বাড়ছে মানুষ ও বন্যপ্রাণীর দ্বন্দ্ব-সংঘাত। সাগর আমাদের ভালো থাকার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে অথচ সাগরকে আমরা দূষিত করছি সার-তেলবোঝাই জাহাজ ডুবিয়ে। মরা জলজপ্রাণী ভেসে আসছে সৈকতে। নদীকে দখল, দূষণ আর ভরাট করে গলা টিপে আমরাই হত্যা করছি বৃহৎ স্বার্থকে অবজ্ঞা করে নিজের তুচ্ছ স্বার্থের জন্য।
যদ্দূর চোখ যায় শুধু জল আর জল। দৃষ্টির সীমান্তে সাগর-আকাশের প্রণয়বন্ধন। অপরাজিতা ফুলের মতো কী আশ্চর্য নীলের সাজ! ঢেউয়ের কণ্ঠে ছন্দ-সুরের বৃন্দগান। থেমে নেই গাংচিল-পানচিলের উচ্ছ্বাস। শুশুকগুলো ডুব-সাঁতার খেলছে। ছোট্ট জেলে নৌকাগুলো নিয়ে খেলছে সাগর। নোঙর করে রাখা নৌকার সঙ্গে হেসে হেসে কথা কইছে ঢেউগুলো। জাহাজগুলো স্বপ্ন নিয়ে ভেসে যাচ্ছে দূরের কোনো গন্তব্যে। সমুদ্রসৈকতে অসংখ্য মানুষের বাঁধভাঙা উল্লাস। চোখেমুখে রঙের ঝিলিক, মেঘ সরে যাওয়া দিনের হাসি। তৃপ্তির রসে সিক্ত মনের অলিগলি। উতল হাওয়ায় ভালোলাগার পরশ, ভালো থাকার প্রতিশ্রুতি। সাগরের প্রফুল্লতা অকাতরে বিলিয়ে দিচ্ছে মানুষকে। রংচটা শহরের অস্থির মানুষ স্থির হতে ছুটছে সাগরের কাছে, খুঁজে পাচ্ছে প্রশান্তি, খুঁজে পাচ্ছে অনাবিল সুখ। সাগরের উদারতার তোড়ে ভেসে যাচ্ছে মানুষের মনের বিবিধ দূষণ।
সবুজের ঢেউ খেলানো পাহাড়। চূড়ায় দাঁড়িয়ে মেঘ ছোঁয়া যায়। সূর্যহাসা বিকেলের নীলাকাশ আর নিচে সবুজ বনের রূপ উতলা করে তোলে হৃদয়-মন। পাহাড়ের গা আঁকড়ে বিভিন্ন প্রজাতির গাছের মুগ্ধতা। পাখ-পাখালির কলকাকলি আর বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণই পাহাড়ি বনের প্রাণের স্পন্দন। বুনোফুলের মাদকতা ছড়িয়ে আছে চারপাশে। মৌমাছির স্পর্শ পেতে চঞ্চল হয়ে উঠছে ফুল। নূপুর পায়ে ঝরনা ছুটছে নদীর ভালোবাসায় বন্ধুর পথ মাড়িয়ে। এগিয়ে চলাই যেন অস্তিত্বের ঘোষণা, জীবন প্রবাহ। পাহাড়ের প্রকৃতি প্রাণ খুলে হাসতে জানে। সেই হাসির স্রোতে ভেসে যায় মানুষের মনে জমে থাকা দুঃখ, গ্লানি, রাগ, ক্ষোভ পাওয়া-না পাওয়ার শোক।
ছায়ার মায়া দিয়ে বন প্রাণকে আগলে রাখে। মানুষের বুকের পাথর ভার নামিয়ে দেয় নির্মল বাতাসের জাদুতে। বন সাত রাজার ধনের চেয়েও দামি, অমূল্য সম্পদ। বন জীবন বাঁচায়, জীবন সাজায়, গতি দেয়। বন দেশ বাঁচায়, বিশ্ব বাঁচায়। বন প্রাণকে সজীব করে তোলে, শক্তি জোগায়, বিনয়ী করে, শান্ত করে। আশ্রয় দেয় মায়ের মমতার মতো। বন খাবার দেয়, রোগের প্রতিষেধক দেয়। মানুষের অসুখ, অবসাদ, ক্লান্তি ভরা বিষণ্ন মনকে বন ফিরিয়ে দেয় শান্তির পরশ। বনের ভেতর দাঁড়িয়ে মনের পরিবর্তনে সৃষ্টি হয় অন্য জগৎ। যে জগতে জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ নেই, তাড়া নেই, নিষ্ঠুরতা নেই, কোলাহল নেই, দূষণ নেই, পিছুটান নেই, সময়ের পরিমাপ নেই। অর্থাৎ প্রকৃতি বাঁচলে, বাঁচবে মানুষ, বাঁচবে প্রাণ, বাঁচবে পৃথিবী।
ষোড়শী যৌবনা নদী মনটা ফুরফুরে করে দেয়। নদীর মতো মনের নদীতেও উপচে পড়ে খুশির ঢেউ। মাঝ গাঙে নৌকা ভাসিয়ে নদীর জলে হাত দিলেই বিদ্যুতের শকের মতো খারাপ লাগাগুলো কর্পূরের মতো উড়ে যায়। হারান মাঝির ভরাট গলার ভাটিয়ালি গান দূর করে দেয় মনের সব অসুখ। রঙিন পাল, বৈঠার তাল, ধ্যানী বক, খোলা নীল আকাশ, ঝাঁকবাঁধা পাখির ডাক, ঝিরিঝিরি বাতাস বিষণ্ন মনের উঠান প্রসন্ন করে দেয়। নৌকায় এসে লাগা কুলকুল ঢেউগুলো বিলকিসের হাতের কাচের চুড়ির মতো সুর তোলে, চোখে ঘোর আনে।
মন ভালো করার বড় দাওয়াই হলো গ্রাম। মায়ের মমতা মাখানো প্রতিটি গ্রামেই রয়েছে নদী-পুকুর, খাল-বিল, বিস্তীর্ণ জলাশয়। বাড়ির উঠানে আছে গন্ধরাজ, বেলি, জবা, টগরসহ নানা জাতের ফুলের গাছ। বাঁশবাগানে আলো-আঁধারির খেলা। আম, আতা, নারিকেল, জামরুল, সুপারি, জারুল, তেঁতুল, কাঁঠাল, বরই, পেঁপে ইত্যাদি গাছের বাগিচায় মোড়ানো এক একটা বাড়ি যেন প্রকৃতির কোলে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার নিরাপদ আশ্রয়স্থল। গ্রামে যান্ত্রিক ঘড়ির কাঁটায় সময় চলে না, সময় গড়ায় প্রকৃতির কাঁটায়। সকালে মানুষের ঘুম ভাঙে পাখির সুরেলা গানে। হামাগুড়ি দিয়ে সন্ধ্যা নামে—সেও পাখির কলকাকলিতে। মানুষের কাজকর্ম, সুখ-দুঃখগাথা রচিত হয় প্রকৃতিকে ঘিরে।
বাংলার প্রতিটি ঋতুর দিন-রাতের মুহূর্তগুলো পরিবর্তিত হয়। সকালের মোলায়েম রোদ খেলা করে, সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে রোদের তাপ বাড়ে। দুপুরে তেতে ওঠে চারপাশ। ক্লান্তির ছাপ পড়ে প্রাণ-প্রকৃতিতে। এরপর সূর্য হেলে বিকেল নামে। নরম হয়ে আসে রোদের শরীর। কর্মব্যস্ত মানুষ ঘরে ফেরে। সন্ধ্যা নামে আঁধার ঢেলে। বাংলার রাতেরও সৌন্দর্য আছে। পূর্ণিমার এক সৌন্দর্য। অমাবস্যায় আরেক। অবশ্য একেক ঋতুর সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা ও রাত—একেক সৌন্দর্যে ধরা দেয়।
নীল জলের অথৈ সাগর, ঢেউ খেলানো সবুজ পাহাড়, ছায়ার মায়ার বন, বহতা নদী আর মায়ের মমতা মাখানো গ্রাম, ষড়ঋতুর বৈচিত্র্যময় মুহূর্তই নয়, আমাদের মন ভালো করার আরও অনেক স্থান রয়েছে। বন সুন্দরী সুন্দরবন, প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্টমার্টিন, নীলগিরি, নীলাচল, প্রকৃতিকন্যা জাফলং, জলের বন রাতারগুল, পদ্মফোটা বাইক্কার বিল, মেঘ ছুঁয়ে দেখা সাজেক, নিঝুম দ্বীপ, পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার, সাগরকন্যা কুয়াকাটা, মিষ্টি জলের সাগর হাওর-বাঁওড় ইত্যাদি।
আমাদের নতুন প্রজন্মকে বাঁচাতে হলে, আমাদের বেঁচে থাকতে হলে প্রকৃতিকে ভালো রাখতেই হবে। তলা শুকনো মরা নদীতে কখনোই দেখতে পাব না হারান মাঝির রঙিন পালের নৌকা, শুনতে পাব না বিলকিসের কাচের চুড়ির রিনিঝিনি ছন্দ-সুর। বুকফাটা মাঠে দেখতে পাব না সোনালি ধানের হাসি। অন্যদিকে পাহাড় যাচ্ছে মানুষের আহারে। রোহিঙ্গাদের বসতি স্থাপনে বন্যপ্রাণীর বিচরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বন উজাড় ও ঝোপ-জঙ্গল সাফ করে রাস্তাঘাট, রেললাইন নির্মাণ করছি বনের ভেতর দিয়ে। বনের আয়তন কমে আসায় লোকালয়ে আসছে বন্যপ্রাণী। বাড়ছে মানুষ ও বন্যপ্রাণীর দ্বন্দ্ব-সংঘাত। সাগর আমাদের ভালো থাকার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে অথচ সাগরকে আমরা দূষিত করছি সার-তেলবোঝাই জাহাজ ডুবিয়ে। মরা জলজপ্রাণী ভেসে আসছে সৈকতে। নদীকে দখল, দূষণ আর ভরাট করে গলা টিপে আমরাই হত্যা করছি বৃহৎ স্বার্থকে অবজ্ঞা করে নিজের তুচ্ছ স্বার্থের জন্য। পাল্টে যাচ্ছে গ্রামের আদল। দিনে দিনে শহর ঢুকছে গ্রামে। বিপন্ন হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। একের পর এক বৃক্ষ নিধন করে স্বপ্নের রাজপ্রাসাদে অসুখ নিয়ে বেঁচে আছি আমরা। সভ্যতার ক্রমবিকাশ আর প্রকৃতি সংরক্ষণ হয়ে উঠছে সাংঘর্ষিক।
প্রকৃতি হলো মা। আমরা তার সন্তান। আমাদের মা ভালো নেই। মা ভালো না থাকলে সন্তানও ভালো থাকবে না। প্রকৃতি মাকে ভালো রাখতে হলে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে হতে হবে প্রকৃতিবান্ধব। আমি আমার জায়গা থেকে কী ভূমিকা পালন করছি সেদিকেও তাকাতে হবে। মনে রাখতে হবে, প্রকৃতির মাঝে রয়েছে আমাদের বেঁচে থাকার নিয়ামক।
লেখক : সম্পাদক, প্রকৃতিবার্তা