ড. মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌
প্রকাশ : ১৯ অক্টোবর ২০২৩, ১২:১৭ পিএম
আপডেট : ১৯ অক্টোবর ২০২৩, ১২:৩০ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
ড. মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌র বিশেষ সাক্ষাৎকার

রাজনীতিকে হেলা-খেলায় পরিণত করা সরকারের দায়িত্বহীনতার পরিচয়

অর্থনীতিবিদ ও লেখক ড. মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌। ছবি : সৌজন্য
অর্থনীতিবিদ ও লেখক ড. মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌। ছবি : সৌজন্য

ড. মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌

অর্থনীতিবিদ ও লেখক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগে ২০০৫ থেকে ২০১১ সাল এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ১৯৭৬ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনা করেছেন। পাশাপাশি ১৯৯৩-১৯৯৭ মেয়াদে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে উপউপাচার্য এবং ২০০৩-২০০৬ মেয়াদে সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়া বিআইডিএস, রেভিনিউ রিফর্মস কমিশন এবং উচ্চশিক্ষাবিষয়ক কৌশলপত্র প্রণয়ন কমিটিতে কাজ করেছেন। তিনি ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর, ১৯৮০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতকোত্তর এবং ১৯৯০ সালে ভারতের জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ষাটের দশকে তিনি ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক; স্বাধীনতার পর ন্যাপের রাজনীতিতে যুক্ত হন। ড. মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌র জন্ম ১৯৪৫ সালে, নোয়াখালীতে। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও বিরোধীদলের আন্দোলন নিয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা

কালবেলা : আপনি ’৬৯-এর গণআন্দোলনে সক্রিয় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৯১, ১৯৯৬-এর আন্দোলন দেখেছেন, ২০০৬ সালের আন্দোলনও দেখেছেন। তখনকার আন্দোলনের সঙ্গে এখনকার আন্দোলনের মৌলিক পার্থক্য এবং সাদৃশ্য কী?

ড. মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌ : পাকিস্তান আমলে বেশ কয়েকটি আন্দোলন দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। সেগুলো থেকে আমি বিপুল অভিজ্ঞতা পেয়েছি। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান— গণআন্দোলন এবং গণঅভ্যুত্থান হিসেবে সেগুলো ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলন হয়েছিল সেটিও ব্যাপক ছিল। সে সময়ের অসহযোগ আন্দোলন বাংলাদেশে আন্দোলনের ইতিহাসে একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত। এখন বাংলাদেশে সেই ধরনের আন্দোলন গড়ে তোলা খুবই কঠিন। হয়তো সেটা সম্ভবও নয়।

’৬৯ সালে ব্যাপক গণজোয়ার ছিল। কাউকে বলে কয়ে মাঠে আনতে হয়নি। মানুষ নিজ উদ্যোগে, শতস্ফূঃর্তভাবে, নিজের দায়িত্ব মনে করে মিটিং মিছিলে যোগ দিয়েছে। বলা যায়, মিটিং মিছিলে যোগ দেওয়াটা তারা নৈতিক হিসেবে মনে করেছিল। সরকারি চাকরিজীবীরা, আইন অনুসারে যাদের আন্দোলনে যোগ দেওয়ার কথা নয়, তারাও একটা পর্যায়ে এসে মিছিল সমাবেশে শামিল হয়েছিল। সরকারের রুদ্রমূর্তি দেখে, পুলিশের গুলি করা দেখে এবং একের পর এক মৃত্যু দেখেও তারা আন্দোলনে শামিল হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

এখনকার সমস্যা হলো, বাংলাদেশের প্রত্যেকটা সামাজিক শ্রেণি নিজেদের স্বার্থ নিয়ে বেশি চিন্তিত। ওই স্বার্থের বাইরে তারা খুব বেশি চিন্তা করে না। এই স্বার্থগুলোকে অতিক্রম করে যে একটি বৃহত্তর সামাজিক, নৈতিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব রয়েছে, সেই দায়িত্ব পালনে সবাইকে খুব উৎসাহী দেখা যায় না। রাজনৈতিক দলগুলো হয়তো বড় ধরনের মিছিল মিটিং করছে, সমাবেশ করছে, তারপরেও দেখা যায় সাধারণ মানুষ এখনও ব্যাপকভাবে মিছিলে বা সমাবেশে নেমে আসছে না। যদি সাধারণ মানুষদের মিছিল সমাবেশে নামানো যেত, তাহলে গণতন্ত্রের জন্য যে আন্দোলন হচ্ছে তা ইতোমধ্যেই সফল হয়ে যেত।

সাম্প্রতিককালে আমরা ‘কোটা সংস্কার’ আন্দোলন দেখেছি। আমরা ‘নিরাপদ সড়ক’ আন্দোলন দেখেছি। এই দুটি আন্দোলনে ব্যাপকভাবে ছাত্ররা অংশগ্রহণ করেছে। ছাত্রদের অংশগ্রহণ তাৎপর্যপূর্ণ ছিল কারণ, সব ধরনের ছাত্র সেখানে শত-স্ফূঃর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছে। তারা এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে, সরকারের পক্ষে লাঠি ও গুলি দিয়ে তাদের আন্দোলন দমন করা সম্ভব ছিল না। যে কারণে সরকারকে ভিন্ন স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করে এক ধরনের আপস ও সমঝোতার পথে যেতে হয়েছে। এখানে আমরা বুঝতে পারি- আমাদের শাসক গোষ্ঠীর যে শক্তি এবং যে মনোভাব তা দিয়ে সাধারণ শিশু বা সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলন অতিক্রম করা সম্ভব, সেখানে সাধারণ মানুষ যদি রাজপথে নেমে আসত, তাহলে অনেক আগেই গণতন্ত্রের আন্দোলন সফল হতো। এতে দেশের ক্ষতিটাও কম হতো।

প্রায় প্রতিদিনই মিছিল মিটিং হচ্ছে। প্রচুর মানুষ সেখানে অংশগ্রহণ করছে। কিন্তু মানুষ জানে না কী সমাধান হবে বা কোনো সমাধান আদৌ হবে কি না। একালের মানুষ খুব সংকীর্ণ দৃষ্টিতে স্বার্থ সচেতন। মানুষ উদার দৃষ্টিতে স্বার্থ-সচেতন নয় বলেই পাকিস্তান আমলে যে আন্দোলনগুলো হয়েছিল সেগুলোর চরিত্রের সঙ্গে এখনকার আন্দোলন মিলানো যাবে না। তখন ছাত্রদের আন্দোলনকেও সাধারণ মানুষ নিজেদের আন্দোলন ভেবে রাজপথে নেমে এসেছে এবং প্রাণও দিয়েছে। আজকের দিনে সেটা আদৌ সম্ভব কি না তা আমি জানি না।

কালবেলা : নেতৃত্বের কোনো সংকট রয়েছে বলে মনে করেন কী?

ড. মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌ : এটা প্রথমত নেতৃত্বের সংকট নয় বরং এটা কালের সংকট। এটা সময়ের সংকট। পাকিস্তান আমলে সবকিছুর ভেতর যে বিষয়টি লুকিয়ে ছিল, তা হলো জাতীয়তাবাদ। বাঙালি জাতিসত্তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, তাকে ন্যায্যতা, দেওয়া সব মানুষ কায়মনোবাক্যে এটা চেয়েছে। জাতীয়তাবাদ এমন একটি শক্তি- যে দেশের ইতিহাসে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হয়েছে তার মধ্যে শুধু যুক্তি নয়, শুধু বুদ্ধি নয় বরং আবেগের একটি বিরাট স্থান ছিল। এখনকার আন্দোলনে এই আবেগটাই মিসিং। এখনকার নেতৃত্ব মানুষের মধ্যে এই আবেগ সৃষ্টি করতে পারেনি।

কালবেলা : স্বাধীনতার আগে ’৭০-এর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গণআন্দোলন হয়েছিল। স্বাধীনতার পরও এই নির্বাচনকেন্দ্রিক আন্দোলন চলছেই। এখান থেকে আমরা বের হতে পারছি না কেন?

ড. মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌ : ১৯৯৬ সালের নির্বাচনকেন্দ্রিক আন্দোলন অথবা এখনকার নির্বাচনকেন্দ্রিক আন্দোলন কোনোটাই পাকিস্তান আমলের সেই আন্দোলনের সঙ্গে তুলনীয় নয়। আমরা যদি অসহযোগ আন্দোলনের দিকে তাকাই- তাহলে দেখব সেখানে সংসদ অধিবেশন বসা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। সেই বিতর্ককে কেন্দ্র করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। আর এর থেকেই জন্ম হয় অসহযোগ আন্দোলনের। ফলস্বরূপ দেশে একটি বিকল্প প্রশাসনও চালু করতে সক্ষম হয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তখন শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগের নির্দেশেই দেশের কর্মকাণ্ড চালিত হতো। জাতির সামনে সেরকম একটি একক নেতৃত্ব ও একক কমান্ড প্রতিষ্ঠা করা সম্ভবত এই মুহূর্তে আর সম্ভব হচ্ছে না। তার কারণ, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, সামাজিক ক্ষেত্রে, শিক্ষাক্ষেত্রে বা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যা কিছু হয়েছে তার ফলে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মানুষ পুরোপুরি বদলে গেছে। আগের সেই মানুষগুলো এখন আর নেই। এখন যে মানুষ রয়েছে তাদের আমরা দোষারোপ করতে পারি না। মানুষের মন, মগজ, মননের উপযোগী ভাষায় যদি কেউ আন্দোলন পরিচালনা করতো তাহলে হয়তো আন্দোলনের রূপটা ভিন্ন হতো। তখন হয়তো দ্রুত সমাধানের দিকে যাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব হতো।

ছাত্রজীবনে আমরা পশ্চিমবঙ্গের আন্দোলন নিয়ে অনেক আলোচনা করতাম। কিন্তু আজ আমাদের অবস্থা হয়েছে ভিন্ন। কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিএম) তখন সেখানে অনেক শক্তিশালী দল। সেখানে ট্রামের ভাড়া যদি এক পয়সা বৃদ্ধি পায় তার জন্য আন্দোলন করে তুলকালাম অবস্থা হয়ে যেত। অথচ আমাদের দেশে জিনিসপত্রের দাম হুহু করে বাড়ছে তাতে জনগণের কোনো মাথাব্যথা নেই। পাশাপাশি দুটি অঞ্চল, দুই জনগোষ্ঠীই বাংলা ভাষাভাষী। আমাদের এখানে দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি বা অন্য যে কোনো নাগরিক সমস্যার বিষয়ে অসন্তোষ তৈরি হয়, কিন্তু এগুলো নিয়ে আমাদের জনগণ বড় কোনো আন্দোলন করে না। আমাদের দেশের জনগণ আন্দোলন করে শুধু ওই সব বিষয়ে যার- জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক তাৎপর্য রয়েছে। এখানেই দুই বাংলার মানুষের মননের পার্থক্য। অর্থনীতির ভাষায় বলতে গেলে পশ্চিম বাংলার মানুষ একেবারে সূক্ষ্ম গতিতে আন্দোলন করে। আর আমাদের এখানে আন্দোলন হয় ব্যাপক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা থেকে।

আমাদের ভাবতে হবে- মানুষের অনেক অভিযোগ রয়েছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ে অভিযোগ রয়েছে, অভিযোগ রয়েছে আইনশৃঙ্খলা নিয়ে। সরকারি চাকরিতে নিয়োগ নিয়ে অভিযোগ রয়েছে। সত্যি বলতে এমন কোনো বিষয় নেই যেটা নিয়ে মানুষের অভিযোগ নেই। তারপরেও মানুষ এগুলোকে খুব বড় সমস্যা মনে করে না। তারা মনে করে রাজনৈতিক পরিবর্তন হলেই এই সমস্যাগুলোর একটা সমাধান হয়ে যাবে।

বাংলাদেশের মানুষ জাতীয় ইস্যুতে আন্দোলনে যুক্ত হয় সত্যি, তবে এই জাতীয় ইস্যুকে জাতীয় রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে বড় ঘাটতি রয়েছে। গত কিছুদিন যা কিছু হয়েছে নিঃসন্দেহে সেটা উৎসাহিত হওয়ার মতো ব্যাপার। কিন্তু আরও অনেক পথ পাড়ি দেওয়ার বাকি। আরও অনেক দূর যেতে হবে।

কালবেলা : বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভিসানীতি প্রণয়ন করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই ভিসানীতির প্রয়োগও শুরু করেছে তারা। এটা আমাদের নির্বাচনী পরিবেশে কোনো পরিবর্তন নিয়ে আসবে বলে মনে করেন কী?

ড. মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌ : আমেরিকানরা এই ধরনের পলিসি অস্ত্র শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নয় আরও অনেক দেশে ব্যবহার করেছে। সে সব দেশে তারা এটার ফল পেয়েছে বলে বাংলাদেশে তারা একই ধরনের পলিসি গ্রহণ করেছে। আমাদের খেয়াল করতে হবে, বাংলাদেশের মানুষ তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য অথবা আরও উন্নত জীবনযাপনের জন্য যে গন্তব্যস্থলকে শ্রেয় মনে করে সেটি হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দেশের অনেক মানুষ এমনকি শিক্ষিত সমাজের অনেকেই বিভিন্ন দেশে চাকরি করে। তারা অস্ট্রেলিয়াতে থাকুক বা নিউজিল্যান্ডে থাকুক তাদের আল্টিমেট স্বপ্ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থিতু হওয়া। এদিক থেকে বাংলাদেশের উচ্চবিত্ত মহলের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি একটি প্রবল আকর্ষণ রয়েছে। কারণ এই দেশটাই গড়ে উঠেছে অভিবাসীদের নিয়ে। ফলে অভিবাসীদের জীবন কীভাবে সুন্দরভাবে চলবে সেই ধরনের আইনকানুন ও সামাজিক প্রথা সেখানে রয়েছে। সেই ধরনের সুযোগ সুবিধাও রয়েছে সেখানে। আর সেই সুযোগ সুবিধা রয়েছে বলেই বেশিরভাগ মানুষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বেছে নেয়।

বাংলাদেশের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আমেরিকা যে ভিসা পলিসি গ্রহণ করেছে তাতে আমাদের দেশের ধনাঢ্য এবং উচ্চমধ্যবিত্ত অনেকেরই স্বার্থ হুমকির মধ্যে পড়েছে। ব্রিটিশ আমলে একটি আইন ছিল ‘পিটুনি করো’ নামে। কোথাও দাঙ্গা-হাঙ্গামা বা গোলযোগ হলে সেখানকার সকল অধিবাসীর ওপর গড়পরতা হারে একটি কর বসিয়ে দেওয়া হতো। ভিসা নিষেধাজ্ঞার পদক্ষেপটা অনেকটা সেরকমই। দেখা যাবে এই নিষেধাজ্ঞায় কেউ কেউ আটকে গেছে, যারা প্রকৃত অর্থে সেভাবে দোষী নয়। উচ্চ জীবনযাত্রার আশায় অনেক স্বপ্ন নিয়ে যারা আমেরিকায় যায়, যদি কোনোভাবে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় তবে সেটা তাদের জন্য অনেক শকিং একটি বিষয়। এটাকে তখন তারা একটি বড় ধরনের মুসিবত হিসেবে গণ্য করে। সেদিক থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভিসানীতি এক ধরনের ইনসেন্টিভ তৈরি করবে।

ভিসানীতির এই পলিসিতে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তারা যদি সেই চাপটি সরকারকে জানাতে পারে বা জানায় তাহলে সরকারকেও হয়তো তার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। আর সেক্ষেত্রে হয়তো তাদের ক্ষমতায় থাকা বা না থাকার বিষয়ে নতুন করে চিন্তা করতে হবে।

কালবেলা : সরকার ইতোমধ্যেই নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছে। নির্বাচন কমিশনও বলেছে, আগামী মাসে তারা হয়তো তাপশিল ঘোষণা করবেন। বিএনপি বা সরকারবিরোধীরা বলছে তারা এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। এই পরিস্থিতিতে আপনি কী বলবেন?

ড. মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌ : যদিও আমাদের সামনে খুব বেশি সময় নেই, তবুও আগামী নির্বাচন ২০১৪ সালের মতো একতরফা হবে কি না সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। রাজনীতির মাঠে একদিন মানে অনেক সময়। এই অল্প সময়ের মধ্যে অনেক কিছুই ঘটে যেতে পারে যেটা এ মুহূর্তে হয়তো আমরা বুঝতে পারছি না। তবে এটুকু নিশ্চিত, সমস্যাটা খুবই জটিল। এই সমস্যার একমাত্র সমাধান হতে পারে দেশপ্রেমিক মন-মানসিকতা। একটা দেশকে অচল অবস্থার মধ্যে আটকে রাখা কোনোভাবেই দেশপ্রেমিক মন-মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ হতে পারে না। সর্বোচ্চ দেশপ্রেম থেকে দেশকে চলতে দেওয়া এবং দেশকে এগিয়ে নেওয়া এমন মানসিকতাই সবার হওয়া উচিত। কিন্তু সেই মানসিকতা বা চিন্তা এখনো আমরা দেখছি না। এখানে এক ধরনের গো ধরার মতো অবস্থা বিরাজমান। আর সেই কারণেই এই অচল অবস্থার সৃষ্টি।

যদি একটি গিভ অ্যান্ড টেকের মন মানসিকতা থাকতো তাহলে হয়তো আমরা কোনো একটি সমাধানের আশা করতে পারতাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়- সমাধান না হলে কী হবে, সেই আশঙ্কা আমাদের ভাবাচ্ছে। সেই আশঙ্কা আমাদের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করছে।

কালবেলা : নির্বাচনকেন্দ্রিক অস্থিরতা আমাদের কোন দিকে নিয়ে যাবে?

ড. মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌ : আন্দোলন হলে মানুষের মৃত্যু ঘটে এটা আমরা অতীতেও দেখেছি। তখনকার দিনে একজন আসাদ শহীদ হলে সমস্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভূমিকম্পের মতো যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতো সেই প্রতিক্রিয়া আজ আর হচ্ছে না। আর এর কারণ হলো অতিরিক্ত দলমনস্কতা। এই অতিরিক্ত দলমনস্কতার ফলে মানুষের মধ্যে এক ধরনের বিভাজন তৈরি হয়ে গেছে। ফলে যে কোনো প্রশ্নের সমাধান খুব দ্রুত আসছে না। বিভিন্ন জায়গায় দুর্ঘটনা ঘটছে, মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এটা কোনো দিকে কীভাবে বৃদ্ধি পাবে বা বৃদ্ধি পাবে কি না সেটা এখন বলা যাবে না। এটা যদি গণঅভ্যুত্থানের দিকে পরিচালিত হয় তবে সেটা খুবই ভালো। কারণ গণঅভ্যুত্থান হলে সমস্যার একটি সমাধান আসবে এবং ক্ষয়ক্ষতিও অনেক কম হবে। আর গণঅভ্যুত্থান না হয়ে এটা যদি ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং আঁকড়ে থাকার ওপর নির্ভর করে তাহলে আমরা খুব সহজে সমস্যা থেকে বের হয়ে আসতে পারব না, চাই নির্বাচন হোক বা না হোক।

কালবেলা : বিএনপির বর্তমান আন্দোলনকে আপনি কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন?

ড. মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌ : আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী এক ধরনের শর্ত দিয়ে দিয়েছে, আন্দোলন হতে হবে শান্তিপূর্ণ। আন্দোলনে সহিংসতা থাকতে পারবে না। কিন্তু আমাদের দেশের ইতিহাস অন্যরকম। আমাদের অভিজ্ঞতাও অন্যরকম। আন্দোলন বা মিছিলকারীদের সঙ্গে পুলিশের বা তৎকালীন সময় ইপিআর, এখন বিজিবি তাদের এক ধরনের সংঘাত হয়। এমনকি মাঝেমধ্যে সরকারি দলের কর্মীরাও সংঘাত সৃষ্টি করে। এ ধরনের ঘটনা যখন ঘটে তখন কিছু ক্যাজুয়ালটি ঘটা অস্বাভাবিক নয়। যদিও সেটা দুঃখজনক।

আমি বলব- যদি রাজনীতিবিদরা মানুষের জীবনকে মূল্যবান মনে করেন তাহলে তাদের সমাধানের কথা ভাবতে হবে। জেদ নিয়ে কোনো সমস্যার সমাধান হবে না। আর সমাধান না ঘটলে যে পরিস্থিতির সামনে আমরা পড়ব সেটা কারো জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না।

কালবেলা : দুপক্ষকেই অনড় অবস্থানে দেখা যাচ্ছে। এখানে সমাধান কীভাবে আসতে পারে বলে মনে করেন?

ড. মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌ : সমাধানের দৃষ্টান্ত আমাদের সামনেই রয়েছে। ১৯৯৫ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আন্দোলন হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে। সেই আন্দোলনে যুগপৎভাবে অংশগ্রহণ করেছিল জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয় পার্টি। সে সময় প্রচুর সহিংসতাও হয়েছে। প্রচুর মানুষের মৃত্যু হয়েছে। মানুষ আহত হয়েছে, ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে এরকম একটি সংঘাতময় পরিস্থিতি চলেছে। সে সময় ১৭৩ দিন হরতাল হয়েছিল। তখন শেখ হাসিনা বলেছিলেন- আজীবনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা থাকা উচিত। এই চাপের মুখে বিএনপি তখন বাধ্য হয়েছিল একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন করতে। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এবং অন্যান্য আন্দোলনরত দলগুলো অংশগ্রহণ করেনি। কিন্তু সেই নির্বাচনটি করার উদ্দেশ্য ছিল সংবিধান সংশোধন করা।

এর আগে সংসদে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল কিন্তু সংবিধান সংশোধন করার মতো দুই তৃতীয়াংশ আসন তাদের ছিল না। যদিও একতরফা নির্বাচন, তা সত্ত্বেও সেই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংসদে এসে তারা সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করে। আর এর ফলশ্রুতিতে ’৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয় লাভ করে এবং বিএনপি বৃহৎ বিরোধীদল হিসেবে সংসদে আসে।

সে সময় বিএনপির আসন সংখ্যা ছিল ১১৬টি। সে সময় আওয়ামী লীগও যে মেজরিটি পেয়েছিল সেটা দিয়ে সরকার গঠন করা সম্ভব ছিল না। তারা জাতীয় পার্টির সঙ্গে কোয়ালিশনের ভিত্তিতে সরকার গঠন করে। এই ধরনের ঘটনায় মেনে নেওয়ার একটি ব্যাপার থাকে। সে সময় খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিয়েছিলেন বলেই আরও বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি থেকে জাতি রক্ষা পেয়েছিল। মনোভাবটা সেরকম কিছু হতে হবে।

কালবেলা : সব সময় সমাধানের ক্ষেত্রে আমরা পেছনের আলোচনায় রাষ্ট্রদূতদের এক ধরনের ভূমিকা দেখেছি। ২০১৮ সালেও এরকম দেখেছি। এবারও বিদেশিরা সেরকম কোনো ভূমিকা রাখবে বলে কি আপনার মনে হয়?

ড. মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌ : দেশের সমস্যা সমাধানের জন্য বিদেশিদের ওপর নির্ভরশীল হওয়া এবং বিদেশিদের দিয়ে চাপ সৃষ্টি করে পরিস্থিতির পরিবর্তন করা এগুলো সৃষ্টি হয়েছে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় থেকে। সে সময় বিএনপির এবং আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন। অনেকেই এটাকে শুভ উদ্যোগ বলে গ্রহণ করে না।

আমার ঘরের সমস্যা আমি সমাধান করব। আমার সমস্যা সমাধানের জন্য অন্যদের দুয়ারে ধরনা দিতে হবে এমনটি একটা জাতি হিসেবে এটা খুবই লজ্জার একটি ব্যাপার। তা সত্ত্বেও আমরা দেখছি বিদেশিরা এখনও সক্রিয়। এক একটি দেশের রাষ্ট্রদূত তার দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের দেশগুলো সহ পৃথিবীর ধনী দেশগুলোর সারা পৃথিবীতে এক ধরনের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ থাকে। যে কোনো কারণেই হোক সম্ভবত বাংলাদেশ সে ধরনেরই একটি জিও পলিটিক্যাল গুরুত্ব হিসেবে দেখা দিয়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এখানে কে বা কারা সরকার গঠন করবে সেটা নিয়ে তাদের মধ্যে এক ধরনের চিন্তা তৈরি হয়েছে। সে কারণেই এসব দূতাবাসগুলোকে আমরা সক্রিয় হতে দেখি। তারা চেষ্টা করছে তাদের পছন্দমতো একটি সমাধান আনতে।

কালবেলা : আপনি রাজনীতিবিদ-ব্যবসায়ী-প্রশাসন মিলে এক ধরনের নেক্সাসের কথা বলেছেন। এই নেক্সাস কি রাশিয়ার মতো কোনো অলিগার্ক তৈরি করবে বলে আপনি মনে করেন?

ড. মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌ : রাশিয়ার মতো সে ধরনের কোনো অলিগার্ক তৈরি হয়েছে সেটা এখন বলা যাবে না। তবে এই অলিগার্ক তৈরি হওয়ার পথে। আমি অবাক হয়েছি এটা দেখে, বাংলাদেশের যেসব ব্যবসায়ীকে আমরা চিনি তারা সকলেই সমবেত হয়ে স্লোগান দিচ্ছে- ‘বারবার দরকার, শেখ হাসিনার সরকার’। এটাতো ব্যবসায়ী সুলভ আচরণ নয়। ব্যবসায়ীদের কোনো দলীয় গণ্ডির মধ্যে নিজেদের আত্মপ্রকাশ করার চেষ্টা কোনো শুভ লক্ষণ নয়। আমাদের ব্যবসায়ীরা যে পথ বেছে নিয়েছেন সেটা সাময়িক নাকি দীর্ঘমেয়াদি সেটা আমি বুঝতে পারছি না। অনেক সময় সাময়িক স্বার্থে এই ধরনের স্লোগান দেওয়া হতে পারে। অনেককে বাধ্য করেও এই ধরনের স্লোগান দেওয়ানো হতে পারে। তারপরেও পুরো বিষয়টা দৃষ্টিকটু বলেই আমার কাছে মনে হয়। ব্যবসায়ীদের মনোভাবের মধ্যে কোনো ধরনের দলীয় পক্ষপাতিত্ব থাকাটা সুষ্ঠু ব্যবসার সহায়ক নয়।

কালবেলা : বলা হচ্ছে অনেকেই দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদ তৈরি করেছে। তারাতো যেভাবেই হোক সরকার টিকিয়ে রাখতে চাইবে। তাই না?

ড. মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌ : বাংলাদেশে সমাজের এবং মানুষের চিন্তা-ভাবনার ব্যাপক রূপান্তর ঘটেছে। সত্তরের দশকে একজন ব্যক্তির যে ধরনের চিন্তা-ভাবনা ছিল তা মানুষের এখনকার চিন্তা-ভাবনা থেকে অনেক আলাদা। কী কারণে বা কী আকর্ষণে মানুষের চিন্তা-ভাবনার এ রূপান্তর ঘটেছে তা বিস্তর গবেষণার দাবি রাখে। তবে মানুষ নিজের স্বার্থে বা একটা শ্রেণির জন্য শুধু তাদের নিজেদের স্বার্থে একটা দলকে টিকিয়ে রাখতে চাইবে এটা এখন দেখা যাচ্ছে।

কালবেলা : বিএনপি স্পষ্ট করেছে, তারা সরকারের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনায় বসবে না। তাহলে সমাধানটা কীভাবে হবে?

ড. মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌ : যদি সমাধানের চিন্তা থাকে তাহলে আলোচনায় বসার প্রয়োজন আছে। দুনিয়ার বড় বড় সমস্যাগুলোতেও আমরা লক্ষ্য করেছি, সেখানে শত্রুপক্ষ বা বিপরীত পক্ষের সঙ্গে এক ধরনের যোগাযোগ রাখা হয়। আমরা যখন তরুণ বয়সের, সে সময় পৃথিবীর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধ। এই যুদ্ধের ব্যাপ্তিকাল ছিল ২০/২২ বছর। সে সময় চীন এবং রাশিয়া এই যুদ্ধে ভিয়েতনামকে সাপোর্ট করেছে। তখন পোল্যান্ডের ওয়ারশ শহরে চীন এবং মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্রতিবছর অন্তত একবার করে বৈঠক করেছেন। সেসব বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছে তা আমরা জানি না। তবে সে সময়েরই একটি বৈঠকের পর চীনা রাষ্ট্রদূত গণমাধ্যমকে বলেছিলেন- আমি মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে ১৮৬তম ওয়ার্নিং দিয়েছি। অর্থাৎ দীর্ঘ একটি যুদ্ধের মধ্যেও দুপক্ষের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগটি অব্যাহত ছিল। এমনকি ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বের হয়ে আসতে চাইল তখনও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভিয়েতনামের এক ধরনের যোগাযোগ ছিল। তারা প্যারিসে আলোচনা করত। সে সময় একদিকে নেগোসিয়েশন চলেছে অন্যদিকে যুদ্ধ চলেছে। একপর্যায়ে এসে বিষয়টার সমাধান হলো। সুতরাং কঠিন সময়ের মধ্যেও কথা বলার কালচারটাই হলো রাজনীতি। কথা বলার জায়গা না থাকলে আমরা বিভাজিত মানুষে পরিণত হই। বলতে গেলে এক ধরনের অমানুষে পরিণত হই।

সরকারের শীর্ষস্থানীয় নেতারা যে ধরনের উক্তি করছেন সেখান থেকে আমার মনে হয়েছে তারা বিষয়টাকে ‘খেলা’ হিসেবে নিয়েছেন। কিন্তু রাজনীতি তো কোনো খেলা নয়। রাজনীতি একটি খুবই সিরিয়াস বিষয়। রাজনীতি আমাদের জীবন ও জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করে। সুতরাং এটাকে কোনো ধরনের হেলা-খেলায় পরিণত করা খুবই দায়িত্বহীনতার পরিচয়।

কালবেলা : আজকের রাজনৈতিক পরিস্থিতির পেছনে কোন বিষয়টি দায়ী?

ড. মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌ : ২০১৪ এবং ২০১৮-এর নির্বাচন অবশ্যই এখানে একটি বড় কারণ হিসেবে কাজ করছে। ২০১৪ সালে তারা খুবই বাজে রকমের একটি নির্বাচন করেছে। ২০১৮-তেও তারা একইভাবে বাজে নির্বাচন করে ক্ষমতায় টিকে থেকেছে। এর ফলে তাদের মধ্যে এক ধরনের মিথ্যা আত্মবিশ্বাস জেগেছে। যে আত্মবিশ্বাসটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে এবং বিপথে পরিচালিত করে। আর এর ফলেই অনেক হিসাব-নিকাশ ভুল হয়ে যায়। সব সময় একই ধরনের ঘটনা ঘটবে, একই ফলাফল আসবে এটা আমরা ভাবতে পারি না।

ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে এক ধরনের কোয়ালিশন তৈরি হয়েছে। আমাদের দেশের ক্ষমতা কোয়ালিশনে সামরিক বাহিনী রয়েছে, আধা সামরিক বাহিনী রয়েছে, পুলিশ ও আমলাতন্ত্র রয়েছে। ক্ষমতা কোয়ালিশনের অংশ হিসেবে রয়েছে ব্যবসায়ীরাও। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ফলে সমাজের এই গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোকে একটি একক কোয়ালিশনের মধ্যে আনতে পেরেছে বর্তমান শাসক দল। এই কোয়ালিশন যদি না ভাঙা যায় তাহলে কোনো সমাধান আসবে বলে আমার মনে হয় না। আমেরিকার ভিসা পলিসি আরোপের পর থেকে এই কোয়ালিশন কিছুটা দুর্বল হয়েছে। তাদের মধ্যে হালকা কিছু ফাটল লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিন্তু সেটা এক ধরনের নিষ্পত্তি বা সমাধান নিয়ে আসবে সে ধরনের অবস্থা এখনো সৃষ্টি হয়নি। তবে আগামী ১৫ দিন বা এক মাসের মধ্যে হয়তো পরিস্থিতি এক ধরনের নতুন রূপ গ্রহণ করতে পারে। এক পয়েন্টে সব থেমে থাকবে না, এটা নিশ্চিত।

কালবেলা : বিএনপির চলমান আন্দোলন নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণটা কী?

ড. মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌ : বিএনপি রাস্তায় মিছিল করছে, সমাবেশ করছে, পদযাত্রা করছে এমনকি মহাসমাবেশও করেছে। অবশ্যই এগুলোর মূল্য রয়েছে। কিন্তু মূল প্রশ্ন হলো- এসব কিছুর মধ্য দিয়ে বড় ধরনের এবং ব্যাপক অংশগ্রহণমূলক কোনো অভ্যুত্থান হবে কি না সেটা দেখার বিষয়। ঘরে বসে এখনো অনেকেই বর্তমান সরকারের সমালোচনা করে এবং নিন্দা করে। সরকারের বিরুদ্ধে তারা তাদের বিরক্তি প্রকাশ করে। সবই ঠিক আছে। কিন্তু তারা রাস্তার আন্দোলনে যেতে নারাজ। অর্থাৎ সে ব্যক্তিগতভাবে নিরাপদ থাকতে চায়। নিরাপদ থেকে সে সুবিধাগুলো পেতে চায়। এটাকে বলা হয় অপরচুনিজম। এই অপরচুনিস্ট বিহেভিয়ার আমাদের অনেক ক্ষতি করছে।

এখন প্রযুক্তি মানুষকে একটি সুযোগ দিয়েছে। মানুষ তার মনের ক্ষোভ রিলিজ করার জন্য ফেসবুককে ব্যবহার করে। আবার আইডিয়াস এবং ইনফরমেশন দ্রুত ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারেও এটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কাজেই এই নতুন প্রযুক্তি একদিকে আন্দোলনের গতিকে শ্লথ করার জন্য ভূমিকা পালন করছে, আবার অন্যদিকে তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে সহযোগিতাও করছে।

কালবেলা : অনেকেই বলেন বিএনপির আন্দোলনের সে ধরনের শক্তি নেই। আপনি কী বলবেন?

ড. মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌ : বিএনপি সম্পর্কে একটি কথা বারবারই বলা হয়- ‘এটা হলো ভদ্রলোকের দল’। আর ভদ্রলোকের চলাফেরা কেমন হয়? এমন যে- রাস্তা দিয়ে যাব কিন্তু আমার পায়ের নিচে ধুলা লাগবে না। বর্তমান সরকারের আমলে আন্দোলন করতে গিয়ে বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মী ঘর-বাড়ি ছাড়া হয়েছেন, অর্থনৈতিকভাবে হয়েছেন নিঃস্ব। এর মধ্য দিয়ে নতুন ধরনের লড়াকু মানুষ উদ্ভবের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

অন্যদিকে আমরা আওয়ামী লীগের মধ্যে একটি মারমার কাটকাট ভাব লক্ষ্য করি। সুতরাং আপনি কী ধরনের মানুষদের নিয়ে দল করছেন তার এক ধরনের প্রভাব থাকে দলের কার্যক্রমে। বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ, দুটি দলই মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্য থেকে গড়ে ওঠা দল। এখন এই মধ্যবিত্তের মধ্যে আচরণ এবং আকাঙ্ক্ষার জায়গায় যে পার্থক্য তৈরি হয়ে গেছে এটা কী কারণে এবং কেমন করে হলো সেটা ভাববার বিষয়। এটা সামাজিকভাবে গবেষণার বিষয়। কিন্তু কেউ তা করছে না।

শ্রুতলিখন : মুজাহিদুল ইসলাম

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

প্রথম দিনে উইন্ডিজ তুলল ২৫০ রান

গাঁজা-জাল নোটসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক

ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের শীতবস্ত্র বিতরণ

উইন্ডিজের প্রতিরোধ ভেঙে বাংলাদেশের স্বস্তি

টাইম ম্যাগাজিনকে ড. ইউনূস / ট্রাম্প ব্যবসায়ী, আমরাও একজন ব্যবসায়িক অংশীদার চাই

২০২৪ সালের হাইয়েস্ট কালেকশন দরদের : শাকিব 

নায়িকা পরীমনির প্রথম স্বামী নিহত

রাজনীতিতে আ.লীগের পুনর্বাসন ঠেকাতে হবে: নুর

নির্বাচন যত দ্রুত হবে, সমস্যা তত কমে আসবে : মির্জা ফখরুল

খাসজমির দখল নিয়ে সংঘর্ষে দুজন নিহত

১০

মাদকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে ক্রীড়াঙ্গন অন্যতম একটি মাধ্যম : আমিনুল হক 

১১

তারেক রহমানের আর্থিক সহায়তা নিয়ে সিয়ামের বাড়িতে মীর হেলাল

১২

আহত রানার পাশে ‘আমরা বিএনপি পরিবার’

১৩

ফেসবুকে দাবি ‘মুগ্ধ ও স্নিগ্ধ একই ব্যক্তি’, যা বলছে ফ্যাক্ট চেক

১৪

একদিকে প্রশান্তি, অশান্তিও বিরাজ করছে: শামা ওবায়েদ

১৫

চোর সন্দেহে খুঁটিতে বেঁধে যুবককে নির্যাতন

১৬

র‍্যানকন মটরসের সঙ্গে ক্র্যাক প্লাটুন চার্জিং সলুশনের চুক্তি

১৭

জনকল্যাণে কাজ করাই বিএনপির মূল লক্ষ্য : নয়ন

১৮

‘এক ফ্যাসিস্টকে হটিয়ে আরেক ফ্যাসিস্টকে ক্ষমতায় দেখতে চাই না’

১৯

জুলাই বিপ্লবে আহত মুক্তিযোদ্ধার ছেলে বাবুকে নেওয়া হচ্ছে থাইল্যান্ড

২০
X