উন্নত দেশগুলোর জলবায়ু অর্থায়নের ক্ষেত্রে খাদ্য ব্যবস্থার রূপান্তরকে অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, খাদ্য ব্যবস্থার রূপান্তরকে উন্নত দেশগুলোর জলবায়ু অর্থায়নের জন্য অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। জলবায়ু-অভিযোজিত কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থার প্রতি যথাযথ মনোযোগ দেওয়া দরকার বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
সোমবার (২৪ জুলাই) ইতালিতে ইউএন ফুড সিস্টেম সামিট+২ স্টকটেকিং মোমেন্টের (ইউএনএফএসএস+২) একটি পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন।
রোমে জাতিসংঘের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের (এফএও) সদর দপ্তরে খাদ্য ব্যবস্থা এবং জলবায়ু ক্রিয়া সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া পাঁচটি প্রস্তাবের মধ্যে প্রথম প্রস্তাব এটি।
প্রধানমন্ত্রী তার দ্বিতীয় প্রস্তাবে বলেন, ‘ইউএন ফুড সিস্টেম কো-অর্ডিনেশন হাবকে গবেষণা ও উদ্ভাবনে আন্তঃবিভাগীয় সহযোগিতার প্রসারের মাধ্যমে জ্ঞান-ব্যবস্থাপনা বাড়াতে হবে।’
তৃতীয় প্রস্তাবটিতে শেখ হাসিনা বলেন, ‘নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে খাদ্য এবং সারের চাহিদা ও জলবায়ু সংকটের ইতিবাচক সমাধান বিস্তৃত করতে বেসরকারি খাতকে সক্রিয়ভাবে নিয়োজিত হতে হবে।’
তিনি তার চতুর্থ এবং পঞ্চম প্রস্তাবে বলেন, ‘ডেল্টা এবং উপকূলীয় অঞ্চলের মতো সবচেয়ে জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোকে কার্যকর কৃষি-খাদ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব জোরদার করতে হবে। ২০২১ সালে জাতিসংঘের খাদ্য ব্যবস্থা শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশসহ নেতৃত্বের সম্মতির আলোকে আমাদের জলবায়ু-সহনশীল খাদ্য ব্যবস্থার জন্য কোয়ালিশনকে সক্রিয় করতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জলবায়ু সংকটের জন্য বিশ্বকে একটি টেকসই ও রূপান্তরিত খাদ্য ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করতে হবে। ‘আর বিলম্ব না করে কী করা দরকার তা আমাদের নির্ধারণ করতে হবে। খাদ্য নিরাপত্তা এখন জলবায়ু ন্যায়বিচারের সঙ্গে সম্পর্কিত।’
তিনি বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, দীর্ঘস্থায়ী খরা, ব্যাপক বন্যা এবং পরিবর্তনশীল বৃষ্টিপাত বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে। বাংলাদেশে আমাদের উপকূলীয় ভূমি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং লবণাক্ততার অনুপ্রবেশের সম্মুখীন হচ্ছে এবং ধান উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। নদী ভাঙন, নগরায়ণ, শিল্প বৃদ্ধি এবং অন্যান্য নানা কারণে আমরা প্রতি বছর আবাদযোগ্য জমির হ্রাস দেখতে পেয়েছি।
শেখ হাসিনা বলেন, আধুনিক কৃষি-খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খল বিশ্বব্যাপী গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনে সবচেয়ে বড় অবদানকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ‘আমাদের খাদ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ, ব্যবহার এবং নিষ্পত্তি জলবায়ু-নিরপেক্ষ করতে বিনিয়োগ করা উচিত। এই উদ্দেশ্যে আমাদের যথেষ্ট রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং আন্তর্জাতিক জনমতের প্রয়োজন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ সম্প্রতি গ্লোবাল মিথেন অঙ্গীকারে যোগ দিয়েছে। ‘আমরা আশা করি, উদ্যোগের প্রধান পৃষ্ঠপোষকরা তাদের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ আর্থিক এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা নিয়ে আসবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার জি-২০ এর প্রস্তাবিত আন্তর্জাতিক জৈব জ্বালানি জোটের চারপাশের উন্নয়নগুলো অনুসরণ করছে। আমরা আমাদের ক্ষুদ্র কৃষকদের এমনকি সেচের জন্য সৌরবিদ্যুতের ব্যবহারকে উৎসাহিত করছি। মানসম্পন্ন কৃষি, কম নির্গমন ও পশুসম্পদ এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য আমাদের সাশ্রয়ী প্রযুক্তির সুবিধা দরকার।
তিনি বলেন, বঙ্গোপসাগরে আমাদের সামুদ্রিক এলাকায় টেকসই গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার জন্য আমি বিদেশি বিনিয়োগের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।
আরও পড়ুন: মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ : প্রধানমন্ত্রী
তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতার পরপরই বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘সবুজ বিপ্লবের’ ডাক দিয়েছিলেন। সময় আবার এসেছে জলবায়ু-স্মার্ট ‘কৃষি-খাদ্য বিপ্লবের’। আমাদের খাতকে রূপান্তর করার জন্য প্রকৃতি-ইতিবাচক সমাধান এবং উন্নত প্রযুক্তি উভয়ই প্রয়োগ করতে হবে।
কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনে সফলতা অর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশ অনন্যভাবে বিশ্বব্যাপী এই বিষয়ের নেতৃত্বে স্থান পেয়েছে। গত সপ্তাহে এ বিষয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য কপ-২৮-এর নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট তাকে ব্যক্তিগতভাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে আমাদের কৃষিবিজ্ঞানী এবং সম্প্রসারণ কর্মকর্তারা জলবায়ু-সহনশীল কৃষি-খাদ্য সমাধান তৈরিতে আমাদের কৃষকদের সঙ্গে একত্রে কাজ করছেন। আমাদের সরকার দেশের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বাজেট এবং সক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করেছে।
তিনি বলেন, গত ১৪ বছরে মোট ৬৯০টি উন্নত এবং উচ্চ ফলনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবন বা চালু করা হয়েছে। চাপ সহনশীল ধানের জাতগুলোর মধ্যে লবণাক্ততা প্রতিরোধী ১৪টি, পানিতে তলিয়ে যাওয়া ছয়টি, খরার সময়ের জন্য ১০টি, ঠান্ডা আবহাওয়ার জন্য চারটি এবং সাতটি উন্নত মানের।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা দীর্ঘ জলাবদ্ধতা ও খরা প্রতিরোধী ধানের জাত নিয়ে কাজ করছেন। পুষ্টির উন্নতির জন্য বাংলাদেশ অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, ডায়াবেটিক এবং প্রো-ভিটামিনের সঙ্গে আটটি জিঙ্ক সমৃদ্ধ ধানের জাত প্রবর্তন করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার ভাসমান কৃষি, ছাদ কৃষি, কিচেন গার্ডেন, হাইড্রোপনিক ও অ্যারো-পনিক কৃষির উন্নয়নে প্রণোদনা ও সহায়তা দিচ্ছে। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী ভাসমান সবজি উৎপাদন পদ্ধতি এখন স্থানীয়ভাবে পরিচালিত জলবায়ু অভিযোজনের অন্যতম সেরা উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
তিনি বলেন, দেশের কৃষকদের সহযোগিতা করার জন্য ডিজিটাল প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করছি। আমাদের সরকার সারা দেশে প্রায় ৫০০টি কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র স্থাপন করেছে। কৃষকরা একটি নির্দিষ্ট ফোন নম্বরে কল করে প্রাসঙ্গিক তথ্য চাইতে পারেন। ডেডিকেটেড ওয়েবসাইট এবং কমিউনিটি রেডিও কৃষি তথ্য প্রদানের জন্য পরিচালিত হচ্ছে। অনলাইনে সার ব্যবহারের পরার্মশ, সেচ পরিষেবা, কীটনাশক প্রেসক্রিপশন, ক্রপ-জোনিং অ্যাডভাইজরি, রাইস নলেজ ব্যাংক এবং অন্যান্য পরিষেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকারি অ্যাপের পাশাপাশি, কৃষি-প্রযুক্তি উদ্যোগগুলো প্রদত্ত পরিষেবাগুলোও তৃণমূলে জনপ্রিয়তা অর্জন করছে।
তিনি বলেন, গত ১৪ বছরে আমাদের বিশেষজ্ঞরা প্রায় ৬৪২টি নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও প্রবর্তন করেছেন। এগুলো জ্বালানি, পানি, সার, বীজ এবং কীটনাশক ব্যবহারের দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সাব-সাহারান আফ্রিকা এবং অন্যত্র জলবায়ু-চাপযুক্ত আবহাওয়ায় বাংলাদেশ তার দক্ষতা শেয়ার করতে প্রস্তুত।
মন্তব্য করুন
আর্কাইভ 
| ০৬ অক্টোবর ২০২৪ 
