বেশিরভাগ কলামিস্টের মতো আমারও প্রেসিডেন্সিয়াল ক্যাম্পেইন চালানোর অভিজ্ঞতা নেই। না, শূন্য। কোনো অভিজ্ঞতা নেই আমার।
ক্যাম্পেইন নিয়ে কাজের অভিজ্ঞতা বলতে ৪০ বছর আগেকার একটি স্মৃতিই রয়েছে আমার। সেটি হলো- অটোয়াতে অবসরপ্রাপ্ত এক এমপির উত্তরাধিকারের পক্ষে নির্বাহী সহযোগী হিসেবে প্রচারণার কাজে অংশ নেওয়া।
নির্বাচনী প্রচারণা বলতে স্রেফ এতটুকুই করেছি আমি।
যা হোক, অবশেষে ২০২৪ সালের নির্বাচন চলেই এলো।
নির্বাচনী প্রচারণা চালানোতে আমার অভিজ্ঞতার দৌড় খুবই স্বল্প হলেও ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাছে চলে আসার পর মনে হচ্ছে, জো বাইডেন কী করলে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে আরেকবার হারাতে সক্ষম হবে সে বিষয়ে আমি পরামর্শ দিতেই পারি।
আমার মতো যেসব লেখকরা সব ধরনের বিষয়ে মতামত প্রকাশের জন্য টাকা পান, সত্যি বলতে তারা মাঝে মাঝে প্রতারণামূলক বক্তব্যও প্রকাশ করতে বাধ্য হন।
কীভাবে প্রেসিডেন্সিয়াল ক্যাম্পেইনে জিততে হয় তা নিয়ে আমাকে ব্যবস্থাপত্র লিখতে বলা হয়েছিল। আমি কয়েকটি পোলের ফলাফল দেখলাম, সেখানে বাইডেন ও ট্রাম্প মুখোমুখি অবস্থানে আছেন। এইটুকু বোঝা গেল, সুইট আঙ্কেল জো খুব চুপিসারে একটি বোতাম টেপা বোমার মতো টক আঙ্কেল জো-তে পরিণত হয়েছেন।
প্রথমে সমস্যাযুক্ত পোলের কথায় আসা যাক, আমার এটা লিখতে যেমন কষ্ট হচ্ছে, ধারণা করছি আমেরিকানদের এটা পড়তেও ব্যথা লাগবে। ইতোমধ্যে আদালত থেকে দুবার অভিযুক্ত হওয়া এবং আসন্ন সময়ে আরও অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় থাকা ডোনাল্ড ট্রাম্প পোলের হিসাব অনুযায়ী ২০২৪ সালের নির্বাচনে উতরে যাবেন।
জাতীয়ভাবে পরিচালিত কিছু কিছু জরিপে দেখা গেছে, জো বাইডেনের চেয়ে দুই থেকে চার পয়েন্টে এগিয়ে আছেন ট্রাম্প। অন্যান্য জরিপে বাইডেন ও ট্রাম্প এই প্রতিযোগিতায় সমানে সমান অথবা বাইডেন শতকরা এক-দুই পয়েন্টে এগিয়ে আছেন।
কিছুটা বদান্যতা দেখিয়ে বলা যায়, এই ধরনের ছোটখাটো পার্থক্য একটু বেশি বিশৃঙ্খলতা সৃষ্টি করছে।
যদি যুক্তিবোধ, ধৈর্য ও ভদ্রতা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়াত- তাহলে বেশ ভরসাজনক এবং প্রশস্ত উপায়েই ট্রাম্প বাইডেনের অনুগামী হতেন। কিন্তু এটাও স্বাভাবিক, লাখো আমেরিকান তাদের ক্ষিপ্ত নেতার মতোই যুক্তিবোধ, ধৈর্য ও ভদ্রতা ত্যাগ করেছেন।
নিজের রাগের মাধ্যমে ট্রাম্প মুর্খতা, অসহিষ্ণুতা এবং অভদ্রতাকে একগুয়ে এবং শক্তিশালী একটি রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করেছেন।
ট্রাম্প সমর্থকদের ঐশ্বরিক নিশ্চল অবস্থাকে প্রশমিত করে মিষ্টি কথা দিয়ে যুক্তিবোধ এবং শালীনতার শামিয়ানাতলে নিয়ে আসার সব চেষ্টাই বৃথা গেছে। তারা যোগাযোগের ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন, ষড়যন্ত্র তত্ত্বে মজে থাকেন, যারা বিয়ে করেছেন ধর্মান্ধতাকে এবং উৎপীড়িত হওয়ার স্মৃতি যাদের কর্মকাণ্ডের জ্বালানি হিসেবে কাজ করে। এরা শুধু নিজের চরম সাধুতার ধারণা নিয়ে খুশি থাকেন।
ট্রাম্পের ‘ধারাবাহিক নাটকে’র মতো শ্লীলতাহানিময় ওয়াইল্ড কার্ড চালার বিপরীতে- নিরপেক্ষ স্বাধীন ভোটার ও হতাশ রিপাবলিকানদের আকৃষ্ট করে বাইডেনের জয় আসবে ভাবাটা গোয়ারের মতো কাজ হবে।
২০২৪ সালে যুক্তির বিচারে চলা আমেরিকানরা অস্থিরতা আর স্থিরতার ভেতর স্থিরতাকে বেছে নেবে- বাইডেনকে আরামদায়ক এই প্রহেলিকা থেকে বের হয়ে এসে এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি কাজ করতে হবে।
২০১৬ সালের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচন এটার প্রমাণ ছিল, চলমান অবস্থা বহাল রাখলে আত্মতুষ্টিতে ভোগা প্রার্থী থেকে শুরু করে যুগচেতনার ভার বহন করা- পরিবর্তনের জন্য মুখিয়ে থাকা ভোটাররা ট্রাম্পের মতো অচ্ছুত ‘বিদ্রোহী’ ফেরিওয়ালাকে নির্বাচিত করেন।
ট্রাম্প বোঝেন, হোয়াইট হাউজের জন্য কোনো ‘হাই রোড’ নেই- আমি চলতি মাসের ওভাল অফিসে কোকেইন উদ্ধারের কথা বলছি না।
চিরস্থায়ীভাবে ট্রাম্প হামলার মুখোমুখি। ট্রাম্পের ডেমোক্র্যাটিক ও রিপাবলিকান শত্রুদের ওপর কিশোরসুলভ অসাড় হামলা- তার প্রতিপক্ষকে পুরুষত্বহীন দেখোনো, তাদের উদ্দেশ্যকে কলুষিত করা এবং সমর্থকদের আরও শক্তি জোগানোর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
যতটা আজগুবি আর রূঢ় শোনাক না কেন, ট্রাম্প তার জঘন্য কার্যকলাপ চালিয়ে গেলে এটা সহজে অনুমেয়- তিনি আবারও কমান্ডার ইন চিফের পদে ফিরে আসতে পারেন। বাইডেনকেও একইভাবে জবাব দিতে হবে। একজন প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাকে নিয়মের বাইরে না গিয়ে সংযত আচরণ করে- কয়েক মাস পরেই শুরু হতে যাওয়া নির্বাচনী প্রচারণার আগে সকল প্রকার কাদা ছোড়াছুড়ির ঊর্ধ্বে থাকার অচল ধারণা ত্যাগ করতে হবে।
নিজের রাগের ওপর লাগাম না টেনে বাইডেনের উচিত হবে নিজের চরিত্রের স্বকীয় এই বৈশিষ্ট্যকে জনসম্মুখে প্রকাশ করা।
বাইডেনের উচিত হবে ট্রাম্পের মতো অসভ্য ভাষা ব্যবহার করে, সাহায্যকারী সংস্থাগুলোকে তুষ্ট করার মাধ্যমে তাকে গেঁথে ফেলা।
বাইডেনের এখন সেই সময় এসে গেছে, যখন হাতের আঙুলের গাঁটে পিতল লাগিয়ে এটা প্রমাণ করা দরকার, ৮০ বছর বয়সী প্রেসিডেন্টের ভেতরে এখনো কিছু কুৎসিত মারামারি অবশিষ্ট আছে। বাইডেনের উচিত ট্রাম্পকে একজন ভয়ংকর বক্তৃতাবাজ নেতা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া- যিনি ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিল বিদ্রোহের এক বছরপূর্তিতে তার বিষাক্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘এই হামলা গণতন্ত্রের গলায় ছুরি ধরেছে।’
বাইডেনের ফিরে যাওয়া উচিত ২০২২ সালের ৬ সেপ্টেম্বরে, ফিলাডেলফিয়ার ইন্ডিপেন্ডেন্স হলে—যখন তিনি দৃপ্তকণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমরা জাতির আত্মার জন্য যুদ্ধে নেমেছি।’
তিনি বলেছিলেন, ‘যে হুমকির মধ্যে আমরা জাতিগতভাবে দাঁড়িয়ে, আমি সেটা নিয়ে সোজাসাপ্টা কথা বলতে এসেছি। তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের অবশ্যই নিজেদের সঙ্গে এবং নিজেদের কাছে সৎ থাকতে হবে। আমাদের দেশে যা ঘটছে তার বেশিরভাগই কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং এমএজিএ রিপাবলিকানরা চরমপন্থাকে প্রকাশ করেন যা আমাদের দেশ গঠনের মূল ভিত্তিকে হুমকির মধ্যে ফেলে।’ বাইডেনের এমন সৎ ও সোজাসাপ্টাভাবে কথা বলা উচিত এবং সেটা এখনই করার সময়।
বাইডেনের উচিত কয়েকটি কথা বারংবার বলা, তা হলো- ‘এমজিএমএ রিপাবলিকানরা দেশের সংবিধানকে সম্মান করে না। তারা আইনের অনুশাসনে বিশ্বাস করে না। তারা গণমানুষের ইচ্ছার কথা মাথায় রাখে না।’
তার উচিত এগুলো বারবার বলা, ‘এমজিএমএ রিপাবলিকানরা দেশকে পেছনের দিকে নিয়ে যেতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সেই আমেরিকায় তারা ফেরত যেতে চায় যেখানে নিজের ইচ্ছার কোনো দাম নেই, নিজের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার নেই, গর্ভনিরোধের সুযোগ নেই, যাকে ভালোবাসেন তাকে বিয়ে করার অধিকার নেই।’
গত বসন্তে ভাষণের পর কংগ্রেসের বাইরে ও ভেতর ট্রাম্প সমর্থকরা আমেরিকাকে পেছনে টেনে এমন একটি জায়গায় নিয়ে গেছেন যেখানে– শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য থাকার আইনকে হত্যা করা হয়, শিক্ষার্থীদের ঋণ মওকুফ করার আইন বাতিল করা হয়, যেখানে সমলিঙ্গীয় বিয়ের বিরুদ্ধাচরণ করা ধর্মান্ধদের বুকে টেনে নেওয়া হয়।
শুধু তাই নয়, প্রথমবারের মতো কোনো সাবেক প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে চরম গোপনীয় নথি মজুত করার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়াও একজন রক্ষিতাকে ঘুস দিয়ে মুখ বন্ধ করানোর অভিযোগও উঠেছে তার বিরুদ্ধে।
সততার সঙ্গে স্পষ্টভাষায় সোজাসাপ্টাভাবে এসব নিয়ে কথা না বলে বাইডেন বিনয়ী হয়ে ‘প্রধানমন্ত্রীর মতোন’ আচরণ দেখাচ্ছেন।
২০২০ সালের প্রেসিডেন্সিয়াল ক্যাম্পেইনে যারা বাইডেনকে তহবিল সংগ্রহের রেকর্ড গড়তে সহায়তা করেছিলেন, তার ক্ষিপ্ত পাল্টা আক্রমণের অনিচ্ছা তাদের বাইডেনের অসাড়তা ও নিষ্ক্রিয়তার বার্তা দেয়।
অর্থই রাজনীতির অক্সিজেন। চলমান অবস্থার ছিপি আটকাতে চাইলে বাইডেন এবং তার শৌখিন পরামর্শকদের উচিত হবে– রাগী জো-কে বের করে আনা। যেখানেই থাকুন না কেন বের করে আনা।
এর অন্যথা হলে অনেক দেরি হয়ে যেতে পারে।
মূল লেখা : অ্যান্ড্রু মিত্রোভিকা, আলজাজিরার কলামিস্ট।
ভাষান্তর : সরকার জারিফ।
মন্তব্য করুন