরিকার ভিসানীতি ভয়ংকর কার্যকর একটি জিনিস। যাদের জন্য এটা মেটার করে তারা ঠিকই সেটা উপলব্ধি করেন। বাগাড়ম্বর যাই হোক না কেন আচরণে এক ধরনের পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশকে একটি শোকেস হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ একটি পাইলটিং-এর মডেল হিসেবে পরিগণিত হতে চলেছে। এ কারণে নির্বাচনের একটি স্ট্যার্ন্ডাড প্যারামিটার নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। সেই প্যারামিটারটা হলো- ‘আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য ও মানসম্মত একটি নির্বাচন।’ অর্থাৎ একতরফা, গায়ের জোরে ও অন্তর্ভুক্তিহীন, অংশগ্রহণবিহীন নির্বাচন করে ফেলে আর পার পাওয়া যাবে না।
কালবেলা : ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক বিশ্ব চেষ্টা করেছে কিন্তু তার ফল খুব একটা সুখকর হয়নি। এবারও কী একই পরিণতি বরণ করতে যাচ্ছে নির্বাচন?
ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ : সেই সময়কার বিশ্ব রাজনীতির পরিবেশ আর এখনকার পরিবেশ এক নয়। আমেরিকা বিভিন্ন দেশের ওপর তাদের এই স্যাংশন পলিসি প্রয়োগ করেছে এবং তারা সফলও হয়েছে। সুতরাং এটা মার্কিন প্রশাসনের একটি নতুন ট্রেন্ড। ভেনেজুয়েলা এবং কম্বোডিয়ার ওপর যেভাবে মার্কিন স্যাংশন আরোপ করা হয়েছে এবং পরবর্তীতে তা প্রত্যাহারও করা হয়েছে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এমনটা হবে না তা ভাবার কোনো কারণ নেই।
আমেরিকার স্যাংশন পলিসি নিয়ে রিচার্ড নেফিউর লেখা বইয়ে দুটি বার্তা রয়েছে। একটা হলো পেইন অন্যটা রিজলভ। অর্থাৎ যতক্ষণ না পর্যন্ত আমরা আর্তনাদ করে উঠছি ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের ওপর এই যন্ত্রণা তারা চাপাতেই থাকবে। আর তারা যখন কোনো কিছু করার সিদ্ধান্ত নেয় তখন সেখান থেকে তারা এক চুলও নড়ে না।
কালবেলা : জামায়াতে ইসলামী এতদিন আলাদাভাবে কর্মসূচি দিলেও এবার তারা বিএনপির সঙ্গে একই দিনে কর্মসূচি দিয়েছে। জামায়াতে ইসলামী কী এবার বিএনপির আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে?
ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ : জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সবচেয়ে সংগঠিত রাজনৈতিক দল। অনেকে বলেন গত ১৫ বছরে তাদের ভোট ব্যাংক আগের তুলনায় আরও বেড়েছে। রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের আইনগত ভিত্তি নিয়ে আদালতে মামলা চলছে। জামায়াতের বিপক্ষে ব্যারিস্টার তানিয়া আমির মামলা লড়ে যাচ্ছেন। হয়তো আদালত থেকে একটি নির্দেশনাও আসবে। কিন্তু তাই বলে এত বৃহৎ সমর্থক গোষ্ঠীর একটি রাজনৈতিক দলকে রাতারাতি আস্তিনের নিচে নিয়ে যাওয়া যাবে বলে মনে হয় না, তা সহজও নয়। এ ছাড়া কারো নাগরিকত্ব বাতিল করারও সুযোগ নেই। সুতরাং তারা দলের সমর্থক হিসেবে থেকে যাবে। ফলে জামায়াতের এই বিপুল সমর্থক গোষ্ঠী যেদিকে ঝুঁকবেন তাদের পক্ষে ফল আসবে, রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামী অবশ্যই মেটার করে।
শাসকদল হয়তো তাদের জন্য একটি স্পেস তৈরি করে দিয়ে সমর্থন পাওয়ার আশা করছে। আবার প্রধান বিরোধীদল বিএনপিও জামায়াতকে সঙ্গে রাখতে চাইবে। এ কারণেই হয়তো বিএনপি জামায়াতের জন্য যুগপৎ আন্দোলনের একটি স্পেস রেখে দিচ্ছে। জামায়াতের লবিটি অনেক শক্তিশালী এবং বিশ্বজুড়েই তাদের সক্রিয়তা রয়েছে। জামায়াতে ইসলামী হিন্দ রয়েছে, জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান, জামায়াতে ইসলামী আফগানিস্তান রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যেও এই ঘরানার রাজনৈতিক দল রয়েছে- তারা ইখওয়ানুল মুসলিমিন নামে পরিচিত। মিসরে রয়েছে ইখওয়ানুল মুসলিমিনের শাখা, যারা কিনা মুসলিম ব্রাদারহুড নামে পরিচিত। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ব্রাদারহুডের সংগঠনের বিস্তার রয়েছে। এ কারণেই জামায়াতের মতো একটি রাজনৈতিক দলকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।
কালবেলা : সম্প্রতি জাতীয় পার্টির জি এম কাদের বলেছেন, এই সরকারের অধীনে তারা আর কোনো নির্বাচনে যাবেন না। এই বক্তব্যে তিনি কোনো বার্তা দিতে চেয়েছেন কী?
ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ : জাতীয় পার্টি বাংলাদেশ সংসদের বিরোধীদল। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিবেচনায় তারা একটি মধ্যমপন্থি দল। তাদের সহযোগিতা ছাড়া শাসক দল এতদিন ক্ষমতায় থাকতে পারত না। এটাই সত্যি এবং পরিষ্কার। আর এখানে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে আমাদের একটি প্রতিবেশী দেশ। শাসকদলের সঙ্গে জাতীয় পার্টির একটি কো-অর্ডিনেশন রয়েছে, এটা সবার জানা। সামনে আমাদের দেখতে হবে নৌকাটা মাঝ নদীতে আছে কি না অথবা পালে হাওয়া কতটুকু লাগে। জাতীয় পার্টি কোন দিকে যাচ্ছে সেটা হয়তো সামনে আমরা দেখতে পাব।
কালবেলা : বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সরকারের ভূমিকাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ : সরকার বলতে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকেই বোঝায়। শেখ হাসিনার হ্যান্ড হিসেবে যারা রয়েছেন তারা অপেক্ষাকৃত নবীন। এই নবীনরা কেউ হয়তো ইশতেহার প্রণয়নের দায়িত্ব নিয়েছেন অথবা কেউ দাপ্তরিক দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রাক্তন প্রবীণ নেতাদের যে ম্যাচিউরিটি ছিল সেই ম্যাচিউরিটি হয়তো এই নতুনদের মধ্যে নেই। এই অভাবটা রাজনৈতিক অঙ্গনে দেখা যাচ্ছে।
কালবেলা : ১৯৯১, ১৯৯৬ বা অন্যান্য সময় যে রাজনৈতিক সমাধান হয়েছে সেখানে বিদেশিদের বড় ভূমিকা ছিল। কিন্তু ২০১৪ সালে বিদেশিদের ভূমিকা কাজে লাগেনি। এবারে তাদের মাধ্যমে কোনো ফল আসবে কী?
ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ : ১৯৯৬ সালে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেভাবে সমাধান চেয়েছিলেন পরবর্তীতে হয়তো তারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে তেমন গুরুত্বের সঙ্গে আর নেননি। সেবার একটি প্রেক্ষাপটে আমাদের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া পদত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু এরপর আর আমরা তেমন কোনো জায়গায় আর পৌঁছতে পারিনি। শাসকদলের মধ্যে এখন ডু অর ডাই-এর মতো একটি পণ রয়েছে। শাসকদলের শীর্ষ নেত্রীর মধ্যেও সেটা রয়েছে। তিনি মনে করেন তাকে বাদ দিয়ে কোনো মীমাংসা হবে না। আর সেই জায়গাটায় আলোচনা আটকে রয়েছে।
কালবেলা : রাজনৈতিক অচলাবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে আপনার পরামর্শ কী?
ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ : বিএনপির জন্য এটি লাস্ট ডিফ ব্যাটেল হিসেবে ধরা হচ্ছে। যেহেতু তপশিল ঘোষণার আগে তাদের হাতে সময়টা খুবই কম ফলে তারা কোনোভাবেই স্পেস হারাতে চাইছে না। এটা সত্যি, স্পেসটা যত ছোট হয়ে আসছে বিএনপি তত মরিয়া হয়ে উঠছে। পরিস্থিতি সহিংস হয়ে উঠুক সেটা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কোনোভাবেই চাইবে না।
সেদিকে যেতে তারা কোনো পক্ষকেই উৎসাহিত করবে না। কোনো পক্ষকেই তারা আস্কারা দেবে না। আন্তর্জাতিক পক্ষ চাইলে আরও অনেক ধরনের হাতিয়ার ব্যবহার করতে পারে। তারা বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে। হাজার রকমের স্যাংশন আরোপ করতে পারে। আমাদের রিজার্ভ জব্দ করতে পারে। আমাদের আমদানি-রপ্তানির পথ বন্ধ করে দিতে পারে। বঙ্গোপসাগরে তারা নেভাল ব্লকেডও হাজির করতে পারে। তারা চাইলে অনেক কিছুই করতে পারে। সুতরাং আমাদের জন্য বিষয়টাকে হালকাভাবে নেওয়া একদমই ঠিক হবে না। আমেরিকার রিজললের সঙ্গে অন্য কিছুর তুলনা চলে না। তাই আমাদের ভেবে-চিন্তেই পা বাড়ানো উচিত।
শ্রুতিলিখন : মুজাহিদুল ইসলাম
মন্তব্য করুন