রেজাউল করিম
প্রকাশ : ১১ ডিসেম্বর ২০২২, ০৫:২৮ এএম
অনলাইন সংস্করণ

বঙ্গবন্ধুর উক্তি এবার জাতিসংঘে সন্নিবেশিত

বঙ্গবন্ধুর উক্তি এবার জাতিসংঘে সন্নিবেশিত

বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশ ও বাঙালির নেতাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন বিশ্বের নিপীড়িত-শোষিত মানুষের নেতা। তাই তো ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সের ন্যাম সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বিশ্ব আজ দুভাগে বিভক্ত, শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’ সম্মেলনে কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর তিনি তাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘এতদিন ভেবেছিলাম আমিই বুঝি অনিরাপদ, আজ থেকে তুমিও অনিরাপদের কাতারে চলে এলে। আজ থেকে বুলেট তোমাকে তাড়া করবে।’ বঙ্গবন্ধু জানতেন তার পরিণতি কী হতে পারে। কিন্তু যারা মানুষের জন্য কাজ করেন, মানুষ নিয়ে ভাবেন, নিজের জীবন, নিজের পরিবার নিয়ে ভাবার সময় তাদের কই?

বঙ্গবন্ধু ছিলেন শান্তিবাদী নেতা। তার পররাষ্ট্রনীতি ছিল ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’। এটা হলো বিশ্বমানবতার নীতি। যিনি বিশ্বমানবতা ধারণ করেন তিনিই হন বিশ্বনেতা। বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতির ওই উক্তি, যা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি, তা জাতিসংঘের রেজ্যুলেশনে সন্নিবেশিত হয়েছে। ২০২২ সালের ৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত ‘ওহঃবত্হধঃরড়হধষ ণবধত্ ড়ভ উরধষড়মঁব ধং ধ ‌েঁধত্ধহঃবব ড়ভ চবধপব, ২০২৩’ শীর্ষক রেজ্যুলেশনের ১৪তম প্যারায় এ উক্তি সন্নিবেশিত হয়।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদবিরোধী, শান্তির পক্ষে, মানবতার কল্যাণে নিয়োজিত নেতা। এজন্য বিশ্ব শান্তি পরিষদ তাকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদকে ভূষিত করে। অংরধহ চবধপব ধহফ ঝবপঁত্রঃু ঈড়হভবত্বহপব উপলক্ষে বিশ্ব শান্তি পরিষদ ঢাকায় ১৯৭৩ সালের ২২ ও ২৩ মে দুই দিনব্যাপী এক সম্মেলনের আয়োজন করে। ওই সম্মেলনের শেষের দিন ২৩ মে বিশ্ব শান্তি পরিষদের মহাসচিব রমেশ চন্দ্র বঙ্গবন্ধুর হাতে পদক তুলে দিয়ে বলেন, ‘শেখ মুজিব শুধু বঙ্গবন্ধু নন, আজ থেকে তিনি বিশ্ববন্ধুও বটে।’

বঙ্গবন্ধু যে বিশ্বমানের নেতা ছিলেন, বঙ্গবন্ধুর ভাষণগুলোই তার প্রমাণ। জাতিসংঘের ইউনেস্কো ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর তার ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তাকে বিশ্ব নেতার আসনে অধিষ্ঠিত করে। তার ৭ মার্চের ভাষণটি বিপ্লবের মাইলফলক। এ ভাষণ বিশ্বের নিপীড়িত মানুষকে বিপ্লবের মন্ত্রে উজ্জীবিত করে।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিশ্বের পথপ্রদর্শক, জাতিসংঘের পথপ্রদর্শক। বঙ্গবন্ধু মানবতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন প্রণয়ন করেন। জাতিসংঘ সে আইন প্রণয়ন করে ১৯৯৮ সালে। বঙ্গবন্ধু সমুদ্র আইন করেন ১৯৭৪ সালে। জাতিসংঘ সমুদ্র আইন করে ১৯৮২ সালে। বঙ্গবন্ধুর সমুদ্র আইনে ছিল এবং আছে—বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূল থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক সীমা আর ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত অর্থনৈতিক সীমা। জাতিসংঘ তা স্বীকার করে নিয়ে আইন করল যে, কোনো দেশের সমুদ্র উপকূল থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত সে দেশের রাজনৈতিক সীমা আর ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত অর্থনৈতিক সীমা।

বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব ছিল হিমালয় পর্বতসম। তার এ পর্বতসম ব্যক্তিত্বই পররাষ্ট্রনীতিতে বাংলাদেশের সাফল্য এনে দেয়। এ সাফল্যের বড় উদাহরণ হলো, বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে ভারতে ফেরত পাঠানো। মিত্র শক্তি হিসেবে কোনো দেশে অন্য দেশের সেনাবাহিনী একবার ঢুকতে পারলে তাদের বের করা মহাকঠিন কাজ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্কিন সেনাবাহিনী প্রবেশ করেছে, আজও তারা সেসব দেশে বহাল তবিয়তে আছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং তাদের কাছেই পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। বঙ্গবন্ধু মাত্র দুই মাস ১২ দিনের মাথায় ভারতীয় বাহিনীকে ভারতে প্রত্যাবর্তন করাতে সক্ষম হন। এটা ছিল অকল্পনীয়, অথচ বঙ্গবন্ধু তা বাস্তবে রূপ দিলেন বিনা যুদ্ধে। বঙ্গবন্ধুর সাহস ও ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো বলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি; কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্বে ও সাহসে এই মানুষটি হিমালয়। এভাবে আমি হিমালয় প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা লাভ করেছি।’

আন্দোলন-সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু মহাত্মা গান্ধীর চেয়ে সফল ছিলেন। গান্ধীজি ১৯২০ সালের অসহযোগ আন্দোলনে ভারতের সব শ্রেণির মানুষকে অংশগ্রহণ করাতে সক্ষম হন। কিন্তু তিনি ভারতের স্বরাজ অর্জনে ব্যর্থ হন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন এবং তাতে বাংলার সব শ্রেণির জনগণ ঝাঁপিয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলন স্বাধীনতা আন্দোলনের রূপ নেয় এবং বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হয়। ভারত সরকার ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুকে ‘গান্ধী শান্তি পুরস্কার’ প্রদান করে। ওই পুরস্কার ঘোষণাকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে মন্তব্য করেন, ‘বঙ্গবন্ধু ছিলেন মানবাধিকার ও স্বাধীনতার একজন চ্যাম্পিয়ন এবং ভারতীয়দের কাছেও একজন নায়ক।’

২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স সাউথ এশিয়া আয়োজিত সভায় ‘বঙ্গবন্ধু অ্যান্ড ভিসন্স অব বাংলাদেশ’ বিষয়ে বক্তৃতায় নোবেলজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু বাংলার বন্ধু ছিলেন না, তার ভূমিকা ছিল আরও অনেক বড় এবং অতুলনীয়। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের মহান রাজনৈতিক নায়ক, বাংলার সবচেয়ে সমাদৃত মানুষ, স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার। বাংলাদেশের জনজীবনে তার প্রভাব আজও বিপুল। তাকে ‘বাংলাদেশের জনক’ বা বঙ্গবন্ধু বলাটা নিতান্তই কম বলা। তিনি যে এর চেয়ে বড় কোনো অভিধা চাননি, সেটা তার সম্পর্কে আমাদের একটা সত্য জানান দেয় যে, তিনি নাম কিনতে চাননি, মানুষ তাকে অন্তর থেকে ভালোবাসত। বঙ্গবন্ধুকে তাই ‘বিশ্ববন্ধু’ হিসেবেও আমরা সম্মান জানাতে পারি। তার চিন্তা ও আদর্শ বিশ্বের জন্য, বিশেষ করে ভারত উপমহাদেশের জন্য আজ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। বঙ্গবন্ধুকে বলা হয় ‘রাজনীতির কবি’। ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল তাকে এ অভিধা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের নিউজউইক ম্যাগাজিন।

বঙ্গবন্ধু ক্ষমতায় ছিলেন মাত্র সাড়ে তিন বছর। এ স্বল্প সময়ে তিনি ১২৭টি দেশ ও জাতিসংঘ, আইএমএফ, কমনওয়েলথ, ওআইসির মতো ১০টি আন্তর্জাতিক সংগঠনের স্বীকৃতি আদায় করতে সক্ষম হন। বঙ্গবন্ধুর নাম ছিল বিশ্বজোড়া। বিশ্বের অনেক দেশের মানুষ বাংলাদেশ নাম বললে চিনত না; কিন্তু শেখ মুজিবের নাম বললে চিনত। তিনি বেঁচেছিলেন মাত্র ৫৫ বছর। এর মধ্যে ১৩ বছর ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে। ৫১ বছর বয়সে একটা জাতি রাষ্ট্রের স্রষ্টা হন। এটা কম কথা নয়, এটা একটা বিস্ময়। নেতার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু ছিলেন সাহিত্য ও সংস্কৃতিমনা মানুষ। তাই দেশি-বিদেশি অসংখ্য কবি, সাহিত্যিক, গায়ক তাকে নিয়ে কবিতা, ছড়া, গান লিখেছেন। তিনি একজন লেখকও বটে। তার লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’, ‘আমার দেখা নয়াচীন’ বইগুলো পড়লে মনে হবে তিনি লেখক হিসেবেও সার্থক।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ, ফরিদপুর

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমেরিকা ছাড়িয়ে ইউরোপে ইসরায়েলবিরোধী আন্দোলন

আগামী ৯ মে পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা চুয়েট

ক্ষমতার জন্য বিদেশি প্রভুদের দাসত্ব করছে বিএনপি : ওবায়দুল কাদের

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পটকা ফাটানো নিয়ে সংঘর্ষে নিহত ১

দেশের মানুষের প্রধান চাওয়া সুষ্ঠু নির্বাচন : ইসি হাবিব

শেরেবাংলার মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা

দুর্ঘটনার কবলে ইসরায়েলি নিরাপত্তামন্ত্রী

প্রেমের জন্য দিনটি ভালো

নরসিংদীতে হিটস্ট্রোকে শিশুর মৃত্যু 

রাজধানীর যেসব এলাকায় আজ গ্যাস থাকবে না

১০

বৃষ্টিতে ভিজল সিলেট

১১

শনিবার রাজধানীর যেসব এলাকায় যাবেন না

১২

ইতিহাসের এই দিনে আলোচিত যত ঘটনা

১৩

সকাল ৯টার মধ্যে ৬০ কিমি বেগে ঝড়ের পূর্বাভাস

১৪

২৭ এপ্রিল : আজকের নামাজের সময়সূচি

১৫

গুচ্ছের ভর্তি পরীক্ষা শুরু হচ্ছে আজ

১৬

নাটোরে অপহরণের ঘটনায় গ্রেপ্তার ৭

১৭

ছাত্র ইউনিয়নের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত 

১৮

ভোটদানের শর্তে কোরআন ছুঁয়ে টাকা নেওয়ার কল রেকর্ড ভাইরাল

১৯

‘বাংলাদেশের গণমাধ্যম ভয়াবহ সঙ্কটকাল পার করছে’

২০
*/ ?>
X