ড. আলী রীয়াজ
প্রকাশ : ২২ জানুয়ারি ২০২৫, ০৫:৪০ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার একটি নির্দিষ্ট সীমা থাকবে

সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. আলী রীয়াজ। ছবি : সংগৃহীত
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. আলী রীয়াজ। ছবি : সংগৃহীত

ড. আলী রীয়াজ : সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান। একাধারে তিনি একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, লেখক ও গবেষক। তিনি ইলিনয় স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট। সংবিধান সংস্কারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেন তিনি।

কালবেলা : বাংলাদেশে একটি সফল গণঅভ্যুত্থানের পর সংবিধান সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ সংক্রান্ত একটি কমিশনও গঠন করেছে সরকার, আপনি যার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। নতুন সংবিধান প্রণয়নে জনগণের অন্তর্ভুক্তি কিভাবে নিশ্চিত হতে পারে বলে মনে করেন?

ড. আলী রীয়াজ: একটি দেশের সংবিধান যেহেতু একটি রাজনৈতিক দলিল, তাই এর প্রধান উদ্দেশ্য থাকে জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করা এবং তার প্রতিফলন ঘটানো। একইভাবে সংবিধান একটি রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ পথরেখা তৈরি করে এবং গাইডলাইন হিসেবে কাজ করে। সংবিধানের মাধ্যমে জনগণের সঙ্গে রাষ্ট্রের একটি চুক্তি করা হয়। যে চুক্তির আওতায় রাষ্ট্র ক্ষমতা পরিচালিত হবে। যে যখন ক্ষমতায় আসবেন তারা পরিচালিত হবেন। সংবিধানের আওতায়ই তারা আইন প্রণয়ন করবেন। যেহেতু জনগণের সঙ্গে রাষ্ট্রের একটি চুক্তি হচ্ছে তাই সংবিধান প্রণয়নে জনগণের অন্তর্ভুক্তি অবশ্য প্রয়োজনীয় / আবশ্যকীয় একটি বিষয়।

পরবর্তী বিষয় হল- আপনি জনগণের সঙ্গে কোন প্রক্রিয়ায় এই চুক্তিটি করবেন? প্রথম প্রক্রিয়াটি হল একটি নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের মতামত নেওয়া। সাধারণ পরিস্থিতিতে এই প্রক্রিয়ায় সংবিধান বিনির্মাণে জনগণের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু বিশেষ কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটলে, যেমন- স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে একটি দেশের আবির্ভাব ঘটলে বা কোনো বিপ্লব সংঘটিত হলে, চুক্তিটি নতুন করে করতে হয় অথবা আগেরটি পরিবর্তন করতে হয়। পরিবর্তন করতে হয় কারণ, বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষাটি সংবিধানে যুক্ত করার বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একটি গণঅভ্যুত্থান ঘটেছে। অভাবনীয়, অভূতপূর্ব একটি গণঅভ্যুত্থান। এর চেয়ে বড় গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশে দ্বিতীয়টি হয়নি। আর এই গণঅভ্যুত্থানের পেছনে রয়েছে বিগত ১৬ বছরের দীর্ঘ এক স্বৈরাচারী শাসন। যেহেতু রক্তক্ষয়ী এক গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নতুন একটি অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে তাই সংবিধানে এই গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাগুলো যুক্ত করতে হবে। জনগণের সঙ্গে রাষ্ট্রের নতুন করে চুক্তি করতে হবে। কারণ বিরাজমান কাঠামোই একটি স্বৈরতন্ত্র তৈরি করেছিল।

এখন প্রশ্ন হল, রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের নতুন করে চুক্তি বা নতুন সংবিধান কিভাবে তৈরি করা হবে? সাধারণত স্বাধীনতা উত্তর বা বৈপ্লবিক পরিস্থিতিতে একটি কনস্টিটিউশন অ্যাসেম্বলির মাধ্যমে এটা করা হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা একটি মাঝামাঝি জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি। এখানে যদি একটি কনস্টিটিউশন অ্যাসেম্বলি তৈরি সম্ভব হতো বা এখনোও যদি সম্ভব হয়, সেটা একটি পথ। আরেকটা পথ হল, সামাজিক চুক্তি। যে চুক্তিতে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত থাকবে এবং সেই মতামতের ভিত্তিতে একটি সংবিধান রচিত হবে। এরপর একটি গণভোটের মাধ্যমে সেই সংবিধান গৃহীত হবে। তৃতীয় একটি উপায় হলো- কোনো চুক্তির ভিত্তিতে এমন একটি সংসদ তৈরি হবে যে সংসদ প্রাথমিকভাবে গণপরিষদের কাজটাও করবে। একই সঙ্গে তারা দেশও শাসন করবে। এরকমভাবে একাধিক পথ ও পদ্ধতি রয়েছে। মূল কথা হলো জনগণের অংশগ্রহণের জায়গাটি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো সামাজিক চুক্তি দাঁড় করানো সম্ভব নয়।

কালবেলা: ১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানে কি জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন নেই?

ড. আলী রীয়াজ: না, নেই। আমি স্পষ্ট করে বলতে পারি, ৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধান তৈরীর ক্ষেত্রে জনগণের আকাঙ্খার প্রতিফলন নেই। সেখানে যে বিষয়গুলো বিবেচ্য থেকেছে তা হলো - রাষ্ট্র কিভাবে নিজেকে রক্ষা করবে। এটা ঠিক, যেকোনো সংবিধান তৈরীর ক্ষেত্রে রাষ্ট্র একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জনগণের আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটিয়ে যে রাষ্ট্র তৈরি হবে সে রাষ্ট্র আগে জনগণকে রক্ষা করবে। রাষ্ট্রকে জনগণের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এই জায়গাগুলো আমরা ৭২ সালের সংবিধানে দেখতে পাইনি। সংবিধানে যতটা না নাগরিকের অধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে তার চেয়ে বেশি পথ ও পদ্ধতি তৈরি করা হয়েছে নাগরিকের অধিকার কেড়ে নেওয়ার। সংবিধান মূলত রক্ষা করেছে এমন সব ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে যারা ক্ষমতায় রয়েছে। বাংলাদেশে গত ৫২ বছরে করা সংবিধান সংশোধনীগুলোর দিকে তাকালে আমরা এর উদাহরণ পাব। সংশোধনীগুলো ক্ষমতাকে আরও এককেন্দ্রিক করেছে। নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।

কালবেলা: বাংলাদেশের সংবিধান কি জনগণের জন্য সহজ পাঠ্য ছিল না?

ড. আলী রীয়াজ: সহজ পাঠ্য ছিল না। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি বাংলাদেশের সংবিধান যেভাবে লেখা আছে, প্রকৃতপক্ষে সেটা পাঠ যোগ্যতার বিবেচনায় অত্যন্ত দুরুহ এবং কঠিন। এই ভাষা সাধারণ নাগরিকের কাছে কোনো অর্থ তৈরি করে না। মানুষ বুঝতেই পারে না এই সংবিধান তাকে কি অধিকার দিচ্ছে, তার কি অধিকার রক্ষিত আছে এখানে। আমরা সংবিধান সংস্কার কমিশন যখন কাজ শুরু করলাম তখন দেখলাম মানুষ বারবার এই বিষয়টির কথা তুলছেন। সকলেই সংবিধানের ভাষা সহজ করতে বলছেন। তবে যেহেতু আমরা সংবিধান লিখছি না, আমাদের কাজ শুধুমাত্র সুপারিশ করা, তাই সহজ করার দায়িত্বটা শেষ পর্যন্ত অন্যদের হাতে পৌঁছাবে। তবে অংশীজনদেরকে আমরা এই বার্তাটা দিতে চাই যে - সংবিধান লেখার সময় এর ভাষা যথাসম্ভব সহজ করতে হবে। চলিত ভাষায় লিখতে হবে যাতে একজন দিনমজুর বা রিক্সাওয়ালাও সংবিধান পড়ে বুঝতে পারে এখানে কি লেখা আছে।

কালবেলা: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মানুষের মৌলিক অধিকার এবং নৈতিক দায়িত্ব এই সম্পর্কটিকে সংবিধানে কিভাবে নির্ধারণ করা যায় বলে মনে করেন?

আলী রীয়াজ: নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব হলো, যে সকল বিষয়ে রাষ্ট্রের সঙ্গে তার সমঝোতা হবে তা সে গ্রহণ করবে এবং বৈধ বলে মনে করবে। ধরি, রাস্তায় চলতে গেলে লাল বাতি দেখে আমাদেরকে থামতে হবে। এটা আমার দায়িত্ব। এর মধ্য দিয়ে আমি আমার কিছুটা অধিকার ছাড় দিচ্ছি যে আমি ইচ্ছামতো গাড়ি চালাতে পারব না। কিংবা রাষ্ট্র আমাকে বলছে যে, আমি কাউকে আহত করতে পারবো না। এটা মানা আমার নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু রাষ্ট্র যদি আমাকে এগুলো বলে না দিত তাহলে নৈতিক দায়িত্বের বিধানটা তখন বাধ্যবাধকতা হয়ে উঠতো না।

কালবেলা: সংবিধানে রাষ্ট্র এবং নাগরিকের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত বলে মনে করেন?

ড. আলী রীয়াজ: আমার মতে রাষ্ট্রে বিশেষত যেখানে বহু জাতি, বহু ধর্ম, বহু মত এবং বহু পথের মানুষ রয়েছে সেখানে বিষয়টা কিছুটা জটিল হয়ে পড়ে। কিন্তু জাতিগতভাবে আমাদের যে বৈচিত্র রয়েছে তা রাষ্ট্রকে সর্বপ্রথম স্বীকার করতে হবে এবং ধারণ করতে হবে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রকে তার প্রত্যেক নাগরিকের বৈশিষ্ট্যের সুরক্ষা দিতে হবে। রাষ্ট্রে একজন নাগরিকের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ভিন্নতাসহ নানা বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে। বিশেষ করে একজন নাগরিকের কিছু কাস্টমারি ল রয়েছে, নাগরিকের আচার-আচরণ রয়েছে। রাষ্ট্রের প্রধান কাজ হলো, নাগরিক হিসেবে সকলের, সকল বৈশিষ্ট্যের মানুষের জন্য সমতা বিধান করা। একই সঙ্গে প্রত্যেক নাগরিকের যে নিজস্বতা রয়েছে সেটা যেন কোনো অবস্থাতেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তার নিশ্চয়তা প্রদান করা। এই নিশ্চয়তা বিধান করা হয় দুইভাবে। একটি হল - আইনের মাধ্যমে। আরেকটি হলো - রাষ্ট্রের অবস্থানের মাধ্যমে।

দেশে যদি আইনের শাসন এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যায় তাহলেই নাগরিকের বেশিরভাগ অধিকার নিশ্চিত হয়ে যায়। সকলের কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং জবাবদিহীতার ক্ষেত্র তৈরি হয়। আরেকটি বিষয় হলো প্রতিষ্ঠান। আমরা এখানে বিচার বিভাগকে উদাহরণ হিসেবে ধরতে পারি। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা বলা হয় কারণ নাগরিক সুরক্ষার একটি জায়গা প্রয়োজন। দেশের আইনসভা তার ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করতে পারে, নির্বাহী বিভাগ তার ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করতে পারে কিন্তু নাগরিকের আশ্রয়ের জন্য একটি জায়গা প্রয়োজন। সেটা হলো আদালত বা বিচার বিভাগ। এই প্রাতিষ্ঠানিক বা আইনি ব্যবস্থাই রাষ্ট্রের সঙ্গে বহুজাতিভিত্তিক সমাজের সম্পর্কের ভিত্তি।

কালবেলা: বাংলাদেশ দীর্ঘদিন এক ধরনের স্বৈরশাসনের মধ্য দিয়ে গেছে। বলা হয় এই সময়ে রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠান ভেঙ্গে পড়েছে। সংবিধান সংস্কারের মাধ্যমে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ কতটা সম্ভব বলে মনে করেন?

ড. আলী রীয়াজ: আমি মনে করি এ ক্ষেত্রে সংবিধান কিছুটা রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করতে পারে। কিন্তু সকল ক্ষেত্রে নয়। সংবিধান যা করতে পারে তা হলো, এই প্রতিষ্ঠানগুলো কিভাবে তার স্বাধীনতা রক্ষা করবে বা ভূমিকা পালন করবে তার দিকনির্দেশনা দিতে পারে। তবে এখানে উন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রয়োজন হবে। কিন্তু সবার আগে আমরা সংবিধানের কথা বলি কারণ, প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরি করার ক্ষেত্রে সংবিধান গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতার পর গত ৫৩ বছরেও দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকভাবে গড়ে ওঠেনি। এই সময় প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল অত্যন্ত দুর্বল। প্রথমত, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পরই একটি একদলীয় ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে গিয়েছে বাংলাদেশে। এরপর দীর্ঘ ১৫ বছর সেনা শাসন প্রত্যক্ষ করেছি। ১৯৯১ সালে প্রথম আমাদের সামনে একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সেই সম্ভাবনাও সেভাবে ব্যবহার করা যায়নি।

সুযোগ এসেছিল প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তভাবে তৈরি করার। কিন্তু এখানে ক্ষমতাসীনরা চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। আমাদের দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বলই থেকে গেছে বা রাখা হয়েছে। ১৯৯১ থেকে ২০০৬ সাল এই সময়টা গণতান্ত্রিক সরকার থাকলেও প্রকৃতপক্ষে ছিল প্রধানমন্ত্রীর অধীন। সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা অবশ্যই থাকবে তবে তার একটি সীমা থাকতে হবে। বাংলাদেশে দেখা যায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় শক্তিশালী হয়, ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী শক্তিশালী হন। আর প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল রয়ে যায়।

২০০৯ সালে আমরা গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। এই সময়ে আমাদের সামনে আগের ১৫ বছরের গণতন্ত্র চর্চার অভিজ্ঞতা ছিল। কিছু দুর্বলতা চিহ্নিত করা গেছে। ক্ষমতাসীনরা চাইলে সেই দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে একটি মজবুত গণতন্ত্রের দিকে এগোতে পারত। এটা ছিল একটি রাস্তা। আরেকটি রাস্তা ছিল- আগের ১৫ বছর যেভাবে গেছে সামনেও সেভাবেই যাবে। কিন্তু শেখ হাসিনা কোনো দিকেই গেলেন না। তিনি ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করলেন এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে ফেললেন। শুধু ধ্বংস করলেন বললে ভুল হবে, তিনি অত্যন্ত পরিকল্পিত উপায়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে অন্তসারশূন্য করে ফেললেন। শেখ হাসিনা একটি ব্যক্তিতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন

কালবেলা: রাজনীতিবিদদের ওপর সংবিধানের বাস্তবায়ন নির্ভর করে। ফলে তারা ভালো করলে ভালো হয়, না করলে হয় না। এর কোনো সমাধান আছে কী?

ড. আলী রীয়াজ: আমি মনে করি, শ্রেষ্ঠ সংবিধানও গণতন্ত্রের নিশ্চয়তা দেয় না, শুধুমাত্র সম্ভাবনা তৈরি করে। এখন প্রশ্ন হলো, সংবিধান নিশ্চয়তা না দিলে নিশ্চয়তা দেবে কে? আমার রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সামান্য পড়ালেখা থেকে আমি যেভাবে বুঝি তা হলো, সংবিধান শুধুমাত্র পথ দেখায়। এরপর তা বাস্তবায়নের জন্য দুটো জায়গা রয়েছে। একটি হলো প্রতিষ্ঠান। আমাদের দেখতে হবে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে এবং জবাবদিহিতার ভিত্তিতে কাজ করছে কিনা। আর দ্বিতীয়টি হলো, রাজনৈতিক সংস্কৃতি। এখানে রাজনৈতিক সংস্কৃতি বলতে শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলের মধ্যে নয় বরং সমাজের মধ্যেও সচেতনতার জায়গাটা থাকতে হবে।

সবশেষ কথা হল, গণতন্ত্র কেবলমাত্র প্রতিষ্ঠার বিষয় নয় বরং চর্চার বিষয়। প্রতিদিনের চর্চার বিষয়। আমরা দেখেছি, ২৫০ বছরের পুরনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়ে গেছে। কারণ তারা গণতন্ত্র চর্চার জায়গায় দুর্বলতা দেখিয়েছে। সংবিধান গণতন্ত্রের শুরু হিসেবে কাজ করে। এরপর আসে প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং জনগণের অংশগ্রহণ। এই সব কিছু একটি পাজলের মতো। পাজলে যেমন একটি পিচ থেকে শুরু করতে হয় তেমনি গণতন্ত্রও একটি জায়গা থেকে শুরু করতে হয়। সেই শুরুর জায়গাটি হল সংবিধান।

কালবেলা: সংবিধানে রাষ্ট্র ধর্ম নিয়ে অনেক আলোচনা এবং বিতর্ক রয়েছে। সেক্ষেত্রে সংবিধানে রাষ্ট্রীয় ধর্মের ধারণাটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য কতটুকু প্রাসঙ্গিক বলে মনে করেন?

ড. আলী রীয়াজ: রাষ্ট্রধর্মের সঙ্গে গণতন্ত্রের খুব একটা বিরোধ আছে এটা আমি বলবো না। পৃথিবীর বহু দেশ যেখানে গণতন্ত্রের সঠিক চর্চা রয়েছে সেখানেও রাষ্ট্রধর্ম রয়েছে। সে সব দেশের সংবিধানেও আল্লাহ বা ঈশ্বরের কথা বলা আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, দৈনন্দিন জীবনের এটার কি প্রয়োগ হচ্ছে? সকল নাগরিকের জন্য সমতা নিশ্চিত করা যাচ্ছে কিনা।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে সেকুলার বলে দাবি করে অথচ তার ডলারের ওপর লেখা রয়েছে "গড উইথ আস"। কোথাও লেখা না থাকলেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট শপথ গ্রহণ করেন বাইবেলের ওপর হাত রেখে। ইউরোপের অনেক দেশ রয়েছে, যেখানে অফিসিয়াল চার্চ রয়েছে। এখন আমাদের দেখতে হবে, এগুলো কি সেসব দেশে গণতন্ত্র বা নাগরিক অধিকার রক্ষায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে কিনা। বহুত্ববাদীতার যে স্বীকৃতি আমরা যুক্তরাষ্ট্রে বা ইউরোপীয় দেশগুলোতে দেখি তা যদি নিশ্চিত করা যায়, তাহলে রাষ্ট্র ধর্ম থাকা একেবারে বড় রকমের ক্ষতি হয়ে যাবে তা নয়। আবার না থাকলেও ক্ষতি হয়ে যাবে এমন নয়।

রাষ্ট্রধর্ম থাকা বা না থাকায় কোনো দেশের বড় ধরনের লাভ বা ক্ষতি হয়েছে এমনটা আমি দেখতে পাইনি। তবে আমাদেরকে দেখতে হবে যে, জনগণের মধ্যে এটা নিয়ে কি ধারণা রয়েছে? জনগণ কিভাবে দেখতে চান? মূল কথা হলো, রাষ্ট্রধর্ম থাকলেও অন্য ধর্মের মানুষের অধিকার নিশ্চিত হচ্ছে কিনা সেটি দেখতে হবে। বহুত্ববাদীতা নিশ্চিত হচ্ছে কিনা। আইনের চোখে সকলের সমতা বিধান হচ্ছে কি না। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে স্বীকার করা হচ্ছে কি হচ্ছে না। এগুলো নিশ্চিত হলে রাষ্ট্রধর্মে কোনো সমস্যা নেই।

কালবেলা: বাংলাদেশে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদীয় ব্যবস্থার সুপারিশ করছেন আপনারা। দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের সুবিধা-অসুবিধা গুলো জানতে চাই?

ড. আলী রীয়াজ: দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের অভিজ্ঞতা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম। প্রাথমিকভাবে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের ধারণা আসে পার্লামেন্টে সমাজের যথাসম্ভব বেশি মানুষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য। আমরা যখন গণতন্ত্র অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সরকার গঠনের সিস্টেমে যাই তখন এখানে কিছু সমস্যা তৈরি হয়। ধরি একটি দল ৫১ শতাংশ ভোট পেয়ে সরকার গঠন করল। অর্থাৎ এখানে সমাজের প্রায় অর্ধেক মানুষই সরকারের বাইরে থেকে গেল। এটা একটি সমস্যা। এছাড়াও সামগ্রিকভাবে আমরা দেখতে পাই, সমাজের মধ্যে বহু ধরনের মানুষ রয়েছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সরকার গঠন করলে সেখানে কি এই সকল ধরনের মানুষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা যায়? সেটা করা যায় না। সেই জায়গা থেকে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের যুক্তিটা তৈরি হয়। দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট ব্যবস্থা থাকলে উচ্চকক্ষে সকল ধরনের মানুষের প্রতিনিধিত্ব যুক্ত করা যায়।

একদিকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের প্রয়োজনীয়তা সামনে আসছে। অন্যদিকে, বিভিন্ন দেশে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট চর্চা করতে গিয়ে দেখা গেছে এর কিছু নেতিবাচক দিকও রয়েছে। নেতিবাচক দিকগুলো হলো - ছোট দলের কাছে বড় দল জিম্মি হয়ে যাচ্ছে। গুটিকয় মানুষ মিলে বৃহৎ মানুষের সিদ্ধান্তকে জিম্মি করে ফেলছে। ফলে সবকিছু মিলে একটি ব্যালেন্সের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিচ্ছে। অনেক দেশ এই ব্যালেন্সের ক্ষেত্রে কিছু কৌশল অবলম্বন করেছে যেমন- পার্লামেন্টের নিম্ন কক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে একদল সরকার গঠন করছে। সেই দল দেশের মোট ভোটারের যে পারসেন্টেজে ভোট পেয়েছে পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষে তাদের সেই পার্সেন্টেজে প্রতিনিধিত্ব থাকবে। এভাবে যখন ২ হাউজের মধ্যে ক্ষমতার বন্টন হবে তখন এক পক্ষ অন্য পক্ষকে জিম্মি করে ফেলতে পারবে না।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট ব্যবস্থার আলাপ আসছে। কারণ মানুষ দেশে ক্ষমতার ভারসাম্য দেখতে চায়। আমরা দেশের চারটি ভালো নির্বাচনের দিকে তাকালে দেখব, বাংলাদেশে কোনো দল পঞ্চাশ শতাংশ ভোট পায়নি। সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশের কাছাকাছি পর্যন্ত ভোট পেয়েছে। অর্থাৎ এই সিস্টেমে সরকার গঠন হলে সেখানে ৬০ শতাংশ মানুষের কোনো প্রতিনিধিত্ব থাকছে না। এই ৬০ শতাংশ মানুষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিচ্ছে। এছাড়া দেশের জ্ঞানী গুণী মানুষ, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় যাদের অংশগ্রহণ প্রয়োজন কিন্তু তারা নির্বাচনে যাবেন না, এই ধরনের মানুষদেরকেও পার্লামেন্টের সঙ্গে যুক্ত করতে হলে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট প্রয়োজন হয়। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের আইডিয়াটাই আসে ক্ষমতার এক ধরনের চেক এন্ড ব্যালেন্স তৈরি করার জন্য। একই সঙ্গে বৃহৎ কমিউনিটির প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য।

কালবেলা: রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করতে সংবিধান কি ধরনের ভূমিকা পালন করতে পারে বলে মনে করেন?

ড. আলী রীয়াজ: রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় সংবিধানিক নিশ্চয়তা প্রদানের কয়েকটি পথ রয়েছে। আমরা যদি উপর থেকে নিচ বা ভার্টিকালি বিষয়টি দেখি তাহলে দেখব, পার্লামেন্টারি সিস্টেমে ক্ষমতার কেন্দ্র হলেন প্রধানমন্ত্রী। তার জবাবদিহিতার জায়গা কোথায়? প্রথমত, তার জবাবদিহির জায়গা হল জনগণ। যদি একটি স্বচ্ছ নির্বাচনী ব্যবস্থা তৈরি করা যায়, তাহলে ৪ বছর বা ৫ বছর পর পর তাকে জনগণের কাছে যেতে হবে। দ্বিতীয়তঃ, তার জবাবদিহির জায়গা হতে পারেন রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তার কাছে এক ধরনের জবাবদিহিতার মেকানিজম তৈরি করা যেতে পারে। তার জন্য রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকতে হবে।

আর যদি আড়াআড়ি বা হরাইজনটালি দেখি তাহলৈ পার্লামেন্টের ভেতরেই জবাবদিহিতার ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। সিলেক্ট কমিটি বা স্ট্যান্ডিং কমিটিগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। এমন একটি ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে যেন সংসদ সদস্যরাও সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করতে পারেন। ব্রিটেন আমরা দেখেছি, কনজারভেটিভ পার্টি ক্ষমতায় রয়েছে কিন্তু প্রধানমন্ত্রী পরিবর্তন হয়ে গেছে। কারণ নেতৃত্বের প্রতি মানুষ বা দল আস্থা রাখেনি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এই জায়গাটা তৈরি করতে হবে। এছাড়াও সোশ্যাল অ্যাকাউন্টিবিলিটির একটি বিষয় রয়েছে। এখানে দেশের সিভিল সোসাইটি একটি বড় ভূমিকা রাখতে পারেন। তার জন্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

এই সমগ্র সিস্টেমের মধ্যে একটি ছাড়া অন্যটি অসম্পূর্ণ। সবকিছুকে একটি প্যাকেজ হিসেবে দেখতে হবে। এটি অ্যাকাউন্টটিবিলিটির মেকানিজম তৈরি করতে হবে। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করতে হবে। মানবাধিকার কমিশনকে শক্তিশালী করতে হবে। দেশের ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করতে হলে এগুলো আবশ্যকীয়।

কালবেলা: অনেকে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বিলুপ্তির সুপারিশ করেছেন। এই বিষয়ে আপনার মতামত কি?

ড. আলী রীয়াজ: সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে সংসদ সদস্যরা পার্লামেন্টে দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবে না। আমি মনে করি এর মাধ্যমে সংসদ সদস্যদেরকে এক ব্যক্তির কাছে আটকে দেওয়া হয়েছে। আমরা দেখেছি, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী দলের নেতা, তিনি সব ধরনের পদ অলংকরণ করছেন এবং তার কাছে সকলের এক ধরনের বাধ্যবাধকতা তৈরি হচ্ছে। ফলে ৭০ অনুচ্ছেদ শুধুমাত্র ফ্লোর ক্রসিং বন্ধ করেছে তা না, বরং সবকিছুই প্রধানমন্ত্রীর হাতে নিয়ে চলে এসেছে।

আমি মনে করি ফ্লোর ক্রসিং বন্ধ রাখার একটি ব্যবস্থা থাকবে তবে, তা শুধুমাত্র নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে। কারণ, বাংলাদেশের মতো দেশের ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা নিয়ে এক ধরনের সমস্যা রয়েছে। আমরা যদি কয়েক দশক সুষ্ঠু গণতন্ত্রের চর্চা করতে পারি তাহলে হয়তো নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে ফ্লোর ক্রসিং বন্ধ রাখার এই প্রয়োজনীয়তা আর থাকবে না।

৭০ অনুচ্ছেদকে কিছু কিছু সংশোধনের মাধ্যমে এমন জায়গায় নিয়ে আসতে হবে যেন একজন সংসদ সদস্যকে জনগণের ম্যান্ডেটের জায়গা থেকে সরিয়ে নিয়ে না আসে। কারণ আমাদের মনে রাখতে হবে, একজন সংসদ সদস্য তার এলাকার মানুষকে রিপ্রেজেন্ট করেন, তার কনস্টিটিউন্সিকে রিপ্রেজেন্ট করেন। দল তাকে নমিনেশন দেয়, কিন্তু তাকে জিতিয়ে দেয় না। তাকে জিতিয়ে দেয় বা প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত করে জনগণ।

কালবেলা: সংবিধান সংস্কারে আপনারা কোন কোন বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন?

ড. আলী রীয়াজ: সংবিধান সংস্কারে প্রথম এবং প্রধান যে বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে তা হলো ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ বন্ধ করতে হবে। অংশীজনরা বলেছেন, জনগণ মতামত দিয়েছে এবং আমরাও বিবেচনা করেছি যে, ক্ষমতার এক কেন্দ্রীকরণ বন্ধ করাই সংবিধান সংস্কারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য। প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকার ব্যবস্থাতেও ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণে আমাদের অভিজ্ঞতা ভয়াবহ। আমরা যদি ১৯৯১ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত দেখি, তাহলে দেখব, এই পুরো সময়টাকে বড় স্কেলে ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ হয়েছে। আর ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর এর অপব্যবহারটা অন্য মাত্রায় চলে গেছে।

শেখ হাসিনার সর্বশেষ ১৬ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশের মানুষ যে দুঃসহ সময় অতিক্রম করেছে তার এক নম্বর কারণ হলো ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ। দ্বিতীয় কারণটি হল, জবাবদিহিতা না থাকা। শুধু প্রধানমন্ত্রীর নয়, মন্ত্রী, এমপি এবং রাষ্ট্রের ক্ষমতা কাঠামোর যেকোনো শাখায় বসে থাকা সকলের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। আর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হলে প্রথমে দেশের বিচার বিভাগকে শক্তিশালী করতে হবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরি করতে হবে একেবারে গ্রাম পর্যায় থেকে। সংবিধান সংস্কারে আমাদের দ্বিতীয় প্রায়োরিটি হলো ক্ষমতা কাঠামোয় জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ।

কালবেলা: সংবিধান সংস্কারের জন্য আপনারা যে প্রস্তাবগুলো করবেন সেগুলো বাস্তবায়ন করবে রাজনৈতিক সরকার। তাদের প্রতি আপনার আহ্বান কি থাকবে?

ড. আলী রীয়াজ: প্রথমত, সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবগুলো কিভাবে বাস্তবায়িত হবে তা আমরা এখনও জানি না। আমরা সুপারিশগুলো অন্তবর্তী সরকারের কাছে পেশ করেছি। সরকার রাজনৈতিক দলগুলোসহ অন্যান্য স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে আলাপ করবেন এবং এর মাধ্যমে বাস্তবায়নের একটি পথরেখা তৈরি করবেন। ব্যক্তিগতভাবে আমার ধারণা, ঐকমত্য তৈরির একটি কাঠামো যেমন দরকার তেমনি একটি দলিলও দরকার যে কোথায় কোথায় আমরা একমত হলাম।

আমরা সংবিধান সংস্কারের সুপারিশগুলো তৈরির ক্ষেত্রে এই ঐক্যমত্য তৈরির চেষ্টাই করেছি। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে প্রস্তাব নিয়েছি, সুশীল সমাজের থেকে প্রস্তাব নিয়েছি, জনগণের মতামত নিয়েছি। এই সকল প্রস্তাব ও মতামত পর্যালোচনা করে এবং আমাদের কাজের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে একটি সুপারিশ মালা তৈরি করেছি। রাজনৈতিক দলের প্রতি এখন আমার একটাই আহ্বান, আপনারা যেন একটু ভালো করে খেয়াল করে দেখেন যে, কোন কোন জায়গায় আপনারা একমত হতে পারেন।

রাজনৈতিক দলগুলো সকলে আলাদা আলাদা মতামত দিয়েছেন। রাজনৈতিক দল গুলোই তো সকল মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেনা। দলের বাইরে অন্যান্য সংগঠন, সাধারণ নাগরিক তাদেরও তো মতামত রয়েছে। সকলের মতামত তো এক হবেনা। রাজনীতি শেষ পর্যন্ত হলো আর্ট অব কম্প্রোমাইজ। তাহলে আসেন, ওই মানসিকতা থেকে আমরা দেশের জন্য এবং জাতির জন্য কিছুটা আপোষ করি।

শ্রুতিলিখন: মুজাহিদুল ইসলাম

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ছাত্রশিবিরের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে কি ছাত্রলীগ?

মালয়েশিয়ায় জুনিয়র টাইগারদের সংবর্ধনা

ঢাকা বিমানবন্দরে ৩১ বোতল বিদেশি মদ উদ্ধার

রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানে বাংলাদেশকে সহায়তা করবে ইউএনএইচসিআর

সিএসইর নতুন লেনদেনের সময়সূচি প্রত্যাহারের দাবি ডিবিএর

বিজেসির নতুন সদস্য সচিব আরটিভির হেড অব নিউজ ইলিয়াস হোসেন

সাতছড়ি উদ্যানে ভালুক, জনসাধারণের চলাচলে বন বিভাগের সতর্কতা

মালয়েশিয়ায় ৭ দিনে ১০ হাজার পাসপোর্ট বিতরণ

সাতক্ষীরায় অস্ত্র ও ককটেলসহ দুই সন্ত্রাসী আটক

যৌতুক না পেয়ে শ্যালকের বউ নিয়ে গেল দুলাভাই

১০

ঢাবি এলাকার গাছে ঝুলতে থাকা লাশের পরিচয় মিলেছে

১১

ইরানে আবারও বিমান বিধ্বস্ত

১২

নীতিবহির্ভূতভাবে দীর্ঘদিন পদ দখল / ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে এনইউবিটি থেকে জহির উদ্দিনের পদত্যাগ

১৩

বগুড়ায় আ.লীগ নেতা রানা কারাগারে

১৪

পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফেরা হলো না দুই কলেজ শিক্ষার্থীর

১৫

আবাসন পরিদপ্তরের উচ্চমান সহকারী তৈয়বুর কারাগারে

১৬

অমর একুশে উদযাপন উপলক্ষে ঢাবিতে প্রস্তুতি সভা

১৭

পিলখানা হত্যাকাণ্ড / আরও ১৭৮ জোয়ানের জামিননামা দাখিল, যাচ্ছে কারাগারে

১৮

জাতিসংঘের মহাসচিবের সঙ্গে ড. ইউনূসের সাক্ষাৎ

১৯

জলবায়ু ন্যায্যতার জন্য সম্মিলিত উদ্যোগের আহ্বান পরিবেশ উপদেষ্টার

২০
X