বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১
আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক
প্রকাশ : ২৮ অক্টোবর ২০২২, ০৬:৩৫ এএম
অনলাইন সংস্করণ

সবাই তথ্য পাওয়ার অধিকার রাখে

সবাই তথ্য পাওয়ার অধিকার রাখে

সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণকে সঠিক তথ্য দেওয়া গণমাধ্যমের কাজ। মানুষ প্রজাতন্ত্রের সব তথ্য পাওয়ার অধিকার রাখে। সংবিধান সে অধিকার আমাদের দিয়েছে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু আমাদের যে সংবিধান দিয়েছেন, সেখানে স্পষ্টভাবে লেখা আছে যে, এই প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ। জনগণ যদি প্রজাতন্ত্রের মালিক হয়, তাহলে সেই প্রজাতন্ত্রের সব তথ্য পাওয়ার অধিকার তার আছে

গণমাধ্যম জীবনের দর্পণ। গণতান্ত্রিক সমাজে গণমাধ্যমের কোনো বিকল্প নেই। ওয়াল্টার ক্রনকিট নামে মার্কিন একজন সম্প্রচার বিশেষজ্ঞ/সাংবাদিক বলেছিলেন, ‘গণতন্ত্রকে কার্যকর রাখতে হলে গণমাধ্যমের কোনো বিকল্প নেই।’ আমার মনে হয়, আমরা একবিংশ শতাব্দীর এ সময়ে এসে উন্নয়ন ও তথ্যপ্রযুক্তির যে সমন্বয় লক্ষ করছি, তাতে গণমাধ্যমের প্রাচীরগুলো পর্যায়ক্রমে ভেঙে পড়ছে।

এখন মুদ্রণমাধ্যম, সম্প্রচারমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম—এগুলো একটি অপরটির সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে গেছে এবং এ সময়টা গণমাধ্যমের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য অত্যন্ত কঠিন সময়। কারণ গণমাধ্যম ও সামাজিকমাধ্যমের মধ্যে যে প্রতিযোগিতা তাতে কে কখন এগিয়ে যায়, এটিও অনেক সময় অনুমান করা যায় না।

গণমাধ্যমের মূল কাজ সত্য প্রকাশ করা, সত্যের অন্বেষণ করা। সে কারণেই আমরা সাংবাদিকদের সত্যের সৈনিক বলে অভিহিত করি এবং সত্য প্রকাশের ঝুঁকি সাংবাদিকরা নেয় বলেই আমরা লক্ষ করি, ইউনেস্কো মহাপরিচালকের ওয়েবসাইটে গেলে দেখা যায়, প্রতিদিনই তিনি কোনো না কোনো সাংবাদিক হত্যার জন্য নিন্দা ও শোক প্রকাশ করছেন।

আহত কোনো সাংবাদিকের জন্য সমবেদনা প্রকাশ করছেন। এই যে হত্যা ও আহত হওয়ার ঘটনাগুলো ঘটে সেটার কারণ কী? কারণ হচ্ছে সত্যের নানা শত্রু আছে, সত্য প্রকাশের ঝুঁকি আছে। আর সে ঝুঁকি নিয়ে সাংবাদিকরা সাংবাদিকতা করেন।

নোবেলজয়ী রুশ সাহিত্যিক আলেক্সান্দ্র সলজেনিৎসিন বলেছিলেন, ‘মানুষের কাজ হচ্ছে মিথ্যাকে পরিহার করা, আর শিল্পী, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীদের কাজ হচ্ছে মিথ্যাকে পরাভূত করা। একজন মানুষ একটি সত্য শব্দ উচ্চারণ করে তার ওজন পুরো পৃথিবীর থেকেও বেশি হয়ে যায়।’

আলেক্সান্দ্রকে তার সত্যবাদিতার কারণে দেশত্যাগ করতে হয়েছিল। আমরা জানি আমাদের সাংবাদিকরা দেশে বা বিদেশে যেখানেই কাজ করছেন ঝুঁকি নিয়েই কাজ করছেন। ঝুঁকি নেওয়ার মতো সাহসী লোক এখনো এই সমাজে আছে এবং সাংবাদিকতা পেশায় কাজ করার জন্য যেমন উৎসাহী নবীন ছেলেমেয়েরা আছে, ঠিক তেমনি এই শিল্পে বিনিয়োগ করার জন্য মানুষ এগিয়ে আসছে; কিন্তু কথা একটাই—গণমাধ্যম অর্থাৎ সংবাদমাধ্যম মূলত হবে সত্যপত্র।

নিত্য সত্য তথ্য পরিবেশন করা, এটাই হবে গণমাধ্যমের কাজ। সেটি থেকে সামান্য বিচ্যুতি ঘটলে গণমাধ্যম তার ভূমিকা ধরে রাখতে পারে না। আমরা সেই সত্য দ্বারা বলবান হব এবং সত্যের শক্তিতে আমরা এগিয়ে যাব।

বাংলাদেশে আমাদের সাংবাদিকতার দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই এ দেশের মানুষ সংবাদপত্রের সঙ্গে পরিচিত; কিন্তু সাক্ষরতার হার কম থাকায় পাঠক হয়তো কম ছিল। তবে আমাদের দেশে একটি প্রচলিত অভ্যাস আগে থেকেই চালু আছে, সংবাদপত্রের স্বল্প পাঠকরা নিজে পাঠ করেন, আশপাশের বহু মানুষকে সেই সংবাদের ব্যাপারে অবহিত করেন, যারা পত্রিকা পাঠ করার সুযোগ পান না।

গ্রামাঞ্চলে এরকম বহু মানুষ একজনের মাধ্যমে সবাই প্রধান বা মূল সংবাদ সম্পর্কে জানার সুযোগ পেয়ে থাকে। তবে বর্তমানে সাক্ষরতার সঙ্গে মানুষের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটেছে, ফলে সংবাদের জনপ্রিয়তা বেড়ে গেছে অনেকখানি। ফলে পত্রিকার সার্কুলেশন আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে।

আমরা পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক আমলে দেখেছি, পত্রিকার প্রচারসংখ্যা হয়তো কম ছিল; কিন্তু সমাজে তার প্রভাব ছিল ব্যাপক। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যের প্রভাব জনগণের মধ্যে যেভাবে ছিল তার মূল কারণ ছিল গণমাধ্যম। বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশতেন, তাদের আগাম কিছু বার্তা দিতেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর মিথস্ক্রিয়া কাজ করত, তা সংবাদপত্রকে সবসময় সঞ্জীবিত রেখেছে এবং সংবাদপত্র জনগণকে উদ্দীপিত করে তোলার ব্যাপারে ভূমিকা পালন করেছে।

আমার মনে হয়, সেই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় আজকের সাংবাদিকতায়ও একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আছে। তবে শুরুর কথা ধরে আবার বলতে হয়, সংবাদমাধ্যমের প্রাচীরগুলো ধীরে ধীরে নাই হয়ে যাচ্ছে। আগে সংবাদপত্র বা সম্প্রচারমাধ্যম বলতে যা বোঝা যেত, তা এখন অনেকখানি এক হয়ে যাচ্ছে। এখন প্রতিটি সংবাদপত্রের অনলাইন ভার্সন আছে। গণমাধ্যম ও সামাজিকমাধ্যমের যে সংযোগকরণ তা জনগণকে তথ্য পেতে নানাভাবে সাহায্য করছে। জনগণ দ্রুত সংবাদ পেয়ে যাচ্ছে এটি প্রযুক্তির একটি ভালো দিক।

কিন্তু এ প্রযুক্তির কিছু খারাপ দিক আছে, যেমন সামাজিকমাধ্যমে সম্পাদনার সুযোগ থাকে না। আর সম্পাদনা ছাড়া সাংবাদিকতা অর্থহীন। আমরা বলে থাকি, ‘এডিটিং ইজ দ্য সোল অব জার্নালিজম’। সম্পাদনাই সাংবাদিকতার প্রাণ। অতএব, যেখানে সম্পাদনা নেই, সেখানে সাংবাদিকতা থাকবে কীভাবে।

একজন সাংবাদিক যখন কাজ করেন, তিনি চান একটি স্বাধীন সম্পাদকীয় নীতিমালার অধীনে কাজ করবেন। এই স্বাধীন সম্পাদকীয় নীতিমালাটি কে নির্ধারণ করবেন? এটি সম্পাদক নির্ধারণ করবেন এবং শুধু নির্ধারণ নয়, তিনি এটিকে রক্ষা করবেন। সেই জায়গায় যারা বিনিয়োগকারী বা অর্থলগ্নিকারী, তাদের কিন্তু বেশি কিছু বলার সুযোগ থাকার কথা নয়।

কিন্তু সম্পাদকীয় স্বাধীনতার যে বিষয়টি নিয়ে সবসময় কথা বলে এসেছি, এখন বেশ কিছু ক্ষেত্রে সেটি কিছুটা হলেও ম্লান হয়ে যাচ্ছে। এখন যারা নতুনভাবে এ জগতে প্রবেশ করতে যাচ্ছেন, তারা এ বিষয়টি নিশ্চিত করবেন যে, সম্পাদকীয় স্বাধীনতা ছাড়া কোনো গণমাধ্যম জনগণের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারে না।

গণমাধ্যম জনগণের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। গণমাধ্যম হচ্ছে জনগণের মাধ্যম। সেখানে জনগণের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়। একবিংশ শতাব্দীতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে কোনো কিছু প্রকাশ বন্ধ করা বা কোনো কিছু গোপন করা সম্ভব নয়। এই বাস্তবতা মেনে নিতে হবে। সংবাদমাধ্যমে প্রতিযোগিতা থাকবেই।

প্রথমে সংবাদ উপস্থাপন করতে গিয়ে বস্তুনিষ্ঠতা যেন হারিয়ে না ফেলি, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রয়োজনে কিছুক্ষণ পরে বস্তুনিষ্ঠতা নিশ্চিত করে সংবাদ উপস্থাপন করতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে গণমাধ্যমের সুবর্ণ সুযোগ যাচ্ছে। এখন দেখার বিষয়, গণমাধ্যমের এ স্বাধীনতা গণমাধ্যম কতটুকু ব্যবহার করতে পারে।

সংবাদপত্রের প্রভাব যে খুব বেশি কমে গেছে, তা কিন্তু সঠিক নয়। তবে সংবাদপত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় আছে সম্প্রচারমাধ্যম, সামাজিকমাধ্যম। যেহেতু তথ্যের উৎস বহু ধারায় বিভাজিত হয়ে গেছে, তাই মনে হতে পারে সংবাদপত্রের গুরুত্ব কমে গেছে।

তবে আমরা খেয়াল করি, সংবাদপত্রের অনলাইন ভার্সন বহু জায়গায় বহু মানুষ পড়ছেন এবং এটি বেশ হিট করছে। এতে বোঝা যায় সংবাদপত্রের যে অভিগম্যতা, সেটা যেমন বেড়েছে, ঠিক তেমনি পত্রিকার ওপর নির্ভরশীলতাও বেড়েছে। সরকার এবং জনগণের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে গণমাধ্যম।

গণমাধ্যম যদি সত্য তথ্য জনগণের কাছে না দেয়, তাহলে গণতন্ত্র একসময় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে এবং দুর্বল হয়ে যায়। সঠিক বস্তুনিষ্ঠ তথ্যটা যখন জনগণের কাছে পৌঁছায়, তখন তাদের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা সহজ হয় যে, তারা কোন ধারায় সমর্থন জানাবেন।

যদি বস্তুনিষ্ঠ তথ্য জনগণকে না দিতে পারি, সে ব্যর্থতা গণমাধ্যমের। এ জন্য গণমাধ্যমকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। চতুর্থ স্তম্ভের কাজ যেটি সেই অনুযায়ী জনগণ প্রত্যাশা করে। একইভাবে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণকে সঠিক তথ্য দেওয়া গণমাধ্যমের কাজ।

মানুষ প্রজাতন্ত্রের সব তথ্য পাওয়ার অধিকার রাখে। কারণ আমাদের সংবিধান সে অধিকার আমাদের দিয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু আমাদের যে সংবিধান দিয়েছেন, সেখানে স্পষ্টভাবে লেখা আছে যে, এই প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ। জনগণ যদি প্রজাতন্ত্রের মালিক হয়, তাহলে সেই প্রজাতন্ত্রের সব তথ্য পাওয়ার অধিকার তার আছে।

লেখক : সাবেক ভিসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

হার দিয়ে আইপিএল শেষ মোস্তাফিজের

মিল্টন সমাদ্দার গ্রেপ্তার : আনন্দ মিছিল ও মিষ্টি বিতরণ করল মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ

ছাত্রীনিবাসের সামনে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গির ভিডিও ধারণ, অতঃপর...

মিল্টন সমাদ্দার গ্রেপ্তার, বরিশালে মিষ্টি বিতরণ

বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় উপজেলার চেয়ারম্যান হলেন অ্যাড. আব্দুস সালাম

এবার চাঁদের বুকে পা রাখবে পাকিস্তান

মিল্টনের বিরুদ্ধে কালবেলায় উঠে আসা সব অভিযোগ খতিয়ে দেখছে ডিবি

ডিবির ব্রিফিংয়ে উঠে এলো মিল্টনের কিডনি বিক্রির ইস্যু

দেশের মানুষ ন্যূনতম অধিকার থেকেও বঞ্চিত : মির্জা ফখরুল 

গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ঠেকাতে বাইডেনের দ্বারস্থ নেতানিয়াহু

১০

সারা দেশের স্কুল-কলেজ বন্ধ বৃহস্পতিবার

১১

নওগাঁয় ধান কাটতে গিয়ে কৃষকের মৃত্যু

১২

সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক উন্নতি হচ্ছে

১৩

মিল্টন সমাদ্দারের স্ত্রীকেও জিজ্ঞাসাবাদ করবে ডিবি

১৪

ভয়াবহ প্রতারণার জাল বিস্তার করেছেন মিল্টন : ডিবিপ্রধান

১৫

মিল্টন সমাদ্দারের আশ্রমে অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ

১৬

পরিসংখ্যানে বেড়েছে ইলিশ, বাস্তবে তেলের টাকাও উঠছে না জেলেদের

১৭

মিল্টন সমাদ্দারকে রিমান্ডে নেবে ডিবি

১৮

চিকিৎসাসেবাকে মানুষের আস্থার জায়গায় পরিণত করার আহবান প্রাণিসম্পদমন্ত্রীর

১৯

মানবপাচার ও টর্চার সেল ইস্যু উঠে এলো ডিবির ব্রিফিংয়ে

২০
*/ ?>
X