কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২১ জুন ২০২৪, ০৯:৫৪ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

রাসেল ভাইপার থেকে বাঁচার উপায়

বিষধর সাপ রাসেল ভাইপার। ছবি : সংগৃহীত
বিষধর সাপ রাসেল ভাইপার। ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় হঠাৎ করেই ছড়িয়ে পড়েছে বিষধর সাপ রাসেল ভাইপার। ধানক্ষেত থেকে শুরু করে বাড়ির আঙ্গিনা যেকোনো জায়গায় মিলছে এই বিষধর সাপ। এতে করে একদিকে জনমনে আতংক সৃষ্টি হয়েছে, অন্যদিকে কৃষকরা এই সাপের ভয়ে ফসলি জমিতে কাজ করতে ভয় পাচ্ছে।

বর্ষার মৌসুমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এক আতংকের নাম রাসেল ভাইপার। গত কয়েক বছরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে এই সাপ। বিশেষ করে পদ্মা-যমুনা নদী ও তার অববাহিকায় বেশি দেখা মিলছে এই বিষধর সাপের। এ অবস্থায় রাসেল ভাইপার থেকে বাঁচার উপায় সবারই জেনে রাখা জরুরি।

রাসেল ভাইপার থেকে বাঁচার উপায়

শুধু রাসেল ভাইপার নয়, যে কোনো সাপের কামড়ের শিকার হলেই ওঝার কাছে যাওয়া যাবে না বলে জোর পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ বন বিভাগের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা এবং তরুণ বন্যপ্রাণী গবেষক জোহরা মিলা।

তিনি বলেন, ‘ওঝার কাছে না গিয়ে যত দ্রুত সম্ভব নিকটস্থ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা সদর হাসপাতাল বা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শে নির্দিষ্ট অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করতে হবে।’

এক্ষেত্রে সম্ভব হলে যে সাপ দংশন করেছে, তা চিহ্নিত করার জন্য সেই সাপের ছবি তুলে স্থানীয় বন কর্মকর্তা ও চিকিৎসককে দেখানোর পরামর্শ দেন জোহরা মিলা।

চিকিৎকদের মতে, রাসেল ভাইপার কামড়ালে আক্রান্ত ব্যক্তির হাত-পা অস্বাভাবিক ফুলে ওঠে। তাছাড়া রাসেল ভাইপারের দংশনের পর চিকিৎসা নিতে দেরী হলে রোগী মারা যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। মৃত্যুর কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে শক, পেশী প্যারালাইসিস, গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল রক্তক্ষরণ এবং কিডনি অথবা রেনাল ফেইলিয়র।

এ বিষয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যাপক মোহাম্মদ হাসান তারিক বলেন, রাসেল ভাইপারের দংশনের শিকার ব্যক্তির কিডনি দ্রুত অকেজো হতে শুরু করে। শরীর জ্বালাপোড়া করার পাশাপাশি দংশনের স্থানে পচন ধরে। একইসঙ্গে দংশনের শিকার ব্যক্তির রক্ত জমাট বাঁধতে শুরু করে। এসব ক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসা দেওয়া না হলে আক্রান্ত ব্যক্তিকে বাঁচানো সম্ভব হয় না।

সাপটির দংশনের শিকার ব্যক্তিদের চিকিৎসার অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে এই চিকিৎসক আরও বলেন, রাসেল ভাইপারের এন্টিভেনম থাকলেও সেটা খুব একটা কাজ করে না। ২০১৫ সালের দিকে আমরা প্রথম রাসেল ভাইপারে কামড়ানো রোগী পেয়েছিলাম। সে সময় আক্রান্ত হাত-পা কেটে ফেলেও রোগীকে বাঁচানো যায়নি। তাই সাপটির কবল থেকে বাঁচতে সচেতনতাই কার্যকর পথ।

রাসেল ভাইপার চিনবেন যেভাবে

জোহরা মিলা জানান, রাসেল ভাইপার (Russell's Viper) সাপটি ‘চন্দ্রবোড়া’নামেও পরিচিত। দেখতে মোটাসোটা তবে লেজ সরু হয়ে থাকে। মাথা ত্রিভুজাকার এবং ‘V’ আকৃতির সাদা রেখা আছে। শরীরের পৃষ্ঠতল বাদামী এবং বৃত্তাকার বা ডিম্বাকৃতির গাঢ় চিহ্নের তিনটি লম্বা সারি রয়েছে। সাপটির গায়ে ছোপ-ছোপ গোলাকার কালো দাগ থাকে।

তিনি বলেন, ‘সাপটি লম্বায় তিন থেকে পাঁচ ফুট পর্যন্ত হয়। মাথার তুলনায় ঘাড় বেশ সরু। এর গায়ের রং হালকা হলদে বাদামী। ফলে শুকনো ঘাস-পাতার মধ্যে নিজেকে সহজেই লুকিয়ে রাখতে পারে। সাধারণত মে-জুলাই মাসে এর প্রজননকাল। স্ত্রী সাপ ডিম দেওয়ার পরিবর্তে সাধারণত ৫-৫০টি বাচ্চা প্রসব করে।’

জোহরা মিলা বলেন, ‘সাপটি আতংকিত হলে বা হুমকি অনুভব করলে জিহ্বা বের করে প্রচণ্ড হিসহিস শব্দ করে। সাপটি সম্পর্কে যার ধারণা নেই তিনি এটিকে অজগর ভেবেই ভুল করবেন। এই প্রজাতিটি প্রাথমিকভাবে নিশাচর হিসেবে সক্রিয় অর্থাৎ সাপটি সাধারণত শিকার কিংবা খাদ্যের সন্ধানে রাতে বিচরণ করে।’

সাম্প্রতিককালে ফসলের বিশেষ করে ধানক্ষেতে রাসেল ভাইপারের উপস্থিতি নিয়ে এই বন্যপ্রাণী গবেষক বলেন, ‘ইঁদুর, ব্যাঙ, ছোট পাখি ও টিকিটিকি রাসেল ভাইপারের প্রিয় খাবার। যেহেতু ফসলের ক্ষেতে ইঁদুরের উৎপাত বেশি তাই খাবারের খোঁজে সেখানে গিয়ে হাজির হয় রাসেল ভাইপার।’

তার ভাষ্য, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে ঝোপঝাড়ের পরিমাণও কমে গেছে। ফলে অনেক সময় বসবাসের উপযুক্ত পরিবেশ ও পর্যাপ্ত খাবার পেয়ে ফসলের ক্ষেতের আশেপাশেই আবাস গড়েছে এই সাপ; বংশবিস্তার করছে। কৃষকরা যেহেতু ফসলের ক্ষেতেই কাজ করেন তাই তারাই বেশি রাসেল ভাইপারের আক্রমণের শিকার হচ্ছেন।’

জোহরা মিলা আরও বলেন, এই সাপের বিষ ‘হেমোটক্সিন’ হওয়ায় মাংস পঁচেই আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু হয়। সাপটির কবল থেকে বাঁচতে সচেতনতাই কার্যকর পথ। বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২ অনুযায়ী সাপটি সংরক্ষিত।

তথ্য অনুযায়ী, উত্তর এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতেই এ সাপের উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছিল। এ প্রজাতির সাপের সবচেয়ে বেশি উপস্থিতি ছিল রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়। তবে বর্তমানে দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায় এ প্রজাতির সাপের উপস্থিতি বেড়ে গেছে। তাই এ বিষধর সাপের উপদ্রব এখনই কমানো না গেলে পরে আরও মারাত্মক আকার ধারণ করবে বলে আশঙ্কা করছেন সচেতনমহল।

হঠাৎ কেন রাসেল ভাইপারের এত বিস্তৃতি

দেশের উত্তর-পশ্চিমাংশে বিশেষত পদ্মার চরাঞ্চল, নদী অববাহিকা ও বরেন্দ্র এলাকায় উঁচু-নিচু ঘাস বা ফসলের জমিতে এই সাপটি বেশি দেখা যায়। তবে বিগত কয়েক বছরে সাপটি দেশের নদী বিধৌত বেশ কয়েকটি জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে।

জোহরা মিলা বলেন, ‘এই সাপটি কোনো নির্দিষ্ট আবাসস্থলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, এবং যদিও এটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে খোলা, ঘাসযুক্ত বা ঝোপঝাড় এলাকায় পাওয়া যায়। তবে এটি বনে, আবাদী এবং কৃষিজমিতেও দেখা যেতে পারে।

এটি ঘন বন এড়িয়ে চলে এবং সমভূমি, উপকূলীয় নিম্নভূমি এবং পাহাড়ে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। এই প্রজাতিটি প্রায়ই গ্রামাঞ্চলে বসতির আশেপাশে পাওয়া যায়, যেখানে ইঁদুরের বিস্তার বেশি। অন্যান্য সাপের তুলনায় এই সাপের বংশবিস্তারের হারও বেশি। প্রজাতিভেদে বাংলাদেশের রাসেল ভাইপার ৬-৬৩টি বাচ্চা প্রসব করে।’

তিনি বলেন, দুই দশক আগেও রাসেল ভাইপার খুব একটা দেখা যেত না, কিন্তু গত এক দশকে এই সাপের সংখ্যা বা বিস্তার বেশ বেড়েছে।

তার ধারণা, রাসেল ভাইপার স্থলজ সাপ হলেও অনেকক্ষেত্রে এটি বন্যার পানিতে বা কচুরি পানায় ভাসতে ভাসতে বহুপথ অতিক্রম করতে পারে। বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চল থেকে সাপটি হয়তো এভাবেই পদ্মা নদী অববাহিকার জেলায় জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে।

সাম্প্রতিককালে ফসলের বিশেষ করে ধানক্ষেতে রাসেল ভাইপারের উপস্থিতি নিয়ে জোহরা মিলা বলেন, ‘ইঁদুর, ব্যাঙ, ছোট পাখি ও টিকিটিকি রাসেল ভাইপারের প্রিয় খাবার। যেহেতু ফসলের ক্ষেতে ইঁদুরের উৎপাত বেশি তাই খাবারের খোঁজে সেখানে গিয়ে হাজির হয় রাসেল ভাইপার।’

‘এ ছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে ঝোপঝাড়ের পরিমাণও কমে গেছে। ফলে অনেক সময় বসবাসের উপযুক্ত পরিবেশ ও পর্যাপ্ত খাবার পেয়ে ফসলের ক্ষেতের আশেপাশেই আবাস গড়েছে এই সাপ; বংশবিস্তার করছে। কৃষকরা যেহেতু ফসলের ক্ষেতেই কাজ করেন তাই তারাই বেশি রাসেল ভাইপারের আক্রমণের শিকার হচ্ছেন।’

‘তাছাড়া বসতবাড়ির আশপাশেও ইঁদুর ও টিকটিকি প্রাচুর্যতা বেশি থাকায় খাবারের খোঁজে রাসেল ভাইপার অনেক সময় লোকালয়ে চলে আসে এবং মানুষকে দেখে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে আক্রমণ করে বসে’, বলেন তিনি।

আইইউসিএনের ২০১৫ সালের লাল তালিকা অনুযায়ী রাসেলস ভাইপার বাংলাদেশে প্রায় হুমকিগ্রস্ত প্রাণীর তালিকায় রয়েছে। বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২ অনুযায়ী সাপটি রক্ষিত প্রাণী বলেও জানান এই বন্যপ্রাণী গবেষক ও বন কমকর্তা।

রাসেল ভাইপার তাড়িয়ে ফসল কাটার পরামর্শ

রাসেল ভাইপার অত্যন্ত বিপজ্জনক সাপ। তবে এর সামনে পড়লে আতংকিত না হয়ে সাবধানতার সাথে সে স্থান থেকে সরে যাওয়াই উত্তম বলে মনে করেন জোহরা মিলা। তবে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করলে সাপটির কবল থেকে নিরাপদ থাকা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

তার ভাষায়, ‘মাঠে কাজ করার সময় অবশ্যই গামবুট ও জিন্সের প্যান্ট পড়তে হবে যেন বাড়তি নিরাপত্তা পাওয়া যায়। কাজ শুরুর আগে ছোট বাঁশ বা লাঠি বা অন্য কিছু দিয়ে শব্দ করতে হবে যেন, আশেপাশে রাসেল ভাইপার থাকলে তা দূরে সরে যায়। জমিতে কাজের ফাঁকেও এটি করতে হবে।’

‘নিশ্চিত না হয়ে কোনোভাবেই ঝোপঝাড়, বড় ঘাস, পুরাতন ও দীর্ঘদিন পড়ে থাকা ইট-পাথরে হাত দেবেন না’, যোগ করেন তিনি।

সর্বোপরি যেসব এলাকায় এই সাপের উপদ্রব রয়েছে সেসব এলাকায় চলাফেরা ও দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে সার্বক্ষণিক সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত বলেও মনে করেন এই বন কর্মকর্তা।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মসজিদ টার্গেট করে চালানো হচ্ছে বিমান হামলা

আর এক জয় দূরে মেসির মায়ামি!

নির্যাতনের তথ্য চেয়ে আ.লীগের বিশেষ বার্তা

পূজায় বুড়িমারীতে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ থাকবে ৬ দিন

প্রতি সপ্তাহে সহায়তা দেবে জুলাই ফাউন্ডেশন : প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব

আন্দোলনে অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি, সেই যুবলীগ নেতা গ্রেপ্তার

নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করছে যমুনা গ্রুপ

জনবল নেবে স্যামসাং বয়সসীমা  ২১ থেকে ২৮ বছর 

বায়ুদূষণে শীর্ষে হ্যানয়, ঢাকার খবর কী

সুস্থ থাকতে ভাত নাকি রুটি, কী বলছেন চিকিৎসক

১০

লিটনের শরীরে ৫ শতাধিক বুলেট

১১

সপ্তম রাউন্ডে জমে উঠেছে প্রিমিয়ার লিগের লড়াই

১২

পাচারের টাকায় আমিরাতে মিনি সিটি নিয়ে আসিফের স্ট্যাটাস

১৩

শেরপুরে ভয়াবহ বন্যায় ৭ জনের মৃত্যু

১৪

তিন বিভাগে ভারি বৃষ্টির পূর্বাভাস গবেষকের

১৫

সুযোগ হাতছাড়া হওয়ার আক্ষেপ জ্যোতির

১৬

১৩ জেলায় দুপুরের মধ্যে ৬০ কিমি বেগে ঝড়ের শঙ্কা

১৭

ভারতীয় দলে আচমকা পরিবর্তন

১৮

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ২৮ শিক্ষার্থী বহিষ্কার

১৯

৮ বিভাগেই বৃষ্টির পূর্বাভাস

২০
X