শিশু বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ ও আদদ্বীন মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের অধ্যাপক। বাংলাদেশে পেডিয়াট্রিক রেসপিরেটরি রিসার্চের অগ্রগামী ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশে ২০০২ সালে দেশব্যাপী গবেষণায় ব্রঙ্কিওলাইটিস আবিষ্কার করেন এবং প্রমাণ করেন যে ছোট বাচ্চাদের শ্বাসকষ্টের সবচেয়ে সাধারণ কারণ হলো ব্রঙ্কিওলাইটিস, নিউমোনিয়া নয় এবং এর চিকিৎসার জন্য কোনো অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন নেই। তিনি মাতুয়াইল ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড অ্যান্ড মাদার হেলথের সাবেক নির্বাহী পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তৌহিদুল ইসলাম।
কালবেলা : শিশুদের রোগ ব্রঙ্কিওলাইটিসের সঙ্গে বাংলাদেশকে ২০০২ সালে আপনিই পরিচিত করিয়েছেন। এটি কী ধরনের রোগ এবং কতটা ঝুঁকিপূর্ণ একটু বিস্তারিত বলবেন কি?
ডা. এ আর এম লুৎফুল কবীর : ব্রঙ্কিওলাইটিস বাচ্চাদের শ্বাসতন্ত্রের অসুখ। আমাদের বুকের ভেতর যে ফুসফুস আছে তা উল্টানো গাছের মতো এবং গাছের যে কাজ ফুসফুসেরও সেই কাজ। গাছের কাজ কী? গাছের কাজ হলো অক্সিজেন ছেড়ে দেওয়া আর কার্বন ডাইঅক্সাইড নিয়ে নেওয়া। অন্যদিকে আমাদের ফুসফুস অক্সিজেন নিয়ে কার্বন ডাই অক্সাইড ছেড়ে দেয়। গাছের মতো ফুসফুসেরও শাখা প্রশাখা হয়ে পাতার মতো স্থান আছে। এই পাতার আগে ডগা থাকে সেখানে যদি ভাইরাসজনিত ইনফেকশন হয় (রেসপিরেটরি সিনসিয়ারাল ভাইরাস) তাকে বলে ব্রঙ্কিওলাইটিস।
কালবেলা : রোগটি কাদের বেশি হয়?
ডা. এ আর এম লুৎফুল কবীর : সাধারণত দুই বছরের নিচে যেসব শিশু আছে তাদের এ রোগটি বেশি হয় এবং শীতকালে এর প্রকোপ বেড়ে যায়। সম্প্রতি আমাদের আদদ্বীন হাসপাতালে ৭৬ জন শিশুর মধ্যে ৩৬ জনই ব্রঙ্কিওলাইটিস নিয়ে ভর্তি আছে। বর্তমানে শিশুদের ডেঙ্গু, ব্রঙ্কিওলাইটিস ও হ্যান্ড ফুট অ্যান্ড মাউথ ডিজিজ বেশি হচ্ছে। বিশেষ করে ব্রঙ্কিওলাইটিস সামনে আরও বাড়ার আশঙ্কা আছে।
কালবেলা : রোগটি কতটা আশঙ্কাজনক?
ডা. এ আর এম লুৎফুল কবীর : এই রোগটি সাধারণত শীতের সময় বেশি হয়। আমরা আউটব্রেকও বলতে পারি। অনেক সময় মহামারিও হতে পারে। মহামারি আমরা দেখিনি, তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটাকে আউটব্রেক বলা যায়।
কালবেলা : দুই বছরের কম বয়সী বাচ্চাদের এই রোগটি বেশি হয় বলছিলেন। এই বয়সের কোন বাচ্চারা বেশি ঝুকিপূর্ণ?
ডা. এ আর এম লুৎফুল কবীর : দুই থেকে ছয় মাসের বাচ্চারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এক বছর পার হয়ে গেলে রোগে আক্রান্ত হওয়ার হার কমে যায়। আর সাধারণত দুই বছরের পর আর ব্রঙ্কাইটিস হয় না। তবে যেসব শিশু অল্প ওজনের হয় বা অপরিণত হয় বা যাদের জন্মগত হার্টের ত্রুটি আছে তাদের এই রোগ হওয়ার ঝুঁকি বেশি। তাদের এই রোগ হলে তুলনামূলক বেশি সময় ভোগে। এ ছাড়া যারা অপুষ্টিতে ভোগে তারাও ঝুঁকিতে আছে।
কালবেলা : এই রোগের লক্ষণগুলো কী কী?
ডা. এ আর এম লুৎফুল কবীর : সাধারণত হাল্কা কাশি দিয়ে শুরু হতে পারে। পরে হঠাৎ করে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হয়, দ্রুত শ্বাস নেয়। যে বাচ্চার বয়স ২ মাসের নিচে, তার রেস্পিরেটরি রেইট যদি মিনিটে ৬০-এর বেশি হয়, ২ থেকে ১২ মাসের বাচ্চারদের ৫০-এর বেশি, এক বছরের উপরে যদি ৪০-এর ওপর হয় সেটাকে আমরা দ্রুত শ্বাস নেওয়া বলি। আরেকটা লক্ষণ হলো বুক ডেবে যাওয়া, খুব অস্থির থাকা, খেতে পারে না, ঘুমাতে পারে না, কান্নাকাটি করে। জ্বর খুব থাকবে না, যেটা নিউমোনিয়াতে থাকে। শ্বাস নেওয়ার সময় তাদের বুকের ভেতর শব্দ হয়।
কালবেলা : নিউমোনিয়া কথা বললেন। আমরা জানি, এই রোগেও বাচ্চাদের নিউমোনিয়া হয়। ব্রঙ্কিওলাইটিস ও নিউমোনিয়া রোগ দুটি একই ধরনের কিনা?
ডা. এ আর এম লুৎফুল কবীর : নিউমোনিয়া হয় বুকে ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনের কারণে। এতে মৃত্যুর হার বেশি থাকে যা আমাদের জন্য চিন্তার কারণ। আমাদের সঠিক ও দ্রুত চিকিৎসা দিতে হবে এই রোগের জন্য। ৮০ ও ৯০ দশকের দিকে যখন নিউমোনিয়ার অনেক শিশু মারা যেত তখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা ছিল, বাচ্চার শ্বাসকষ্ট হলেই যাতে নিউমোনিয়ার চিকিৎসা দেওয়া হয়। কিন্তু সেটা প্যারামেডিক্সদের জন্য বলা হয়েছিল। এখন চিকিৎসকরাও এই জিনিস রপ্ত করে নিয়েছে। শ্বাসকষ্ট, ফাস্ট ব্রিদিং হয়ে গেছে তাহলে নিউমোনিয়া। কিন্তু আমরা ২০০২ সালে দেখলাম দেশে ব্রঙ্কিওলাইটিস বেড়েছে। আমরা যারা গবেষণা করি, আমাদের কাজই হলো ব্রঙ্কিওলাইটিসের সঙ্গে মানুষকে পরিচিত করানো। এই দুই রোগের চিকিৎসার পার্থক্য হলো, ব্রঙ্কিওলাইটিস ৪-৫ দিনে ভালো হয়ে যায়। এর জন্য সাপোর্টিভ চিকিৎসা দিতে হয়। যেমন, অক্সিজেন লাগলে অক্সিজেন দেওয়া, জ্বর হলে ওষুধ দেওয়া, খাবার নিশ্চিত করতে হবে। আর নিউমোনিয়া হলে অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হবে। রোগের ভবিষ্যতের কথা বলতে গেলে, ব্রঙ্কিওলাইটিস কয়েকবার হতে পারে। এ থেকে হাঁপানিও হতে পারে, সেরেও যেতে পারে। তবে নিউমোনিয়া একবার হলে আর তা জীবনে হবে না। আবার একজনের ষাট বছর বয়সে নিউমোনিয়া হতে পারে। কিন্তু ব্রঙ্কিওলাইটিস দুই বছরের পর আর হবে না।
কালবেলা : ব্রঙ্কিওলাইটিসের চিকিৎসা সম্পর্কে আমাদের একটু বিস্তারিত বলবেন কী?
ডা. এ আর এম লুৎফুল কবীর : চিকিৎসানির্ভর করে রোগী কোন অবস্থায় আমাদের কাছে আসছে তার ওপর। হালকা লক্ষণ থাকলে বাসায় চিকিৎসা করা যায়। কিন্তু অবস্থা ভালো না হলে, খেতে না পারলে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। অক্সিজেনের মাত্রা কমে গেলে অক্সিজেন দিতে হবে। ব্রঙ্কিওলাইটিসের চিকিৎসা নিয়ে এই পর্যন্ত যা গবেষণা হয়েছে, সেখানে শুধু অক্সিজেন, অক্সিজেন, অক্সেজেন। এর বাইরে কিন্তু নতুন কিছু আবিষ্কার করা হয়নি। এখানে অ্যান্টিবায়োটিকে কোনো ভূমিকা নেই।
কালবেলা : আমাদের দেশে ব্রঙ্কিওলাইটিসকে নিউমোনিয়া ভেবে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে যাকে ভুল চিকিৎসাও বলতে পারি। এই ভুল চিকিৎসা শিশুর জন্য কতটা ক্ষতিকর?
ডা. এ আর এম লুৎফুল কবীর : প্রথম বিষয় হলো, অভিভাবকরা আসল রোগ সম্পর্কে জানতে পারল না। আরেকটা বিষয় হলো অ্যান্টিবায়োটিকের অযৌক্তিক ব্যবহার। আমাদের দেশে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্টেন্স যেভাবে ভয়াবহ আকারে বাড়ছে সেই পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করবে। এখনি আমরা এমন বাচ্চা পাই যাদের অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করতেছে না।
কালবেলা : ব্রঙ্কিওলাইটিসে মৃত্যুর আশঙ্কা কেমন থাকে? রোগী পুরোপুরি আরোগ্য হয় কিনা?
ডা. এ আর এম লুৎফুল কবীর : নিউমোনিয়ার সঙ্গে তুলনা করলে এই রোগে মৃত্যু কম। চিকিৎসা দিতে পারলে বাঁচানো যায়। অবস্থা অনেক খারাপ হয়ে গেলে আইসিইউতে নিতে হয়। নিতে না পারলে মারা যাবে।
কালবেলা : আমাদের দেশে নিউমোনিয়া ও ব্রঙ্কিওলাইটিসের চিকিৎসা মিলিয়ে ফেলার প্রবণতা আছে কী?
ডা. এ আর এম লুৎফুল কবীর : আছে। আমরা শুরুতে যখন গবেষণা করি ২০০২ সালে। তখন দেখেছিলাম ৯৯ শতাংশ চিকিৎসকই অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছে। সম্প্রতি আমরা যে গবেষণা করেছি সেখানে দেখা যাচ্ছে মাত্র ৪ শতাংশ কমেছে, মানে এখনো ৯৫ শতাংশ চিকিৎসক ভুল চিকিৎসা দিচ্ছে।
মন্তব্য করুন