ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক
প্রকাশ : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৫৬ এএম
আপডেট : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৪:২২ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
কালবেলা বিশেষ সাক্ষাৎকার

রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি থেকে ব্যবসায়ীদের দূরে রাখতে হবে

গবেষণা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র‌্যাপিড) চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক। সৌজন্য ছবি
গবেষণা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র‌্যাপিড) চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক। সৌজন্য ছবি

ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক গবেষণা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র‌্যাপিড) চেয়ারম্যান। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, উন্নয়ন ও পাবলিক পলিসি ইস্যুতে নেতৃত্ব প্রদানে অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। তিনি বিশ্বের বহু দেশের (সাব-সাহারান আফ্রিকান, দক্ষিণ এশীয়, ক্যারিবিয়ান ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত) নীতি গবেষণার সঙ্গে সম্পৃক্ত। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) একজন পরিচালক এবং পিআরআইর ত্রৈমাসিক প্রকাশনা পলিসি ইনসাইটসের প্রধান সম্পাদক তিনি। ২০০৭-২০১৭ সময়ে তিনি যুক্তরাজ্যের কমনওয়েলথ সেক্রেটারিয়েটের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নীতির প্রধানসহ বেশকিছু পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সাসেক্স ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ফ্যাকাল্টি সদস্য ছিলেন তিনি।

১৯৯৫-১৯৯৭ সালে আব্দুর রাজ্জাক সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগে (সিপিডি) কাজ করেন

কালবেলা : রক্তক্ষয়ী একটি গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশের দায়িত্ব এখন অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে। নতুন সরকারের কাছে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজ নিয়ে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। এই পরিস্থিতিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক : গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে একটি পরিবর্তিত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যেসব জায়গায় আগে আমরা সংস্কার করতে পারিনি। আশা করছি, এখন সেই সংস্কারগুলো করতে পারব। দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর যদি চতুর্মুখী চাপ না থাকত, তাহলে অনেক সংস্কার কাজ সহজ হতো। এখন এসব কাজ অনেক কঠিন মনে হচ্ছে। কারণ সামষ্টিক অর্থনীতি রয়েছে চাপের মুখে। আমরা বড় ধরনের মূল্যস্ফীতির চাপের মধ্যে রয়েছি। দুই বছর ধরে দেশে ১০ শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। ফলে মানুষের ক্রয় ক্ষমতার ওপর মাত্রাতিরিক্ত চাপ পড়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অনেক কমে গেছে। রিজার্ভ পরিস্থিতি দুর্বল হওয়ায় আমাদের ব্যালান্স অব পেমেন্টে সমস্যা হচ্ছে। যতটুকু আমদানি করা প্রয়োজন আমরা তা করতে পারছি না। ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন।

সামষ্টিক অর্থনীতি চাপের মধ্যে থাকায় এই সরকারের কাছে যে সংস্কার আশা করা হচ্ছে, তা বেশ কঠিন হবে। তবে সব থেকে আশার কথা হলো, অন্তর্বর্তী সরকারের যে উপদেষ্টারা রয়েছেন, তারা সবাই এসব বিষয়ে ওয়াকিবহাল। তাদের সততা, প্রজ্ঞা ও মেধা নিয়ে কারও প্রশ্ন নেই। এর চেয়েও বড় কথা হলো, দেশের সর্বস্তরের মানুষ এই সরকারকে সমর্থন করেছে। ফলে তাদের জন্য অনেক কাজ করা বেশ সহজ হবে।

কালবেলা : দেশের অর্থনীতি আজকের এই পরিস্থিতিতে পৌঁছল কেন?

ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক : আমাদের অর্থনীতির ওপর যে চাপ বা এখন যে অবস্থা, তার পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ সবকিছুকে দলীয়করণ; দীর্ঘদিন ধরে কোনো কিছুর সংস্কার না করা। প্রতিষ্ঠানগুলোয় দলীয়করণের মাত্রা এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হতো না; অর্থনৈতিক মৌলিক বিষয়গুলোও কম্প্রোমাইজ করা হয়েছে। যেমন—ব্যাংকিং খাতে ব্যাপকভাবে লুটতরাজ করা হয়েছে। ব্যাংকিং খাতের বিশৃঙ্খলা ছিল অনেকদিন ধরে এবং এর সংস্কার করা হয়নি।

গণতান্ত্রিক পরিবেশ এবং জবাবদিহির সংকট বিশৃঙ্খলাকে আরও উসকে দিয়েছিল। সবাই মনে করেছিলেন, একদলীয় সরকারের অধীনে থেকে এবং কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে তারা পার পেয়ে যাবেন। ফলে এই চাপগুলো দীর্ঘদিন ধরে তৈরি হয়েছে। আমরা জানি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়ও কিছু সমস্যা থাকে। কিন্তু সেখানে এক ধরনের জবাবদিহি থাকে এবং একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে আবার নির্বাচনে যেতে হয়। তাই সরকার কিছুটা হলেও সুশাসনের দিকে যেতে বাধ্য থাকে। গণতন্ত্র থাকলে লাগামহীনভাবে দুর্নীতি করা যায় না।

গত ১৫ বছরে যেহেতু গণতন্ত্র ছিল না, তাই লুটতরাজেও কোনো লাগাম ছিল না। এর ফলে দেশের অর্থনীতি আজ এ অবস্থায় এসে ঠেকেছে।

কালবেলা : অর্থনীতির আজকের এ অবস্থার জন্য কাঠামোগত বা নীতিগত দুর্বলতা ছিল কি?

ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক : কর্তৃত্ববাদী সরকার রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করে ফেলে। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগুলো দুর্বল করে ফেলা হলে সেখানে আর নিয়মনীতি মানার বাধ্যবাধকতা থাকে না। ফলে যার হাতে ক্ষমতা থাকে, সে শোষণ করতে পারে। এ কারণে সমাজে বৈষম্য ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। ছাত্র-জনতার এই গণঅভ্যুত্থান শিক্ষার্থীদের যে আন্দোলনের মাধ্যমে সূচিত হয়েছে, সেই আন্দোলনের নামও আমরা দেখেছি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। অর্থাৎ বৈষম্য শব্দটি এখানে গুরুত্বপূর্ণ অর্থ বহন করছে। সমাজে বৈষম্য প্রকট রূপ লাভ করেছে। এই বৈষম্য শুরু হয়েছিল নীতি-আইন কাজ না করার কারণে।

পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় অর্থনৈতিক বৈষম্য তৈরি হতে পারে। তবে এই বৈষম্য রোধ করতে হলে যে নীতি গ্রহণ করা প্রয়োজন, বিগত সরকারের আমলে সেগুলো নেওয়া হয়নি। ফলে সরকারের নীতিগত অবস্থান বৈষম্যকে উসকে দিয়েছে। আর এর সঙ্গে যোগ হয়েছে অবাধ দুর্নীতি। সরকারের প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় দেখানো হয়েছে, দিনের পর দিন প্রকল্প ধরে রাখা হয়েছে এবং প্রকল্পগুলোকে অতি মূল্যায়িত করা হয়েছে। কোনো জবাবদিহি ছিল না এবং যেনতেনভাবে অনেক প্রকল্প শেষ করা হয়েছে। আর এসব প্রকল্প থেকে অবৈধ সুবিধা নিয়েছে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা ব্যক্তিরা।

দেশের ব্যাংকিং খাতে কী হয়েছে, সেটা আমরা সবাই জানি। শুধু মালিকানা পরিবর্তন নয়; বরং রীতিমতো তহবিল তছরুপ করা হয়েছে। ব্যাংকিং খাতে কোনো নিয়মশৃঙ্খলা বজায় ছিল না। দেশের বিচার ব্যবস্থায় কী হয়েছে, সেটাও আমাদের সামনে স্পষ্ট। দেশের শাসন ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা, আর্থিক ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা, বিচার ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা অর্থাৎ মানুষের আশ্রয়স্থল বলে আর কোনোকিছু অবশিষ্ট ছিল না। সবকিছু মিলে অর্থনীতিতে বড় মাত্রায় কাঠামোগত সমস্যা দেখেছি। আমাদের সামাজিক জীবনেও তার প্রতিফলন ঘটেছে।

কালবেলা : দেশের অর্থনীতি রক্ষায় অন্তর্বর্তী সরকারের কোন কাজগুলোয় প্রাধান্য দেওয়া উচিত?

ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক : সরকারের প্রথম অগ্রাধিকার হওয়া উচিত সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করা। এটা করতে হয়তো সরকারের সময় লাগবে, তবে প্রথম থেকেই অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে মনোনিবেশ করতে হবে। সামষ্টিক অর্থনীতির দুর্বলতাগুলো দ্রুত কাটিয়ে ওঠা না গেলে অন্য সংস্কার করা দুরূহ হয়ে দাঁড়াবে। সরকার যদি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও রিজার্ভ পরিস্থিতি উন্নতি করতে না পারে, তাহলে অর্থনীতিতে আরও নতুন চাপ তৈরি হবে। এরপর প্রয়োজন রাজনীতির সংস্কার। আমরা যদি অর্থনৈতিক চাপে না থাকতাম, তাহলে রাজনীতির সংস্কারকেই এক নম্বর অগ্রাধিকারে রাখতাম। সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার পাশাপাশি রাজনৈতিক সংস্কারও করতে হবে।

দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা কেমন হবে, নির্বাচনে জনগণের মতামত প্রতিফলিত হবে কি না—এ বিষয়গুলো পরিষ্কার হতে হবে। নির্বাচনে সবাই অংশগ্রহণ করতে পারবে, তা নিশ্চিত করতে হবে। একটি সঠিক ভোটার তালিকা তৈরি করতে হবে। নির্বাচনে কারা অংশগ্রহণ করবে, সেই বিষয়টিতেও নজর দিতে হবে। যারা দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতির সঙ্গে থেকেছে, নিজেরা দুর্নীতি করেছে এবং অন্যের দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছে, তারা কি নির্বাচনে প্রার্থী হবে? রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সেখানে কী ভূমিকা পালন করবে—এগুলো চিন্তা করতে হবে।

আরেকটি বিষয় না বললেই নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রম পরিচালনার অর্থের জোগান কোথা থেকে আসে? কারা সেই অর্থের জোগান দেয়? এ বিষয়ে একটি আইন করা প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলের কার্য পরিচালনায় ব্যবহৃত অর্থের স্বচ্ছতা দেখতে চাই। তারা যদি কোটারি স্বার্থগোষ্ঠীর কাছ থেকে অর্থ নিয়ে আসে, তাহলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তারা ক্ষমতায় এসে কোটারি গ্রুপের স্বার্থ বাস্তবায়নের চেষ্টা করবে। আমরা এই সিস্টেম থেকে বের হতে চাই। অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম লক্ষ্য হবে রাজনৈতিক সংস্কারের কাঠামো ঠিক করে রাজনীতিকে সঠিক নিয়মনীতির আওতায় নিয়ে আসা।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দেশের মানুষের কাছে তার একটি সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। ড. ইউনূসের উচিত দেশের সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিয়ে এই জটিল বিষয়ে আলোচনা করা। শুধু আইন নয়; বরং একটা ঐকমত্য তৈরি করে তাদের উদ্বুদ্ধ করা, যাতে এই নীতিগুলো তারা প্রতিপালন করেন। একই সঙ্গে আইনি কাঠামো সংস্কার করা, যাতে তারা এই নীতিগুলো প্রতিপালন করতে বাধ্য থাকেন।

সরকারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব থাকবে সমাজের মধ্যে গেড়ে বসা অর্থনৈতিক বৈষম্য কমানো। এই বৈষম্যের জন্য দেশ স্বাধীন হয়নি। স্বাধীনতার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল বৈষম্য দূর করা। অথচ স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও আমাদের ছাত্রসমাজকে আবার বৈষম্য দূর করার জন্য আন্দোলন করতে হয়েছে, রক্ত দিতে হয়েছে। আমরা আমাদের রাষ্ট্রের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছিলাম। কিছু মানুষের হাতে ধন-সম্পদ কুক্ষিগত হয়েছে, আর কিছু মানুষ জীবনযাত্রা নির্বাহ করতে পারছে না। এই বাংলাদেশ আমরা কেউ চাই না।

কালবেলা : অনেকে অভিযোগ করেন, রাজনীতিতে যখন থেকে ব্যবসায়ীদের প্রবেশ হলো, তখন থেকেই দেশের ব্যবসা এবং অর্থনীতির স্বাভাবিক অবস্থা বিনষ্ট হয়েছে। এ বিষয়ে আপনি কী মনে করেন?

ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক : আমি এ কথাটির সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। ব্যবসা-বাণিজ্যে রাজনীতিকরণ বাংলাদেশের জন্য এটি দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা তৈরি করেছে। বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের মধ্যেও আমরা রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি দেখেছি। ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। লেজুড়বৃত্তির কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যের নিয়মনীতিগুলো পরিপালন করা হয়নি। ব্যাংকগুলো নষ্ট হওয়ার প্রধান কারণ ছিল ব্যবসায়ীদের রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি। দেশের ব্যবসা খাত এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনায় দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে।

অনেক ব্যবসায়ী মনে করেছেন, ক্ষমতার কাছাকাছি থাকলে অর্থাৎ তোষণমূলক নীতি গ্রহণ করলে দ্রুত ও অধিক লাভবান হওয়া সম্ভব। তারা তোষণমূলক নীতিতেই বেশি লাভবান হয়েছেন। এরকম একটি পরিস্থিতি যদি তৈরি হয়, যেখানে সবাই খুব সহজে কীভাবে লাভবান হওয়া যাবে, কীভাবে রাষ্ট্রীয় মূলধন চুরি করা যাবে—সেটা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তাহলে সেখানে উৎপাদনশীল বিনিয়োগ হতে পারে না। বাংলাদেশে উৎপাদনশীল বিনিয়োগের থেকে অনুৎপাদনশীল বিনিয়োগ করে এবং চুরি-ডাকাতি করে বড়লোক হওয়ার সংখ্যা ব্যাপক বেড়েছে। এটা আমাদের অর্থনীতিতে বিরাট সমস্যা সৃষ্টি করেছে। তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়েছেন। সেই ঋণখেলাপির সংজ্ঞাও তারা বদলে ফেলেছেন। ফলে প্রকৃত অর্থে খারাপ ঋণের পরিমাণ কত, সেটা আমরা জানি না। কেউ বলছেন, এর পরিমাণ ২ লাখ কোটি টাকা; কেউ বলছেন ৪ লাখ কোটি টাকা। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে নিরাপদ করতে হলে রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি থেকে ব্যবসায়ীদের দূরে রাখতে হবে। না হলে আমরা একটি প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসার পরিবেশ তৈরি করতে পারব না; আমরা উৎপাদনমুখী বিনিয়োগ পাব না।

কালবেলা : গত ১৫ বছরে সরকার ব্যাপকভাবে দেশি-বিদেশি ঋণ নিয়েছে। বৈদেশিক ঋণের এই বোঝা অন্তর্বর্তী সরকার কীভাবে ম্যানেজ করবে?

ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক : বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য বিদেশি ঋণ নেওয়া খারাপ কিছু ছিল না। প্রথমত, আমরা যে সুদের হারে এবং যে শর্তে বিদেশি ঋণ পাই, সেটা আমাদের জন্য একটি ভালো দিক হতে পারত। কিন্তু সমস্যাটি হয়েছে, এই ঋণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে। আমাদের বিদেশি ঋণ ৩০ বিলিয়ন ডলার থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গেছে। এই ঋণের টাকা দিয়ে যত উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে, সেখান থেকে অর্ধেক অর্থ লুটপাট করা হয়েছে। এই টাকা ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারলে ব্যাপক ইতিবাচক ঘটনা ঘটত। কিন্তু লুটপাট ও পাচারের কারণে ঋণ আমাদের সুবিধা না দিয়ে, তা ঘাড়ে চেপে বসেছে।

খবরের কাগজে দেখেছি, বাংলাদেশে এক কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করতে যে খরচ হয়, তা পৃথিবীর মধ্যে সর্বোচ্চ। দেশে এমন অনেক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, যা কোনো কাজেই লাগেনি। এসব প্রকল্প কোনো ফিজিবিলিটি স্টাডি না করেই গ্রহণ করা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত, এসব ব্যাপারে একটি শ্বেতপত্র তৈরি করা। শ্বেতপত্র তৈরি হলে অন্তত জানতে পারব যে, কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে এবং এর থেকে আমরা কীভাবে বের হতে পারব। আমরা বিদেশি ঋণ ঠিকমতো ব্যয় করতে পারিনি। ফলে এই ঋণ বোঝা হয়ে জনগণের ঘাড়ে চাপবে।

অন্তর্বর্তী সরকার একটি কাজ করতে পারে—যেসব টাকা চুরি ও পাচার হয়েছে সেগুলো কীভাবে, কোথায় লেনদেন হয়েছে, সেটা বের করতে পারে। এটি করতে পারলে সরকার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দেনদরবার করতে পারবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো বাংলাদেশ থেকে যে টাকা পাচার হয়েছে, সেই টাকার অংশবিশেষ ফেরতও আনা সম্ভব হতে পারে। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইনকানুন রয়েছে। আমরা সেই আইনকানুনের সুবিধা নিতে পারি।

কালবেলা : সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বৈষম্য রোধে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। অন্তর্বর্তী সরকার এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে কি?

ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক : ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান হয়েছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে। তাই আমি অবশ্যই সামাজিক সুরক্ষা খাতকে অনেক ওপরে রাখব। সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সরকার অনেক কিছু করতে পারে। ২০১৫ সালে আওয়ামী লীগ সরকার জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা নীতি গ্রহণ করেছিল। প্রথমে তারা যেভাবে এটা প্রণয়ন করেছিল, তাতে মনে হচ্ছিল তাদের উদ্দেশ্য ভালো। সেখানে দুই ধরনের সংস্কারের কথা বলা হয়েছিল। একটি হলো, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার আর আরেকটি প্রোগ্রামগুলোর সংস্কার। কিন্তু আদতে সেই সংস্কার নিয়ে সরকার কাজ করেনি।

বিগত সরকার সামাজিক সুরক্ষা খাতে বড় মাত্রায় সোশ্যাল ইনজাস্টিস তৈরি করেছে। যত মানুষের এই সুবিধা পাওয়ার কথা ছিল, তাদের দেওয়া হয়নি। সমাজের বড় যে অংশের সরকারি সহায়তা প্রয়োজন ছিল, তারা পাননি। বিগত সরকার এমন একটি ব্যবস্থা তৈরি করেছে, যেখানে কিছু লোককে সরকারি সহায়তা দেওয়া হচ্ছে এবং ওই একই আর্থিক সক্ষমতার মানুষের বেশিরভাগকে সেই সহায়তা দিতে পারেনি। অন্যদিকে, যারা সরকারি সহায়তা পাওয়ার উপযুক্ত নন, তারা পাচ্ছেন। এ ছাড়া তথ্য-উপাত্তের ঘাটতি ব্যবহার করে সামাজিক সুরক্ষা খাতের ব্যয় ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশন সামাজিক নিরাপত্তা খাতে যুক্ত করে এর আকার বড় করে দেখানো হয়েছে। সঞ্চয়পত্রের সুদের একটি অংশকে এরই মধ্যে যোগ করা হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবকাঠামো প্রকল্পগুলোকে সামাজিক সুরক্ষা খাতে যোগ করা হয়েছে। এসব করে স্বাভাবিক সুরক্ষা ব্যয়কে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। দরিদ্রদের যে ভাতা দেওয়া হয়, তা বহু বছর বাড়ানো হয়নি। মূল্যস্ফীতির তুলনায় ভাতার পরিমাণ খুবই কম। এই ভাতার প্রকৃত মূল্য অনেক কমে এসেছে। ফলে সামাজিক ইনজাস্টিস তৈরি হয়েছে।

যেহেতু সরকার রাজস্ব বাড়াতে পারেনি, যেহেতু আমাদের ট্যাক্স জিডিপি রেশিও অনেক কম। তাই আমরা এ খাতে অতিরিক্ত বিনিয়োগ করতে পারব কি না সন্দেহ রয়েছে। সামাজিক সুরক্ষা খাতে বাংলাদেশকে অধিক পরিমাণ বিনিয়োগ করতে হবে। যদি আমরা সমাজের বৈষম্য কমিয়ে আনতে চাই, তাহলে অবশ্যই সামাজিক নিরাপত্তা খাতকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বিনিয়োগ অত্যন্ত জনপ্রিয় কাজ। আজ যদি বাংলাদেশের সব দরিদ্র জনগণকে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের মাধ্যমে আর্থিক সহযোগিতা দেওয়া যেত এবং বাংলাদেশের সব শিশুকে স্কুলে একবেলা খাওয়ানো যেত, তাহলে যে প্রভাব পড়ত, তা কল্পনাও করা যায় না। এটা দেশের মানুষের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় হবে। গণতন্ত্রে আমরা এটাই চাই। অথচ আমরা এমন একটি সমাজ তৈরি করেছি, যেখানে অল্প কিছু মানুষের হাতে দেশের সব সম্পদ কুক্ষিগত হচ্ছে। আমাদের এটা থেকে বের হতে হবে। এ খাতে গুরুত্ব দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার একটি কঠিন সিগন্যাল দিতে পারে। দেশের সংস্কার এখান থেকেই শুরু হতে পারে। দেশের মানুষের জন্য কিছু করার এখনই সঠিক সময়।

শ্রুতিলিখন: মুজাহিদুল ইসলাম

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মব জাস্টিসের বিরুদ্ধে জবিতে বিক্ষোভ

মারা গেছেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের বিমল

একাধিক জনবল নেবে সিটি ব্যাংক

সাগর-রুনি হত্যার বিচারের প্রাথমিক স্তর পরিষ্কার করা দরকার : দুদু

ঢাবির ফজলুল হক হলে পিটিয়ে হত্যা / জড়িতদের গ্রেপ্তার না করা পর্যন্ত ভিসির বাসভবনে অবস্থান  

সময় থাকতে হাসিনাকে ফেরত পাঠান, ভারতকে দুদু

গুলিতে পা হারানো ইমরানের চিকিৎসা অর্থাভাবে বন্ধ

ঢাবি-জাবিতে দুই খুন, যা বললেন ফারুকী 

নাটোরে শিশু হত্যা মামলায় ৩ জনের ৪৪ বছর কারাদণ্ড

ইরাকে তুর্কি বিমান হামলা, ২৪ স্থাপনা ধ্বংস

১০

দ্বিতীয় সেশনেও টাইগারদের দাপট

১১

ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অস্তিত্ব রক্ষায় ৮ দফা বাস্তবায়নের দাবি ঐক্য পরিষদের

১২

ভিসার মেয়াদ শেষ আজ, কী ঘটবে শেখ হাসিনার ভাগ্যে

১৩

লক্ষ্মীপুরে পিটিআই প্রশিক্ষকের অপসারণের দাবিতে বিক্ষোভ

১৪

সালমানকে নিয়ে যা বললেন শাবনূর

১৫

ট্রাম্পের তথ্য হ্যাক করে বাইডেনকে দিয়েছে ইরান!

১৬

শেষ ম্যাচে ৮ উইকেটের বড় জয় বাংলাদেশের

১৭

নামাজ পড়ে বাসায় যাওয়া হলো না পুলিশ সদস্য জহিরুলের

১৮

বিদেশি শিক্ষার্থী-কর্মীদের দুঃসংবাদ দিল কানাডা

১৯

পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় ঢাবি প্রশাসনের মামলা

২০
X