শৌর্য দীপ্ত
প্রকাশ : ৩১ মে ২০২৩, ০৭:৫৯ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

মানুষ মোস্তফা কামাল সৈয়দ

মানুষ মোস্তফা কামাল সৈয়দ

টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব মোস্তফা কামাল সৈয়দ পরিচত মুখ। তাকে পরিচিত করে লেখার কিছু নেই। এই লেখার শিরোনাম হওয়া উচিত ছিল আমার দেখা মোস্তফা কামাল সৈয়দ। কিন্তু আমার দেখা তিনি ছিলেন একজন পরিপূর্ণ মানুষ। আভিধানিক সংজ্ঞা অনুযায়ী মনুষ্যত্বের যতগুলো গুনাবলি থাকা দরকার তার কোনোটাই তার মধ্যে অনুপস্থিতি তো ছিলই না বরং তিনি মনুষ্যত্ববোধের নতুন কিছু সংজ্ঞা তৈরি করেছেন। যেগুলো এই লেখায় আপনারা পেয়ে যাবেন আশা করি।

মোস্তফা কামাল সৈয়দের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হঠাৎ নয়। দেখা হয়েছে কাজের মাধ্যমেই। এনটিভিতে কাজ পাওয়া কখনোই খুব সহজ ছিল না। গুণগতমান যাচাই-বাছাই ডিরেক্টরদের স্কিল বিবেচনায় কাজ বণ্টন করা হয়ে থাকে। এর আগে আমার রচনা ও পরিচালনায় রুবি রায় নামে একটি মাত্র নাটক এনটিভিতে প্রচার হয়েছিল।

পরিকল্পনা করলাম আগামী বছর মার্চ মাসে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আহমেদ ছফার বিখ্যাত উপন্যাস ‘ওঙ্কার’ নির্মাণ করব। পরিকল্পনা অনুযায়ী একটা প্রস্তাবনা এনটিভিতে জমা দিলাম। মিটিং করলাম আলম ভাইয়ের (খোরশেদ আলম) সঙ্গে। মোস্তফা কামাল সৈয়দ তখন আমেরিকায় ছিলেন। আলম ভাইয়ের সঙ্গে আলোচনা করে ওই নাটকের পাত্র-পাত্রী চূড়ান্ত করি। এই ওঙ্কার নির্মাণ করা ছিল নানান ঝক্কি ঝামেলার। কারণ এর আগে একবার এই কন্টেন্ট নিয়ে খণ্ড নাটক তৈরি হয়েছিলো। গুণী চলচ্চিত্রনির্মাতা শহীদুল ইসলাম খোকন এই গল্প নিয়ে ‘বাঙলা’ নামে চলচ্চিত্র বানিয়েছিলেন।

সমস্যা সমাধানের জন্য আমি আর মাহমুদ হাসান সিকদার (আমি আর মাহমুদ হাসান সিকদার যৌথভাবে নাটকটি তৈরি করেছিলাম)। নাটকটি নির্মাণ করে এনটিভিতে প্রিভিউয়ের জন্য জমা দেই। এরপর এক দিন আলম ভাই ফোন করে আমাকে বলেন কামাল ভাই আপনাকে দেখা করতে বলেছেন। মনে আমার তখন ভয়, আমাদের নাটকটি কি উনার পছন্দ হয়নি? দুরু দুরু বুকে ভয়ে ভয়ে ওনার রুমে আসি। কামাল ভাইয়ের সঙ্গে সেটাই আমার প্রথম দেখা। রুমে ঢোকার পর উনি বসতে বললেন। আপনি করে কথা বলার সময় আমি বললাম, আমি তো আপনার ছোটই হবো আমাকে আপনি তুমি করে বলতে পারেন। এরপর উনি কোনোদিনও আমাকে তুমি করে বলেননি। আমার জানামতে আমার চেয়েও বয়সে ছোট নির্মাতা এবং সহকর্মীদেরকেও তিনি কখনো তুমি করে কথা বলতেন না।

আমাকে বললেন আপনার কাছে কি নোট করার মতো কাগজ কলম কিছু আছে? আমি চুপ মেরে গেলাম। উনি একটা প্যাড আর কলম দিলেন। প্রায় মন্ত্রমুগ্ধের মতো এক ঘণ্টার বেশি সময় তার ছাত্র বনে গেলাম।

আহমদ ছফার এই গল্পটা ছিল প্রিয়োডিক্যাল। ১৯৬৯ সালের শেষ দিক থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধের আগের সময় পর্যন্ত এই নাটকের সময় কাল। গল্পের শুরতেই দেখা যায় একটা সরকারি অফিসে বসে নিজের কাছ করছেন ইন্তিখাব দিনার। রুমে আসে তার একজন কলিগ, অভিনেতা সুহৃদ জাহাঙ্গীর। দুজনে কথাবার্তা বলেন। নিয়ম অনুযায়ী সেই সময় অফিসের দুজনের ছবি টানানো থাকে। একজন হলেন পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা কায়েদ ই আজম মোহম্মদ আলী জিন্নাহ আর আরেকজন হলেন ইয়াহিয়া খান। ইয়াহিয়া খান ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের পদত্যাগের পর ক্ষমতা গ্রহণ করেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খান ছিলেন সেই সময়ে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রধান। অফিসের সেট বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য আমরা অনেক কষ্ট করে ওদের দুজনের পুরোনো দুটি ছবি জোগাড় করি। আমাদের নাটকের দৃশ্য শুরু হয় প্যান শট দিয়ে। প্রথমে কায়েদ ই আজম তারপর ইয়াহিয়া খানের ছবি থেকে ক্যামেরা প্যান করে এসে ইন্তিখাব দিনারের ওপর ফিক্সড হয়। ইন্তিখাব দিনার তখন অফিসের কাজ করছিলেন।

কামাল ভাইয়ের যুক্তি হচ্ছে গল্পের কারণে আপনারা প্রয়োজন অনুযায়ী সেট সাজাবেন। এরপর গল্প ও চরিত্র অনুযায়ী ফ্রেম ধরবেন। তাতে করে সেটের যে অংশ ক্যামেরায় আসবে তাই থাকবে। কায়েদ ই আজম আর ইয়াহিয়া খানের ছবিকে প্রাধান্য দেওয়া এই গল্পের মোটোর পরিপন্থি। অনেক ত্যাগ ও প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই স্বাধীনতা। ওই দৃশ্যের কারণে এই স্বাধীনতাকে খাটো করে দেখানো হয়।

আমরা জানি যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় মোস্তফা কামাল সৈয়দ পশ্চিম পাকিস্তানে চাকরি করতেন। এরপর স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হলে তিনি চাকরি ছেড়ে জীবনের মায়া ত্যাগ করে পাকিস্তানের দুর্গম সীমান্ত এলাকা পার হয়ে এ দেশে চলে আসেন। তার এই দেশপ্রেম অনুপ্রেরণামূলক।

এই রকম অনেকগুলো যুক্তিপূর্ণ সংশোধনের পর ওঙ্কার এনটিভিতে প্রচার হয়। কিন্তু এরপর আমার তৈরি অনেক নাটক কামাল স্যার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। রাগে, দুঃখে, অপমানে কামাল ভাইয়ের কাছে আসার পর তিনি নাটক প্রত্যাখ্যানের কারণগুলো সময় নিয়ে এমনভাবে বর্ণনা করতেন যে এরপর তার প্রতি কারো ক্ষোভ থাকত না, বরং ভালো শিক্ষা নিয়ে খুশিমনে ফিরে যেতে পারতেন।

তিনি নাটকের প্রতিটি সেক্টরের প্রতি সমান গুরুত্ব দিতেন। একবার বিখ্যাত নাট্যকার ও নির্মাতা ফেরদৌস হাসানের একটি গল্প কামাল ভাইয়ের কাছে জমা দেবার পুরো স্ক্রিপ্ট দেখতে চাইলেন। সেই স্ক্রিপ্ট দেখে তিনি নাটকটি বানানোর মৌখিক অনুমতি দিলেন। এক নাটকে অনেক বড় বড় আর্টিস্ট যেমন—নিশো, অর্পণা ঘোষ, ইমন, মৌসুমী হামিদ, আল মামুন. জয়শ্রী করদের নিয়ে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়শিয়ার লাঙ্কাউতে শুটিং করা বড় বাজেটের নাটকটি উনি প্রত্যাখ্যান করে দিলেন। কারণ সঠিক আলো, শব্দ ও রূপসজ্জার অভাব।

এখানে উল্লেখ্য যে, বিদেশে নির্মিত নাটকের ইউনিটে মেকআপ আর্টিস্ট লাইট, প্রডাকশন ও সাউন্ডের লোক নিয়ে যাবার অপশন কম থাকে বাজটের কারণে। এ ছাড়া ওনার সবচেয়ে বড় আপত্তির জায়গা এই নাটকটি কেন বাংলাদেশে শ্যুটিং করা হলো না। এই নাটকটি যদি এ দেশে শ্যুটিং করা হতো তাহলে অবশ্যই কিছু না কিছু পর্যটকদের নজরে পড়তো। যা আমাদের দেশের পর্যটন শিল্পের জন্য সহায়ক হতো।

জীনাত আপার সুবাদে এক সময় মোস্তাফা কামাল সৈয়দ ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক তৈরি হলো। জীনাত আপা প্রায়ই আমাদের বাসায় আসতেন। সারা দিন থেকে বিকেল বা সন্ধ্যায় ভাইকে নিয়ে বাসায় চলে যেতেন। আমার স্ত্রীর হাতের রান্না জীনাত আপা খুব পছন্দ করতেন। আমার স্ত্রীও কামাল ভাইয়ের জন্য বিভিন্ন আইটেমের রান্না করে পাঠিয়ে দিতেন। বগুড়া থেকে আনা এক ধরনের সন্দেশ কামাল ভাই খুব পছন্দ করতেন।

জীনাত আপা ও মোস্তাফা কামাল সৈয়দ ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথা একটা সময় গণমাধ্যমে জানাজানি হয়। এটা হবার পর আমি আর এনটিভিতে কোনো কাজ করতে পারি নাই। জীনাত আপা স্যারকে ভালো করেই জানতেন। কোনো সুপারিশে উনি কাজ করলে আমি এনটিভিতে মাসে মাসে একটা করে নাটক বানাতে পারতাম। একাধিক ধারাবাহিক নাটক তৈরি করতে পারতাম। এক দিন ক্ষোভে-দুঃখে আমি কামালভাইকে বলেছিলাম আপনাদের সঙ্গে আমার পারিবারিক সম্পর্কের কারণেই কি আপনি আমাকে কাজ দিচ্ছেন না? উনি এই বিষয়টাতে কিছুটা একমত হয়ে আমাকে ঠাট্টা করে বলেন, ‘অন্যের নাটক একশোর মধ্যে ৬০ পেলে নেওয়া হবে কিন্তু আপনাকে একশোর মধ্যে একশো বিশ পেতে হবে। যাতে করে অন্যেরা মনে করে আপনি যোগ্যতা দিয়ে এনটিভিতে কাজ করছেন, কারো সুপারিশে নয়।’

মোস্তাফা কামাল সৈয়দ ভাইয়ের একটা লেখার অংশ বিশেষ দিয়ে আমার লেখাটি শেষ করছি।

‘বিশেষ দিনগুলোকে স্মরণ করে নাটকের গল্প লেখা, নাটক নির্মাণের প্রয়াসগুলো আরও বাড়ানো দরকার। আমাদের জাতীয় জীবনে এর মূল্য অনস্বীকার্য। এর জন্য বিশেষ স্বীকৃতি থাকার জন্য সমবেত পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। মনে রাখতে হবে নিজেরাই নিজেদের জন্যে একত্রিত হয়ে সচেষ্ট হতে হবে।’

৩১ মে একটা বিশেষ দিন। মোস্তফা কামাল ভাইয়ের প্রয়াণ দিবস। এই বিশেষ দিনে মোস্তফা কামাল সৈয়দ ভাইয়ের ফেলে রাখা অসংখ্য সৃষ্টিশীল কাজ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আমরা কি কিছু করতে পারি না?

লেখক : শৌর্য দীপ্ত, নাট্যকার ও নির্মাতা

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কুড়িগ্রামে ব্রিজ ভেঙে দুর্ভোগে এলাকাবাসী

ভয়ংকর রাসেল ভাইপারকে পিটিয়ে মারলেন কৃষকরা

বিসিবির আপত্তি, ‘পাত্তা’ দিল না আইসিসি

গাজীপুরে প্লাস্টিকের গোডাউনে আগুন

যুগান্তকারী আবিষ্কার গুগল অ্যাস্ট্রা কী?

চিন্তা নেই, হারানো জিনিস খুঁজে পাবেন নিমিষেই

সুপারি গাছের খোলে তৈরি হচ্ছে নান্দনিক তৈজসপত্র

গরমে তরমুজের চাহিদা বেড়েছে দ্বিগুণ

আজ আ.লীগের কর্মসূচিতে যা থাকছে

বিশ্বকাপে মোস্তাফিজকে শুভকামনায় কী বলছে চেন্নাই

১০

পশ্চিমবঙ্গে বজ্রপাতে ১১ জনের মৃত্যু

১১

চেয়ারম্যানের নাম্বার ক্লোন করে টাকা দাবি

১২

আজ সুখবর পেতে পারেন যারা

১৩

যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছেছে শান্ত-তাসকিনরা

১৪

সাতসকালে সড়কে ঝরল ৫ প্রাণ

১৫

আম কুড়াতে গিয়ে বজ্রপাতে শিশুর মৃত্যু

১৬

গরমে অস্বস্তি, বৃষ্টি হতে পারে ঢাকায়

১৭

আজকের নামাজের সময়সূচি

১৮

ইতিহাসের এই দিনে আলোচিত যত ঘটনা

১৯

আজ যেসব অঞ্চলে বজ্রসহ বৃষ্টির সম্ভাবনা

২০
X