সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে মানুষে মানুষে সাদৃশ্য ও ভিন্নতা অধ্যায়ে ‘শরীফ থেকে শরীফার গল্প’ শীর্ষক লেখাটি বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের করা উচ্চপর্যায়ের বিশেষজ্ঞ কমিটি। এ সুপারিশ প্রত্যাখ্যানের প্রতিবাদ জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ (এইচআরএফবি)। একইসঙ্গে সুপারিশ আমলে না নিয়ে বিশেষজ্ঞ কমিটি ভেঙে দিয়ে নতুনভাবে নিরপেক্ষ ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব-মুক্ত কমিটি গঠনের আহ্বান জানিয়েছে সংগঠনটি।
সোমবার (২০ মে) হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশের দেওয়া এক বিবৃতিতে এ প্রতিবাদ জানানো হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, বৈচিত্র্যতা আছে বলেই বহুস্তরিত সামাজিক সৌহার্দ্য বিদ্যমান। এই সৌহার্দ্য বজায় রাখতে বৈচিত্র্যতাকে সম্মান করতে হবে। এজন্য এই বৈচিত্র্যতাকে জানা-বোঝা জরুরি। বাংলাদেশ সংবিধানে লিঙ্গ-বর্ণ, ধর্ম বা যে কোনো বৈষম্যের ঊর্ধ্বে সবার সমতা ও সমঅধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করেছে। সেই বিবেচনায় সামাজিক বৈচিত্র্যতাকে জানার অন্যতম প্রাথমিক উদ্যোগ ছিল এই ‘শরীফ থেকে শরীফার গল্প’। এ ধরনের সুপারিশ গ্রহণ করা হলে তা হবে মূলত একটি প্রতিক্রিয়াশীল স্বার্থের দ্বন্দ্বে দুষ্ট গোষ্ঠীর সংবিধান পরিপন্থি অযৌক্তিক দাবির কাছে মাথা নত করা।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, নতুন শিক্ষাক্রমে সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের একটি অধ্যায়ে হিজড়া জনগোষ্ঠী সম্পর্কে জনসচেতনতামূলক একটি পাঠ রয়েছে। যা সরকার কর্তৃক হিজড়া সম্প্রদায়ের আইনগত স্বীকৃতির ধারাবাহিকতায় একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। অথচ এ গল্পটি নিয়ে একটি সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে বিতর্কের সূত্রপাত করা হয়। এ গল্প সংবলিত বইয়ের পাতা প্রকাশ্যে ছিঁড়ে ফেলা হয়। ওই সময় তাদের পক্ষ থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে নানা ঘৃণাত্মক, চরম বৈষম্যমূলক ও আক্রমণাত্মক বক্তব্য ছড়ানো হয়। এ ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদসমূহ যথাক্রমে ২৭ (আইনের দৃষ্টিতে সমতা), ২৮ (ধর্ম, প্রভৃতি কারণে বৈষম্য) এর সুস্পষ্ট লংঘন।
বিবৃতিতে বলা হয়, এ কমিটি নিয়ে শুরু থেকেই নানা সংশয় ছিল। কমিটির এ সুপারিশ প্রমাণ করছে নিরপেক্ষ পর্যালোচনা ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় স্বার্থের দ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে থেকে কমিটি কাজ করেনি। এ ছাড়াও সাংবিধানিক অঙ্গীকার ও এদেশের স্বাধীনতার মূল চেতনা, সব নাগরিকের সমান অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে এ কমিটি দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ (এইচআরএফবি) মনে করে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে সব জনগণের সমান অধিকারসহ মৌলিক মানবাধিকার, বৈচিত্র্যতার প্রতি সম্মান, বৈষম্যহীনতা ও সমতা, সহিষ্ণুতা, সহবস্থান প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে সচেতন ও সংবেদনশীল করে তোলার জন্য এমন বিষয়ভিত্তিক কনটেন্ট পাঠ্যপুস্তকে থাকা জরুরি ও অপরিহার্য। এর মাধ্যমে বাল্যকাল থেকেই শিশু-কিশোররা একজন সচেতন ও সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারবে। তাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ কাজ করবে। একটি সমতা ও মানবাধিকারভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য এমন শিক্ষা কারিকুলাম প্রয়োজন।
এইচআরএফবি’র অন্য দাবির মধ্যে রয়েছে- ১. বাংলাদেশের সংবিধান, মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা এবং মানবাধিকার মূলনীতি ও এমনকি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরকারের নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যতা না থাকায় এ সুপারিশ বিবেচনায় না নিয়ে বাতিল করা। ২. অনতিবিলম্বে এ কমিটি ভেঙে বিষয়টি পর্যালোচনা করার জন্য শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ এবং সংবিধান সম্মত সব নাগরিকের সমান অধিকার, সমতা, ন্যায্যতা ও বৈচিত্র্যতার প্রতি সত্যিকার শ্রদ্ধাশীল এবং সংবেদনশীল ব্যক্তি, নারী, জেন্ডার বিশেষজ্ঞ- এমন ব্যক্তিদের নিয়ে একটি নিরপেক্ষ কমিটি গঠন করা। ৩. ‘শরীফ থেকে শরীফার গল্প’ বাদ না দিয়ে ভুল বা অসঙ্গতি থাকলে নতুন কমিটির মাধ্যমে সংশোধন করে, আরও যুগোপযোগী করে পুনঃপ্রকাশ করা।
মন্তব্য করুন