গ্রামীণ ব্যাংক শুধু প্রান্তিক পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে নিয়েই কাজ করে না, বরং অবহেলিত বা বঞ্চিত নারী-পুরুষের স্বপ্নপূরণে কাজ করে। দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে গ্রামীণ ব্যাংকের ভূমিকা অতুলনীয়। এই ব্যাংকটি গত ৪০ বছর প্রান্তিক অঞ্চলের হত-দরিদ্র মানুষের সৃষ্টিশীল ধারণাগুলোকে বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখছে। কালবেলার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন গ্রামীণ ব্যাংকের নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান এবং পরিচালক ও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল হান্নান চৌধুরী। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন কালবেলার নিজস্ব প্রতিবেদক এ জেড ভূঁইয়া আনাস।
কালবেলা: বিগত সরকারের সময়ে গ্রামীণ ব্যাংক কী ধরনের সমস্যায় পড়েছিল?
অধ্যাপক আবদুল হান্নান চৌধুরী: আপনারা জানেন গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মপদ্ধতি অন্য ধরনের ব্যাংকের তুলনায় ভিন্নতর। বিগত সরকারের এই ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ড. ইউনূসের প্রতি ক্ষোভের কারণে এটির স্বাভাবিক কাজে বাধা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু ব্যাংকটির লোন দেওয়ার প্রক্রিয়া ভিন্ন হওয়ায় এটি থেকে অর্থ আত্মসাতের পরিকল্পনা থাকার সত্ত্বেও উল্লেখযোগ্য ক্ষতি করতে পারেনি। সরকারের সর্বোচ্চ জায়গা থেকে এই ব্যাংকটির ক্ষতিসাধন করার চেষ্টা করা হয়েছিল। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ জায়গা থেকে এখানে কিছু লোককে দৈনিন্দিন কাজে হস্তক্ষেপের জন্য প্রেরণ করা হয়েছিল। যারা এখানে রীতিমতো অফিস করত। তাদের দিয়ে গবেষণা এবং উন্নয়ন উইং নামে একটি বিভাগ তৈরির মাধ্যমে নানা ধরনের অর্থনৈতিক সুবিধা অর্জন করতে চেয়েছিলো। কমপক্ষে চারজন ব্যক্তি ৪ লক্ষাধিক টাকা করে মাসিক বেতন নিয়েছিল এবং একটি আইনি পরামর্শককে প্রতি মাসে ১২ লাক্ষাধিক টাকা করে মাসিক কনাসলটেশন ফি নিয়েছিল। তারা অর্থ আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে কয়েকটি প্রজেক্ট হাতে নিয়েছিল। কিন্তু তাদের সেই উদ্দেশ্য সফল হয়নি। ইতোমধ্যে সরকার পরিবর্তন হয়ে গেছে।
কালবেলা: তারা কী ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করেছিল?
অধ্যাপক আবদুল হান্নান চৌধুরী: তাদের মূল লক্ষ্য ছিল ব্যাংক থেকে কীভাবে অর্থ লুট করা যায়। যেমন- দুজন টিভি সাংবাদিক ৫০ লাখ টাকা তুলে নিয়েছে। এক্ষেত্রে তারা ব্যাংকটির জন্য একটি ভিডিও বিজ্ঞাপন তৈরির কথা উল্লেখ করেছে। যদিও এই ধরনের কোনো ভিডিও বিজ্ঞাপন তারা ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে সরবরাহ করেনি। পরবর্তী বোর্ড মিটিংয়ে তাদের একটি বড় বাজেট পাশ করার কথা ছিল। কিন্তু সেটি পরবর্তীতে পাস হয়নি। সরকার পরিবর্তনের পর অনুষ্ঠিত বোর্ড মিটিংয়ে ওই প্রস্তাটি গৃহীত হয়নি। তারা মূলত ছোটখাটো খরচাদির বিল দৈনন্দিন পাস করিয়ে নিত। এই ব্যাংকটির পরিধি তুলনামূলকভাবে অনেক বড় হওয়ায় তারা যা নিয়েছে তাতে ব্যাংকটি সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। দেশের অন্য ব্যাংক তথা ব্যাংকিং খাত যেভাবে সামগ্রিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গ্রামীণ ব্যাংককেও সেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা তাদের ছিল। কিন্তু তারা সেটা করতে সক্ষম হতে পারেনি শুধু সরকার পরিবর্তনের কারণে। গ্রামীণ ব্যাংক যেহেতু প্রচলিত ব্যাংকের চেয়ে ব্যতিক্রম, এ জন্য নামে বেনামে ঋণ নেওয়ার সুযোগ তারা তৈরি করতে পারেনি। গ্রামীণ ব্যাংকের বড় ধরনের ঋণ দেওয়ার প্রচলন নেই এবং এটা বৈধও নয়। তাই তারা খুব একটি সুবিধা করতে পারেনি।
কালবেলা: আগের পর্ষদ গ্রামীণ ব্যাংকের অর্থ লোপাটে সফল না হওয়ার কারণ কী?
অধ্যাপক আবদুল হান্নান চৌধুরী: মূলত গ্রামীণ ব্যাংকের অর্থগুলো ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে এর ঋণগ্রহীতাদের হাতে থাকে। এ ছাড়া উদ্বৃত্ত লভ্যাংশ সরকারের ট্রেজারিসহ অন্য ব্যাংকে জমা থাকে। ক্ষুদ্র ঋণের একটি অংশ সপ্তাহে সপ্তাহে দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের শাখাগুলোতে জমা হয়। আবার সপ্তাহের ব্যবধানে ওই অর্থ পুনঃবিনিয়োগও হয়ে যায়। অর্থাৎ অর্থগুলো ব্যাংকের জমা হওয়ার সপ্তাহ খানের মধ্যে আবার মানুষের হাতে চলে যায়। এই ব্যাংকের বিনিয়োগগুলোতে হুট করে কেউ হাত দিতে পারে না। এই কারণে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে তারা অর্থ লুটপাটে সুবিধা করতে পারেনি। তবে তারা গ্রামীণ ব্যাংকের একটি ফ্লোর দখল করে ব্যাংকের দৈনিন্দিন কেনাকাটা, হাসপাতাল নির্মাণের উদ্দেশ্যে কিছু যন্ত্রপাতি এবং এসি কিনে অর্থ খরচ করে। তবে এসব অর্থের পরিমাণ অন্যান্য ব্যাংকে যে ধরনের লুটপাট হয়েছে সে রকম নয়। আমরা এখন পর্যন্ত কী ধরনের অনিয়ম হয়েছে সেটা বের করতে কাজ করছি।
কালবেলা: দেশের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে গ্রামীণ ব্যাংকের অবদান কতটা?
অধ্যাপক আবদুল হান্নান চৌধুরী: বাংলাদেশের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে গরিব এবং বঞ্চিত মানুষকে অর্থায়নের ক্ষেত্রে গ্রামীণ ব্যাংক অনেক বড় অবদান রাখছে। এই ব্যাংকের ঋণ নিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ খামার, মৎস্য চাষ, কৃষি ও গবাদিপশু পালনসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ করছে। ছোট ছোট গ্রাহক তাদের নিজস্ব প্রতিভা ব্যবহার করে দেশের কৃষি খাতে বড় ধরনের অবদান রাখছে। এটার প্রভাব বহুমাত্রিক। গ্রামীণ ব্যাংক শুধু নারী উন্নয়ন বা জাতি গঠন ও আর্থিক উন্নয়নে কাজ করে না, দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে যে ধরনের অবদান রাখছে তা হয়তো অনেকেই বুঝতে পারেন না। বস্তুত সারা বিশ্বের উন্নত জাতিগুলো ভালোভাবেই তা অনুধাবন করছে। গ্রামীণ ব্যাংক প্রান্তিক অঞ্চলের গরিব মানুষের সৃষ্টিশীল ধারনাগুলো বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখছে।
কালবেলা: গ্রামীণ ব্যাংকের মূল মালিকানা আসলে কাদের? অর্থাৎ এই ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডার কারা?
অধ্যাপক আবদুল হান্নান চৌধুরী: গ্রামীণ ব্যাংকের বেশিরভাগ মালিকানায় দেশের গরিব মানুষ। মূলত ব্যাংকটির এক কোটি ছয় লাখ সদস্য। গ্রামীণ ব্যাংক যেই লাভ করে তার একটি বড় অংশ এসব গরিবদের হাতে যায়। লভ্যাংশের টাকা দিয়েই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী পুনঃবিনিয়োগ করে তারা অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী হচ্ছে। এই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েই কোটি কোটি মানুষ অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল হচ্ছে, যা দারিদ্র্য বিমোচনের অন্যতম সহায়ক হিসেবে বিবেচিত। এছাড়াও ঋণগ্রহীতারা তাদের সন্তানদের শিক্ষা খাতে, মেয়েদের বিয়ের জন্যসহ অন্যান্য খাতে আমানতও রাখছে। এসব আমানত ব্যাংক থেকে পুনঃবিনিয়োগ হয়। আবার এসব অর্থ একত্রে জমা হলে তারাও উপকৃত হয়। এই ব্যাংকটির মডেল অনেকেই বুঝতে পারে না। অথচ এটি বর্তমানে একটি বৃহৎ পরিসরের ব্যাংক, যার সর্বোচ্চ গ্রহীতা। এই ব্যাংক এত বড় হতে পারত না যদি এটি সর্বজনগৃহীত না হতো।
কালবেলা: বিশ্বে ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের অবদান কতটা?
অধ্যাপক আবদুল হান্নান চৌধুরী: অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শুধু আমাদের দেশেই নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্য ক্ষুদ্র ঋণের ধারণার ব্যাপক প্রসার ঘটান। এই ব্যাংকটি একটি নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশকে পরিচয় করে দিয়েছে। বর্তমানে শতাধিক দেশে এই ব্যাংকের মডেলে ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। বিশ্ববাসী দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য একটি পরীক্ষিত মডেল পেয়েছে। এই ব্যাংকটির অবদান বিশ্ব অর্থনীতিতে গরিবের সমৃদ্ধ লাভের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
কালবেলা: সমাজে গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে অনেক নেতিবাচক কথাবার্তা রয়েছে। এগুলো সম্পর্কে কী বলবেন?
অধ্যাপক আবদুল হান্নান চৌধুরী: গ্রামীণ ব্যাংক দেশের অসচ্ছল জনগোষ্ঠীর আর্থিক উন্নয়ন স্বল্প স্বল্প বিনিয়োগের সুযোগ করে দেয়। অনেক সময় দেখা যায়, বন্যা, খরা কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রজেক্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক্ষেত্রে গ্রামীণ ব্যাংক তাদেরকে পুনঃবিনিয়োগের সুযোগ করে দিয়ে অর্থনৈতিক সক্ষমতা ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করে। তারপরও যদি কেউ ঋণ পরিষদের ব্যর্থ হয় তাহলে তাদের ঋণ মওকুফ করা হয়। গ্রামীণ ব্যাংকের এ ধরনের ঋণ মওকুফের উদাহরণ অনেক। এই পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংক গরিব গ্রাহকদের প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা ঋণ মওকুফ করেছে। তবে ঋণ দেওয়ার পর ওই ঋণ আদায় গ্রাহকের ওপর এক ধরনের চাপ রাখতে হয়। তা না হলে গ্রহীতাদের ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে গড়িমসি বা হেঁয়ালি করার প্রবণতা তৈরি হতে পারে। ঋণ মওকুফ করা হয় এই ব্যাংকটির সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে। অনেকেই ধারণা থেকে ভুল ব্যাখ্যা করে থাকেন।
কালবেলা: দেশে গ্রামীণ ব্যাংকের ভিত্তি কতটা মজবুত?
অধ্যাপক আবদুল হান্নান চৌধুরী: বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত এত বেশি শাখা কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নেই। গ্রামীণ ব্যাংক ২৫০০ শাখা নিয়ে কাজ করে। আমাদের শাখাগুলো হয়তো ছোট। খুব বেশি ডেকোরেশনও করা নেই। একটা শাখায় হয়তো ৫-৬ বা ৭-৮ জন লোক থাকে। এদের মধ্যে বেশিরভাগ কর্মী অফিসে বসে থাকেন না। তারা গ্রামে গ্রামে ঘুরে মানুষের কাছে ঋণ পৌঁছে দেন আবার সেসব ঋণ আদায় কাজ করেন। আমাদের এত বড় ব্রাঞ্চের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু আমাদের কার্যক্রম অনেক বেশি। আমাদের ২৩ থেকে ২৪ হাজার কর্মকর্তা কর্মচারী।
কালবেলা: সম্প্রতি গ্রামীণ ব্যাংকের করমুক্তি নিয়ে নানান মহলে আলোচনা-সমালোচনা চলছে, এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
অধ্যাপক আবদুল হান্নান চৌধুরী: বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক যে, অনেকেই এই বিষয়টি আংশিকভাবে জেনেই নানান মন্তব্য করছে। মূলত রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষুদ্র ঋণের যেকোনো প্রতিষ্ঠানকে সবসময়ই কর আওতামুক্ত রাখা হয়। গ্রামীণ ব্যাংককেও ২০২০ সাল পর্যন্ত কর দিতে হয়নি। সরকার ২০২০ সালে অনেকটা পূর্বের প্রচলিত নিয়মভঙ্গ করেই এই ব্যাংকটির ওপর কর আরোপ করে দেয়। অথচ এই ব্যাংকটিকে পূর্বে কখনই তা দিতে হতো না। এই ব্যাংকটি ভ্যাটসহ সরকারকে তার অধনস্তদের আয়ের উৎস কর সবসময়েই দিয়ে যাচ্ছে। এই ব্যাংকটি বাংলাদেশে প্রায় ২৪ হাজার লোকের কর্মসংস্থান করে কোটি কোটি মানুষের উপকার করে যাচ্ছে। এমনকি এর উদ্বৃত্ত আয় পুনরায় বিনিয়োগের মাধ্যমে অগণিত মানুষের পাশে সবসময় রয়েছে এবং ভবিষ্যতেও থাকেবে।
মন্তব্য করুন