ঝিনাইদহ-১ আসনের উপনির্বাচন আগামী ৫ জুন অনুষ্ঠিত হবে। একইসঙ্গে উপজেলা পরিষদের ৪র্থ ধাপের ৫৫টি উপজেলার নির্বাচনও ওইদিন অনুষ্ঠিত হবে। সকাল ৮টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে চলবে ভোটগ্রহণ।
মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল) বিকেলে নির্বাচন কমিশনের ৩২তম সভা শেষে কমিশন সচিব জাহাংগীর আলম গণমাধ্যমকে এই তথ্য জানান।
সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও ঝিনাইদহ-১ আসনের সংসদ সদস্য আব্দুল হাইয়ের মৃত্যুর পর আসনটি শূন্য ঘোষণা করে সংসদ সচিবালয়।
এর আগে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনিয়ম-কারচুপির অভিযোগে ঝিনাইদহ-১ (শৈলকুপা) আসনের নৌকার প্রার্থী মো. আব্দুল হাইকে বিজয়ী ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশনের জারি করা গেজেটের কার্যকারিতা স্থগিত করে হাইকোর্ট। ওই আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও বিশ্বাস বিল্ডার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নজরুল ইসলাম দুলাল বিশ্বাসের করা ইলেকশন পিটিশনের শুনানি নিয়ে বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামানের একক বেঞ্চ দুই মাসের জন্য এই স্থগিতাদেশ দেন।
নির্বাচনী প্রচার শুরুর পর থেকে একের পর এক আচরণবিধি লঙ্ঘন করতে থাকেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও ঝিনাইদহ-১ আসনের নৌকার প্রার্থী আব্দুল হাই ও তার সমর্থকরা। তারা স্বতন্ত্র প্রার্থীর লোকজনের ওপর হামলা-নির্যাতন, হুমকি-ধমকি প্রদান, পোস্টার-ব্যানার ছেঁড়াসহ এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি করে। তার সমর্থকরা যে কোনোভাবে নৌকার প্রার্থীকে জেতানোর কথাও বলতে থাকে। এ অবস্থায় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে বারবারই প্রশ্ন তুলেছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী ও তার সমর্থকরা। গত ১৩ ডিসেম্বর জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা ও নির্বাচন কমিশনের সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে চিঠি দেন স্বতন্ত্র প্রার্থী দুলাল বিশ্বাস। এ ছাড়া আচরণবিধি লঙ্ঘনের একাধিক অভিযোগও দাখিল করেন তিনি। এসব অভিযোগের তদন্ত করে একজন বিচারকের নেতৃত্বাধীন নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি অভিযোগের সত্যতা পায়।
এরপর নির্বাচন কমিশন আব্দুল হাই ও তার সমর্থকের বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা দায়ের করে। ইসি বাদী হয়ে একের পর এক মামলা দায়েরের পরও বেপরোয়া আচরণ ছিল নৌকা প্রার্থী ও তার সমর্থকদের। এ অবস্থার মধ্যেই গত ৭ জানুয়ারি ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের দিন হাকিমপুর ইউনিয়নের গোবিন্দপুর কেন্দ্রে প্রকাশ্যে নৌকায় সিল মারেন পোলিং অফিসার রাজু আহমেদ। ভোটের দিন দুপুরে ওই কেন্দ্রে গিয়ে সাংবাদিকরা এ চিত্র দেখতে পান। এ সময় সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে প্রকাশ্যে সিল মারার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। একই কেন্দ্রের দ্বিতীয় তলায়ও প্রকাশ্যে সিল মারার চিত্র চোখে পড়ে। এর ছবি তুলতে গেলে সাংবাদিকদের ওপর হামলা করে হাইয়ের অনুসারীরা। এ ছাড়া অনেক কেন্দ্রে জোর করে সিল মারার ঘটনা ঘটে। ভোটের দিন নির্বাচন বন্ধ করতে রিটার্নিং কর্মকর্তা বরাবর আবেদন জানান স্বতন্ত্র প্রার্থী। কিন্তু তিনি তাতে কর্ণপাত করেননি।
ভোট গ্রহণ শেষে ৭ জানুয়ারি বিকেলে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে ঝিনাইদহ-১ আসনে ৪৯ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে জানানো হয়। কাস্টিং ভোটের ব্যাপারে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক এস এম রফিকুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উল্লেখ ছিল। কিন্তু ওই আসনের চূড়ান্ত ফলে ৯ শতাংশ ভোট বেড়ে যায়। ওই আসনে ৫৮ দশমিক ২৭ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। এ কারণে ১ লাখ ৭৫ হাজার ৮৭৮ ভোট কাস্টিং দেখানো হয়, যা প্রথম প্রতিবেদনের চেয়ে বেশি ২৮ হাজার ৩৮৯ ভোট। এসব ভোট নৌকা প্রতীকে কাস্টিং দেখানো হয়। ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর তোলপাড় শুরু হয়। এরপর ৮ জানুয়ারি ভোটের ফলের গেজেট স্থগিত রাখতে এবং ১০ জানুয়ারি জারিকৃত গেজেট বাতিলের দাবিতে নির্বাচন কমিশনে আবেদন জানানো হয়। কিন্তু কোনো প্রতিকার না পেয়ে নির্বাচন পূর্ব ও পরবর্তী এসব ঘটনা তুলে ধরে হাইকোর্টে ইলেকশন পিটিশন করেন স্বতন্ত্র প্রার্থী দুলাল বিশ্বাস। আবেদনের শুনানি নিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার হাইকোর্ট আব্দুল হাইয়ের নির্বাচনী ফলের গেজেটের কার্যকারিতা স্থগিত করে আদেশ দেন।
এদিকে গত ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের পর ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার গ্রামে গ্রামে তাণ্ডব শুরু করে হাইয়ের অনুসারীরা। স্বতন্ত্র প্রার্থী দুলাল বিশ্বাসের সমর্থকদের শত শত বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে টিভি, ফ্রিজ, হাড়ি-পাতিলসহ ঘরের বিভিন্ন আসবাবপত্র ভাঙচুর করা হয়। লুট করা হয় টাকা, স্বর্ণালঙ্কার, গবাদিপশু ও ধান। পিটিয়ে আহত করা হয় নারীসহ অর্ধশত মানুষকে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে গোটা উপজেলায়। নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ঘরবাড়ি ছাড়ে অসংখ্য পরিবার। তাদের মধ্যে অনেকেই কৃষক—যারা পেঁয়াজ চাষ করেন। এলাকায় আসতে হলে স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের এসব নেতার কাছে চাঁদা দাবি করে হাইয়ের ক্যাডাররা। হামলা চালায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনের ওপরও। নির্বাচনের পর নতুন করে তাণ্ডব শুরু করায় শৈলকুপায় আতঙ্কের এলাকাতে পরিণত হয়।
মন্তব্য করুন