ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. শাহজাহান খান
প্রকাশ : ২৮ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:৫৭ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

স্বৈরাচারের বিদায় হলেও তাদের দানবীয় দুর্নীতির কলঙ্ক থেকে মুক্তি কীভাবে?

ছবি : সংগৃহীত।
ছবি : সংগৃহীত।

পতিত স্বৈরাচার দাঁড়িয়েছিল দানবীয় সর্বগ্রাসী দুর্নীতির অবাধ চর্চার উপরল। বিগত সরকারের সঙ্গে যাদের সম্পর্ক ছিল, তারা রাজনীতি বা সরকারি চাকরির মাধ্যমে রাজপুত্রের মতো সব আইনের ঊর্ধ্বে থেকে প্রায় সবাই ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির মহানায়ক ছিলেন। দুর্নীতি স্বৈরাচারের রেখে যাওয়া ক্যানসার। সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত করতে না পারলে জনগণ স্বৈরাচারের দুর্নীতির কলঙ্ক থেকে মুক্তি পাবে না।

অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সময় পার করছে বর্তমান বাংলাদেশ। বিবিধ দুর্নীতির করাল গ্রাসে ক্ষত-বিক্ষত এ জাতি সর্বাত্মক দুর্নীতিগ্রস্ত দুঃশাসন পেরিয়ে সবার জন্য ঐক্য, স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের অভিন্ন আকাঙ্ক্ষায় উত্তরণের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিদায় নিয়েছে স্বৈরাচারী দুঃশাসক। একটি বৈষম্যহীন দেশ ও জাতি গঠনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মানুষ তাদের বিতাড়িত করেছে। ক্ষমতাচ্যুত সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল এ দেশের সর্বস্তরের জনগণের ওপর দীর্ঘকাল ধরে চলমান নিপীড়ন, সব ধরনের বৈষম্য ও প্রতারণামূলক চক্রান্ত দূর করা। তার জায়গায় একটি ন্যায়নিষ্ঠ, বৈষম্যহীন, কল্যাণকামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এ কাজটি মোটেও সহজ নয়।

বাংলাদেশ বিগত দেড় দশক যে ভয়াবহ দুঃশাসনের মধ্য দিয়ে গেছে, তার ভিত্তি কিন্তু একদিনে তৈরি হয়নি। ধীরে ধীরে দুঃশাসক ও তার সহযোগীরা একেকটা দানবে পরিণত হয়েছে। কে সৃষ্টি করেছে এসব দানব? কারা সৃষ্টি করেছে? যাদের মূল কাজই ছিল বিরোধীদের হত্যা ও নিপীড়ন। যারা দেশের কল্যাণ বাদ দিয়ে দিন-রাত লিপ্ত ছিল বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থ উপার্জনের অসুস্থ প্রতিযোগিতায়। একে একে ধসে পড়েছে দেশের আর্থিক খাত, সামগ্রিক অর্থনীতি। কিন্তু তাদের কোনো হেলদোল হয়নি। তারা অবাধ লুটপাট ও অর্থ পাচার চালিয়ে গেছে। সরকারের শীর্ষ থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত তাদের নিজস্ব ক্ষমতার আধিপত্য এবং আর্থিক অপব্যবহার নিয়ে দেশের সর্বত্র সরব ছিল এই দানবরা। ক্ষমতায় থাকা রাজনীতিবিদদের অশুভ জোট এবং পুলিশ, নিরাপত্তা বাহিনী, বেসামরিক প্রশাসক, ব্যাংকার, সাংবাদিক ইত্যাদির একাংশ তাদের সীমাহীন ও আত্মবিধ্বংসী লোভ দেশ ও দেশের সব প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দিয়েছে। ব্যাপক দুর্নীতি ও আর্থিক অপচয় ছিল এই দানবীয় শাসকের কেন্দ্রবিন্দু। ক্ষমতাচ্যুত শাসনামলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে সৎ ও নির্বিবাদী মানুষেরা। ভিন্ন মতের ওপর এমন কোনো স্টিমরোলার নেই যা চালায়নি তারা।

দুর্নীতিগ্রস্ত শাসনের বিরুদ্ধে যে অপূর্ব গণজোয়ারের মাধ্যমে দ্বিতীয়বারের মতো মুক্তির স্বাদ পেয়েছে বাংলাদেশ, তা টেকসই করতে হলে দেশের সর্বস্তর থেকে দুর্নীতিকে এখনই উৎখাত করতে হবে চিরতরে। দুর্নীতির পাগলা ঘোড়া যদি নিয়ন্ত্রণ না করা হয়, তবে দুর্নীতিই সদ্য অর্জিত স্বাধীনতাকে ধ্বংস করতে এবং আমাদের শহীদদের একটি প্রহসন তৈরি করতে যথেষ্ট। মাফিয়ারা সরকার চালায়, দুর্নীতি ছাড়া চলতে পারে না। এটাই ছিল তাদের ক্ষমতা ও নিপীড়নের প্রধান বাহন। অথচ একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্রে চাকরি পাওয়া বা কোনো ব্যবসা করা বা কোনো সরকারি সেবা পাওয়ার জন্য কোনো অর্থের বিনিময় হওয়া উচিত নয়। যারা দুর্নীতিতে জড়িত তাদের জন্য সরকারকে কঠোর শাস্তির বন্দোবস্ত করতে হবে। দুর্নীতিবাজদের জনসমক্ষে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। সামাজিকভাবে হেয় করতে হবে দুর্নীতিবাজ নেতা, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের।

বিগত সরকারের জঘন্যতম গণবিরোধী কর্মকাণ্ড জাতি অনুভব করেছে হাড়ে হাড়ে। যে সীমাহীন দুঃশাসন, ভিন্ন মতের ওপর যে অমানবিক নির্যাতন, যে পাশবিক আচরণ তারা করেছে সাধারণ মানুষের সাথে, স্বাধীনতাপূর্ব কালেও তা কখনো দেখেনি এ দেশের মানুষ। পিলখানায় ৫৭ মেধাবী নিরপরাধ সেনা কর্মকর্তাকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা, শাপলাচত্বরে বিপুল সংখ্যক উলামায়ে কেরামকে গণহত্যা, শেয়ারবাজার ও ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ চুরি, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ নজিরবিহীন অর্থ পাচারের ঘটনা জাতি কখনো ভুলবে না। পুলিশ এবং সরকারি কর্মকর্তাদের একটি অংশের দুর্নীতি এবং শারীরিক আক্রমণের পূর্বসূচি হিসেবে কাউকে অবমাননাকর শব্দ দিয়ে ট্যাগ করে কোনো অপরাধ ছাড়াই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যা করার উন্মুক্ত লাইসেন্স নিয়েছিল যেন তারা।

গণমাধ্যম ও মিডিয়াকে বলা হয় রাষ্ট্রের তৃতীয় চোখ। এ চোখকে একেবারে অন্ধ করে রেখেছিল বিগত সরকার। গণমাধ্যমগুলোর গলা চেপে ধরা হয়েছিল। সরকারি প্রচারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে বাধ্য করা হয়েছিল, শিক্ষা ব্যবস্থাকে ইচ্ছাকৃতভাবে ধ্বংস করা হয়েছিল অকেজো স্নাতক তৈরি করার জন্য, নিরপরাধ লোকদের তাদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে বছরের পর বছর নির্যাতনের আয়না ঘরে তাদের শাস্তি দেওয়া হয়েছিল, ভারতীয় শাসকদের খুশি করার জন্য জাতীয় স্বার্থ সমর্পণ করা হয়েছিল এবং ব্যবসাগুলোকে আঁকড়ে ধরেছিল। ক্ষমতায় বসে জোরে ডামি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচনকে পুরো জাতির কাছে উপহাসে পরিণত করেছিল। সাধারণ জনগণের ভোট নয় বরং নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণ করেছিল নিরাপত্তা সংস্থা ও সরকারি কর্মকর্তারা। এসবই দুর্নীতির ডিজিটাল রূপ।

তারা আদালত ও বিচার বিভাগকে ক্ষমতাসীন দলের একটি শাখায় পরিণত করেছিল, তাদের সরকারী কর্মচারী এবং পুলিশ কর্মকর্তারা বিরোধী নেতা-কর্মীদের ব্যাপকভাবে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করেছে, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা একটি নিয়ম বানিয়েছিল, জনগণের তাদের কষ্ট ও মতামত বলার কোনো অধিকার ছিল না, পশ্চিমাদের পাশে রাখার জন্য মাঝে মাঝে সন্ত্রাসের নাটক তৈরি করে, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে সরকার পরিচালিত সিন্ডিকেটগুলো লাভবান হয়েছিল, সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া আর কারও জীবনের মর্যাদা ও সম্মান ছিল না। পূর্ববর্তী সরকার প্রচারের চেষ্টা করেছিল যে, পুরো দেশটি একটি ব্যক্তি এবং একটি পরিবারের জন্য তৈরি হয়েছিল। ক্ষমতাসীন দলের সদস্যরা এবং তাদের আশীর্বাদপুষ্ট কর্মকর্তারা ছিলেন দেশের প্রকৃত মালিক এবং সাধারণ নাগরিকরা তাদের প্রজা। প্রকৃতপক্ষে, সরকারি দলের কর্মীরা ছিলেন নিরাপত্তা/সরকারি কর্মকর্তা এবং সরকারি কর্মকর্তারা কোনো ভেদাভেদ ছাড়াই দলীয় কর্মী ছিলেন। সেখানে কোনো মানবাধিকার ছিল না, ন্যায়বিচার ছিল না এবং দলীয় নেটওয়ার্কের বাইরের লোকদের জন্য কোনো সরকারি চাকরি ছিল না। দানবদের দ্বারা পরিচালিত অত্যাচারী ও ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা থেকে মুক্তি পেতে মানুষ মরিয়া ছিল। তরুণরা, বিশেষ করে আমাদের ছাত্ররা, জেনারেশন জেড আর নিতে পারেনি। তারা জনগণের মন পড়তে পেরেছিল এবং হারানো স্বাধীনতাকে উদ্ধারে জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন।

১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে সরকারি বাহিনীর হাতে ৮৭৫ জন নিহত হয়। নিহতদের ৭৭ শতাংশ গুলির আঘাতে মারা গেছে। ছাত্র-নেতৃত্বাধীন আন্দোলনে ৩০ হাজারের বেশি আহত হয়েছে বলেও জানা গেছে। আহতদের অনেকেই সম্পূর্ণ বা আংশিক দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন।

অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশের জনগণের দুর্ভোগের মূল কারণ দেশের শাসকদের দুর্নীতিবাজ চরিত্র। অবশ্যই, আর্থিক দুর্নীতি সুস্পষ্ট এবং সেই জন্য নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অপব্যবহার। কিন্তু, মনে হচ্ছে বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত শাসকরা এবং তাদের সহযোগীরা পুরোপুরি ভুলে গেছে যে দুর্নীতি অন্যায় এবং এটি একটি অপরাধ। তারা ব্যক্তিগত ও জনসাধারণের জীবনে দুর্নীতিগ্রস্ত অভ্যাস এবং স্বাভাবিক অভ্যাসের মধ্যে পার্থক্য করতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা এটা নিশ্চিত করেছে যে, তারা যা করতে চায় তা করার সমস্ত অধিকার বা ক্ষমতা রয়েছে এবং তারাই সবসময় সঠিক। প্রকৃতপক্ষে, তারা শেষ পর্যন্ত আর্থিক সুবিধা অর্জনের জন্য তাদের গোষ্ঠীর মধ্যে এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে চূড়ান্তভাবে। অনিয়মকেই নিয়মে পরিণত করেছে তারা। ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে অতি দূরের সম্পর্কযুক্ত লোকেরাও কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়েছে। জনগণের কষ্ট ও ভোগান্তির বিনিময়ে পুরো সরকারি ব্যবস্থাকেই পরিণত করেছিল সম্পূর্ণ দুর্নীতিগ্রস্ত একটি অর্থ উপার্জনের যন্ত্রে।

তাদের ক্ষমতাকে নিরবচ্ছিন্ন করতে এবং দীর্ঘকাল ধরে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে তাদের জন্য আশীর্বাদ হয়েছিল আমাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় দুর্নীতি। দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন সম্পূর্ণরূপে আশীর্বাদ ও সমর্থন করেছিল তাদের। শাসকরা কোনটা সঠিক আর কোনটা বেঠিক তা শেখার চেয়ে শিক্ষার্থীরা যাতে খেলাধুলা উপভোগ করে বা অন্য কিছু নিয়ে মেতে থাকে তা নিশ্চিত করতে শিক্ষা ব্যবস্থায় আনা হয়েছে বারবার পরিবর্তন। পুরো প্রজন্মকে ইচ্ছাকৃতভাবে নৈতিক মূল্যবোধ অর্জনের পাশাপাশি ভালো মানুষ হওয়ার জন্য কিছুই শেখানো হয়নি। তাদের ফেলে দেওয়া হয়েছিল এক ধরনের গোলক ধাঁধায়।

পুরো জাতি ক্ষমতাচ্যুত সরকারের নীতি অনুসরণ করলে দুর্নীতির প্রতিযোগিতায় আমাদের জনগণের কোনো ভবিষ্যৎ থাকবে না। যদি কেউ সত্যিকারের বাংলাদেশের কল্যাণে বিশ্বাস করে, তবে তাকে অবশ্যই জানতে হবে যে আমাদের অবশ্যই দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ও অর্থব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এটি সহজ কাজ নয়, কিন্তু এর কোনো বিকল্প নেই। দুর্নীতি বাইরে থেকে আসে না; এটা আমাদের মধ্যে থেকে হয়েছে, আমি যদি দুর্নীতি না করি, আমার চারপাশের সবাই দুর্নীতি না করে, তাহলে দুর্নীতি হবে না। তাই দুর্নীতির জন্য আমরাই দায়ী। আমরা যদি মানবিক মর্যাদা এবং সম্মানসহ একটি শান্তিপূর্ণ, উন্নত এবং ন্যায়বিচারপূর্ণ সমাজ চাই, তবে আমাদের প্রত্যেককে একটি সহজ অঙ্গীকার করতে হবে যে, আমি কোনো দুর্নীতি করব না বা সমর্থন করব না।

প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতিরও মোকাবিলা করতে হবে। স্বৈরাচারী শাসকরা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তাদের সমর্থনকারী প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতিকে সর্বদা আপস করে বা উপেক্ষা করে। সরকারি ব্যবস্থাকে অবশ্যই সব দুর্নীতিমুক্ত হতে হবে যাতে জনসেবা সহজ, অবাধ ও সহজলভ্য হয়। সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন হয় জনগণের করের টাকায় শুধু জনগণের সেবা করার জন্য এবং কোনো আর্থিক লেনদেন ছাড়াই তাদের সমস্যা সমাধানে সহায়তা করার জন্য। সরকারি কর্মকর্তাদের জনগণের সেবক ভাবতে শিখতে হবে। শিখতে না চাইলে জোর করে শেখানোর বন্দোবস্ত করতে হবে।

আমরা এমন একটি সমাজে বাস করছি যেখানে দুর্নীতিবাজ নেতার নেতৃত্বে এবং দুর্নীতিভিত্তিক প্রশাসন ব্যবস্থা। ১৯৭২ সালে কম্বল হারিয়ে যাওয়া এবং ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ থেকে শুরু করে ক্ষমতাচ্যুত শাসকদের সাম্প্রতিক ক্রিয়াকলাপ পর্যন্ত, দুর্নীতির এই ক্যানসার থেকে আমরা কখনই বিরতি পাইনি। এমনকি চাকরি পাওয়ার জন্য, প্রার্থীদের একটি অবস্থান নিশ্চিত করতে মোটা অঙ্ক দিতে বাধ্য করা হয়। সুতরাং, ফ্যাসিবাদী শাসককে অপসারণের ফলে এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে দূর হয়ে যাবে এমনটি ভাবা আহাম্মকি। রাষ্ট্র ব্যবস্থায় মানুষের স্বার্থ ও দুর্নীতিবাজ মানসিকতা এখনো অটুট রয়েছে। যে কোনো স্তরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন ও সমন্বিত সরকারি উদ্যোগ থাকতে হবে। প্রশাসনের দুর্নীতিবাজদের সরিয়ে সৎ লোকদের পদোন্নতি দিতে হবে। প্রশাসনের যে কোনো দুর্নীতিকে অবশ্যই নিষিদ্ধ করতে হবে এবং দুর্নীতিবাজদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।

ব্যক্তি পর্যায়ে দুর্নীতি বন্ধ না করলে এবং বর্তমান দুর্নীতিবাজ ব্যবস্থায় প্রশাসন পরিচালিত হলে আমরা কখনোই দুর্নীতিমুক্ত হতে পারব না। অন্যদের দোষারোপ করার আগে আমাদের অবশ্যই নিজেকে দোষারোপ করতে হবে যদি আমরা একই পাপের অনুশীলন করি। সরকারি কর্মকর্তাদের অবশ্যই দুর্নীতিমুক্ত সেবার উদাহরণ স্থাপন করতে হবে এবং ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য জনগণকে অবশ্যই দুর্নীতির লেনদেন থেকে দূরে থাকতে হবে।

যুক্তিসঙ্গতভাবে ভালো জীবনযাপন করার জন্য আমাদের কত টাকা দরকার? আগের সরকারের কতিপয় পুলিশ কর্মকর্তার মতো কত? নাকি কর কর্মকর্তারা? নাকি মেয়র? এমপিরা? না, এই লোকদের টাকা আছে কিন্তু মানুষ হিসেবে তারা সব হারিয়েছে। তাদের ‘শুদ্ধাচার’ পুরস্কার কি তাদের সুনাম বাঁচাতে সাহায্য করেছে? অর্থ তাদের সব কিছু কেড়ে নিয়েছে। তাদের এই কলঙ্কজনক পরিণতির পেছনে রয়েছে দুর্নীতি। অন্যান্য পুলিশ বা সরকারি কর্মকর্তারা কি একই পরিণতির মুখোমুখি হতে চান? যদি তা না হয়, তাহলে জাতি কীভাবে তাদের সম্মান করতে চায় তা তাদের পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে।

আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা এবং সমাজ ব্যবস্থা তথাকথিত ‘আলোকিতো মানুষ’ তৈরি করেছে যারা আমাদের কয়েক দশক ধরে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদ, টেকনোক্র্যাট, পুলিশ, আমলা, প্রশাসক, ব্যবসায়ী, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক প্রভৃতি এ সমাজের সেরা সন্তান। বর্তমান সিস্টেম যা তৈরি করতে সক্ষম তার ক্রিম তারাই। আমরা কি এই ধরনের বিখ্যাত ব্যক্তিদের আরও চাই যারা মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে? যদি তা না হয়, তাহলে আমাদের শিক্ষা, সামাজিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে নতুন করে ভাবতে হবে এবং পুনর্গঠন করতে হবে, যা এই ‘দুর্নীতির চ্যাম্পিয়নদের’ প্রতিস্থাপন করবে নিবেদিতপ্রাণ সেবকদের সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে।

শিক্ষার্থীদের অবশ্যই শেখানো উচিত- কোনটি সঠিক এবং কোনটি ভুল, কোনটি ন্যায় আর কোনটি অন্যায়। তাদের নৈতিকতা এবং চর্চা করে ভালো মানুষ হতে হবে। শিক্ষকদের অবশ্যই জ্ঞানের রোল মডেল এবং সর্বোত্তম চরিত্র এবং ছাত্র ও সম্প্রদায়ের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হতে হবে। দুর্নীতিগ্রস্ত জাতি হিসেবে পরিচিত একটি দেশে বসবাস করা এবং কাজ করা লজ্জাজনক। সারা বিশ্ব দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোকে ছোট করে দেখে। যে দেশ এত শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধার রক্ত দিয়ে স্বাধীন হয়েছিল, সেখানে আমরা দুর্নীতি করার সাহস করি কি করে? দুর্নীতি বন্ধ না করলে মহান ত্যাগী ব্যক্তিদের প্রতি আমাদের প্রকাশ্য সম্মান প্রদর্শন তামাশা হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশিদের একটি দুর্নীতিমুক্ত দেশে বসবাসের অধিকার রয়েছে। কঠোর পরিশ্রম এবং দুর্নীতিগ্রস্ত সিস্টেমকে পরিষ্কার করা এবং এটিকে একজন সৎ দিয়ে প্রতিস্থাপন করা ছাড়া এটি আসবে না। জনগণের প্রত্যাশা পূরণের দায়িত্ব নেতা ও প্রশাসকের নিতে হবে।

বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৯২ শতাংশের ওপরে মুসলমান। তারা সবাই বিশ্বাস করে যে, বিচারের দিন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার মুখোমুখি হতে হবে, তারা পৃথিবীতে গোপনে বা প্রকাশ্যে যা কিছু করে তার জন্য জবাবদিহি করতে হবে। স্পষ্টতই, এর মধ্যে আর্থিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতি এবং সব ধরনের ঘুষ অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এই তথাকথিত মুসলমানদের অনেকেই নিয়মিত ফরজ ও নফল নামাজ পড়ে, দান-খয়রাত করে এবং সুন্নতি পোশাক পরে, কিন্তু দুর্নীতি বন্ধের ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নিতে বা নিজে সচেতন হতে রাজি নয়। এদের মধ্যে কেউ কেউ ওমরাহ ও হজ করতে যায় এবং দুর্নীতির টাকা দিয়ে অন্য অলি-আউলিয়ার কবর জিয়ারত করে। তারা কি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাকে বোকা বা অন্ধ বানানোর চেষ্টা করছে? নবী মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন, নেক আমলের মধ্যে সবচেয়ে ভারী হলো ‘ভালো চরিত্র’ (আখলাক)। কাজেই, ভালো চরিত্রের অধিকারী কোনো ধার্মিক মুসলমান কখনোই কোনো দুর্নীতির কথা ভাববে না।

ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে অর্জিত দ্বিতীয় স্বাধীনতা আমাদের প্রমাণ করার আরেকটি সুযোগ দিয়েছে যে, আমরা বাংলাদেশে একটি দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন করে শহীদদের রক্ত ও জীবনকে সম্মান করতে পারি কিনা। এই সুযোগকে আমাদের জনকল্যাণে কাজে লাগাতে হবে। এটা আমাদের তরুণ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রত্যাশা ও স্বপ্ন। আমরা যদি এখনই পরিবর্তন না করি এবং দুর্নীতি পরিত্যাগ না করি তবে এটি হবে আমাদের শহীদদের প্রতি অসম্মানের আরেকটি প্রদর্শনী। বাংলাদেশকে দুর্নীতিমুক্ত দেশ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আমরা কি শুধু মুখে মুখে বলেই যাব নাকি ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত সংকল্প গ্রহণ করব? দুর্নীতিমুক্ত দেশগঠনে সবার ঐক্যবদ্ধভাবে সোচ্চার হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।

বিশ্ব দুর্নীতি উপলব্ধি সূচক : ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ১৪৯/১৮০ স্থানে রয়েছে

ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. শাহজাহান খান উপাচার্য, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ ইমেরিটাস অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ফেলো, বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি (বিএএস)

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

চট্টগ্রামে জুস ফ্যাক্টরির কারখানায় আগুন

গুম কমিশনে অভিযোগ করলেন ব্যারিস্টার আরমান

জাগপার নতুন সভাপতি লুৎফর, সম্পাদক রিয়াজ

সংস্কার খুব ধীরগতিতে চলছে : লায়ন ফারুক

নোয়াখালীতে ছাত্রদল-শিবির সংঘর্ষ, আহত ৬

মাওলানা আব্দুল আলিমের মৃত্যুতে বাংলাদেশ ইমাম সমিতির শোক

৩৫ বছর পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্যে ছাত্রশিবির

সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুস শহীদ গ্রেপ্তার

রেমিট্যান্স পাঠানোর শীর্ষে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম

লোকজ সুরের মূর্ছনায় উদীচীর ৫৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন

১০

হাটহাজারীতে কালবেলার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে হেফজখানা ও অনাথ আশ্রমে মধ্যাহ্নভোজ

১১

বার্লিনে যুবদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন

১২

ঢাবির দেয়াল লিখন ও গ্রাফিতি পরিদর্শন করলেন ফলকার টুর্ক

১৩

বাকৃবিতে শিক্ষার্থীকে মারধরের অভিযোগ

১৪

হবিগঞ্জে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে সংঘর্ষে আহত ১২

১৫

ময়মনসিংহে প্রতিপক্ষের হামলায় কিশোর নিহত

১৬

আ.লীগ ভেবেছিল ক্ষমতা চিরস্থায়ী : আনু মুহাম্মদ 

১৭

উন্নত-শান্তিময় বাংলাদেশ গড়তে লড়াই করে যাব : শিমুল বিশ্বাস 

১৮

নদী বাঁচাতে আবরার ফাহাদের দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের পথ নির্দেশ করবে : নাহিদ ইসলাম

১৯

ইসরায়েলকে বয়কটের ডাক বিশ্বের হাজারো লেখক-প্রকাশকের

২০
X