জাকির হোসেন
প্রকাশ : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৪:২৮ এএম
অনলাইন সংস্করণ

ভাষা আন্দোলনে বিশ্বের প্রথম নারী শহীদ

ভাষা আন্দোলনে বিশ্বের প্রথম নারী শহীদ

কমলা ভট্টাচার্য বিশ্বের প্রথম নারী ভাষাশহীদ। বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবিতে ১৯৬১ সালের ১৯ মে আসামের শিলচর স্টেশনে বিক্ষোভকারীদের ওপর আধাসামরিক বাহিনীর গুলিতে যে ১১ জন শহীদ হয়েছিলেন, কমলা ভট্টাচার্য ছিলেন তাদেরই একজন। কমলা ভট্টাচার্যের জন্ম অবিভক্ত বাংলার সিলেটে ১৯৪৫ সালে। পিতা রামরমন ভট্টাচার্য ও মাতা সুপ্রবাসিনী দেবী। সাত ভাইবোনের মধ্যে কমলা পঞ্চম আর বোনদের মধ্যে তৃতীয়। দেশ ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের ওপর নিপীড়ন ক্রমাগত বাড়তে থাকে। এতে উদ্বিগ্ন হয় কমলার পরিবার। আর তারই রেশ ধরে সাত সন্তানকে নিয়ে বিধবা সুপ্রবাসিনী দেবী ভারতে পাড়ি জমান। আশ্রয় নেন একসময়ের অবিভক্ত বৃহত্তর সিলেটের অংশ শিলচরে। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে উদ্বাস্তু হয়ে শিলচরে পা রেখেছিলেন কমলা।

সেখানে কমলার শিক্ষাজীবন শুরু হয় ‘ছোটেলাল শেঠ ইন্সটিটিউটে’। একে তো উদ্বাস্তু, তার ওপর আর্থিক অনটন। কমলার বড় দিদি বেণু নার্সিংয়ের চাকরি পেয়ে প্রশিক্ষণের জন্য চলে যান শিমুলগুড়ি। মেজো দিদি প্রতিভা ছিলেন স্কুলের শিক্ষিকা। অর্থনৈতিকভাবে প্রতিভার ওপরই নির্ভর ছিল গোটা পরিবার। বই-খাতা কেনার পয়সা ছিল না কমলার। সহপাঠীদের কাছ থেকে বই ধার করে খাতায় টুকে লেখাপড়া করতেন তিনি। লেখাপড়ার সুবিধার জন্য কমলা একবার তার বোনের কাছে একটি অভিধান কিনে দেওয়ার আবদার করেছিলেন। কিন্তু অর্থের অভাবে কমলার এ ইচ্ছেপূরণ করতে পারে নি তার বোন। অভাবের মাঝে বড় হওয়া কমলা তবুও স্বপ্ন দেখে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত পড়ালেখা করার, সেই সঙ্গে টাইপরাইটিং শিখে একটা কেরানির চাকরি নিয়ে মায়ের দুঃখ দূর করবেন। কমলা যখন দশম শ্রেণির ছাত্রী, বরাক উপত্যকা তখন উত্তাল ভাষার সংগ্রামে। অভাব অনটনে বড় হওয়া কমলা মনে মনে তখন ভীষণ লড়াকু। সরকারের ভাষানীতির বিরুদ্ধে সেও হয়ে উঠে সোচ্চার।

১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে শিলচরের কাছাড়ে তখন গঠিত হয়েছে ‘কাছাড় জেলা গণসংগ্রাম পরিষদ’। সেখানেই নেতাদের বক্তৃতা শুনে ভাষা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হয় কমলা। সামনেই তখন তার মাধ্যমিক পরীক্ষা। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে সে চলে যায় সত্যাগ্রহী আন্দোলনকারীদের বক্তৃতা শুনতে। ১৯৬১ সালের ১৪ এপ্রিল নববর্ষের দিনে আন্দোলনকারীদের সংকল্প দিবসে। এ কর্মসূচিতেও কমলা যোগ দেন এবং মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার শপথ দেন। সত্যাগ্রহী আন্দোলনকারীরা ১৯ এপ্রিল থেকে পদযাত্রা শুরু করেন এবং ২ মে শিলচরে পৌঁছান। কথা ছিল, ১৩ এপ্রিলের মধ্যে ভাষা বিল বাতিল না হলে ১৯ মে বরাক উপত্যকায় সর্বাত্মক হরতাল। ১৮ মে ছিল মাধ্যমিক পরীক্ষার শেষ দিন। তাই পরীক্ষার পরদিন যথারীতি হরতাল কর্মসূচিতে যোগ দেন। একে তো তারা ‘দেশ হারানো’ মানুষ। অন্যদিকে বিপন্ন তাদের মাতৃভাষা। এ বোধ কমলাকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। কমলার মা সুপ্রবাসিনী দেবী মেয়ের এ মনোভাব বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তিনি বাধা দেননি। মেয়ের অজানা বিপদের আশঙ্কায় তিনি নীরবে চোখের পানি ফেলেছেন। মেজো বোন হরতালে যেতে নিষেধ করেছিলেন, কিন্তু কমলা বিষয়টি আমলেই নেননি।

১৯৬১ সালের ১৯ মে সকালে মেজো বোন প্রতিভার স্কুলে যাওয়ার জন্য রাখা শাড়ি আর ব্লাউজ পরেই কমলা বের হয়ে যান। যাওয়ার আগে মায়ের কাছ থেকে এক টুকরো কাপড় চেয়ে নেন, কাঁদানে গ্যাস ছুড়লে যেন মুখে চেপে ধরতে পারেন। যাওয়ার আগে কিছু খেয়ে যেতে চেয়েছিলেন কমলা কিন্তু ঘরে কিছুই না থাকায় খালি পেটেই বের হতে হয় তাকে। সঙ্গে ছিল ১১ বছরের ছোট বোন মঙ্গলা। স্থানীয় সত্যাগ্রহ আন্দোলনের নেত্রী জ্যোৎস্না চন্দের ডাকে ২০-২২ জনের নারীর দলে যোগ দেন কমলা, উদ্দেশ্য শিলচর রেলওয়ে স্টেশন। অজানা বিপদের আশঙ্কায় কমলার বিধবা মা সুপ্রবাসিনী দেবীর মনে কোনো স্বস্তি ছিল না। তিনি দুপুরের দিকে কমলার ছোট ভাই বকুল আর বড় বোনের ছেলে বাপ্পাকে নিয়ে রেলওয়ে স্টেশনে আসেন। বকুল আর বাপ্পাকে প্রথমে পুলিশ ধরলেও পরে ছেড়ে দেয়। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মাকে আবার বুঝিয়ে শুনিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেন কমলা। সেই ছিল মায়ের তার শেষ সাক্ষাৎ।

এদিকে আন্দোলনের তীব্রতায় হতচকিত রাজ্য সরকার, আসাম রাইফেল বাহিনীকে পাঠায় স্টেশনে। আন্দোলনরত নেতাদের ধরে ট্রাকে তুলে নিতে উদ্ধত হলে জনতা ট্রাক অবরোধ করে। সবার মুখে তখন স্লোগান ‘বাংলা ভাষা জিন্দাবাদ, মাতৃভাষা জিন্দাবাদ’। এ সময় শুরু হয় আন্দোলনকারীদের ওপর সরকারি বাহিনীর লাঠিচার্জ। লাঠিচার্জ থেকে বোনকে বাঁচাতে মঙ্গলাকে আঁকড়ে ধরে কমলা। ২টা ৪৫ মিনিট দিকে পুলিশ বিনা প্ররোচনায় ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালায়। এতে ১১ জন মৃত্যুবরণ করেন। এর মধ্যে একজন ছিল ১৬ বছরের কিশোরী একমাত্র নারী কমলা ভট্টাচার্য। একটি গুলি তার চোখ দিয়ে ঢুকে মাথা ফুঁড়ে বেরিয়ে যায়। আহত হয় তার ছোট বোন মঙ্গলা। তার পাশেই লুটিয়ে পড়ে কমলা। মঙ্গলা হাসপাতালে গিয়ে সুস্থ হয়ে উঠলেও চোখের সামনে বোনের মৃত্যু তাকে চিরদিনের জন্য অপ্রকৃতস্থ করে।

মাধ্যমিক পাসের পর চাকরিতে যোগ দিয়ে পরিবারকে সহযোগিতা করতে চেয়েছিলেন কমলা। মাধ্যমিকে তিনি পাস করেছিলেন ঠিকই। কিন্তু চাকরি আর করা হয়নি, দাঁড়ানো হয়নি পরিবারের পাশে। স্বাধীন ভারতে ১৯ মে ভাষা আন্দোলনের এক রক্তাক্ত ইতিহাস। কমলার আত্মদান বৃথা যায়নি। এ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্য সরকার ১৯৬১ সালে ‘সরকারি ভাষা’ আইন সংশোধন করে বাংলাকে অবিভক্ত কাছাড় জেলার সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। কমলাসহ ১১ জন শহীদের আবক্ষ মূর্তিসহ একটি ব্রোঞ্জ ফলক রয়েছে শিলচর স্টেশনের এক শহীদ বেদির ওপর। শিলচর স্টেশনকে ভাষাশহীদ স্টেশন হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে। ২০১১ সালে, ভাষা আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে কমলার স্কুল প্রাঙ্গণে ছোটেলাল শেঠ ইন্সটিটিউটে কমলার একটি আবক্ষ ব্রোঞ্জমূর্তি স্থাপন করা হয়। শিলচরের পাবলিক স্কুলের গা ঘেঁষে চলে যাওয়া সড়কটির নামকরণ করা হয়ে কমলা ভট্টাচার্য সড়ক, এ রাস্তার পাশেই ভাড়া থাকত উদ্বাস্তু কমলার পরিবার।

উল্লেখ্য, ১৯৬১ সালের ১৯ মে আধাসামরিক বাহিনীর গুলিতে আরও যারা নিহত হয়েছিলেন তারা হলেন—কানাইলাল নিয়োগী, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, হিতেশ বিশ্বাস, সত্যেন্দ্রকুমার দেব, কুমুদরঞ্জন দাস, সুনীল সরকার, তরণী দেবনাথ, শচীন্দ্র চন্দ্র পাল, বীরেন্দ্র সূত্রধর এবং সুকোমল পুরকায়স্থ। ওইদিন বুকে গুলিবিদ্ধ কৃষ্ণকান্ত বিশ্বাস ২৪ বছর শারীরিক যন্ত্রণা ভোগের পর ১৯৮৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন। এ ছাড়াও আসামে বাংলা ভাষার জন্য ১৯৭২ সালের ১৭ আগস্ট বিজন চক্রবর্তী নামে একজন শহীদ হন। আর ১৯৮৬ সালের ২১ জুলাই শহীদ হন আরও দুজন। তারা হলেন জগন্ময় দেব ও দিব্যেন্দু দাস।

লেখক : সাংবাদিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড ইউনিভার্সিটি ও বিডব্লিউএবি এর মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই

রাজবাড়ীতে মিলছে না পানি

গাছ লাগিয়ে চ্যাম্পিয়ন হতে চায় ছাত্রলীগ

হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা মানুষের জন্য বড় সুযোগ : প্রতিমন্ত্রী

বায়ুদূষণের শীর্ষে কাঠমান্ডু, ঢাকার অবস্থান কত?

কলকাতা-পাঞ্জাবের ম্যাচে রেকর্ডের পর রেকর্ড

ফলন ও দাম ভালো হওয়ায় তিল চাষে ঝুঁকছে সদরপুরের কৃষকরা

আমেরিকা ছাড়িয়ে ইউরোপে ইসরায়েলবিরোধী আন্দোলন

আগামী ৯ মে পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা চুয়েট

ক্ষমতার জন্য বিদেশি প্রভুদের দাসত্ব করছে বিএনপি : ওবায়দুল কাদের

১০

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পটকা ফাটানো নিয়ে সংঘর্ষে নিহত ১

১১

দেশের মানুষের প্রধান চাওয়া সুষ্ঠু নির্বাচন : ইসি হাবিব

১২

শেরেবাংলার মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা

১৩

দুর্ঘটনার কবলে ইসরায়েলি নিরাপত্তামন্ত্রী

১৪

প্রেমের জন্য দিনটি ভালো

১৫

নরসিংদীতে হিটস্ট্রোকে শিশুর মৃত্যু 

১৬

রাজধানীর যেসব এলাকায় আজ গ্যাস থাকবে না

১৭

বৃষ্টিতে ভিজল সিলেট

১৮

শনিবার রাজধানীর যেসব এলাকায় যাবেন না

১৯

ইতিহাসের এই দিনে আলোচিত যত ঘটনা

২০
*/ ?>
X