দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম খাত রেমিট্যান্স (প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ)। তাই এটি বাড়াতে বিদেশে জনশক্তির রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বন্ধ থাকা কয়েকটি দেশের শ্রমবাজার উন্মুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে সংযুক্ত আবর আমিরাত, সৌদি আরব ও মালয়েশিয়া অন্যতম। তবে জনশক্তি রপ্তানি যেভাবে বাড়ছে, সে অনুযায়ী রেমিট্যান্সপ্রবাহ বাড়ছে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন মূলত তিন কারণে এ সমস্যা। প্রথমত, বাংলাদেশ থেকে যেসব জনশক্তি বিদেশে যায়, তার অধিকাংশই অদক্ষ। ফলে তারা কাজের মজুরি কম পায়। দ্বিতীয়ত, মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতিতে মন্দা। ফলে শ্রমিকদের বেতন বাড়ছে না। এ ছাড়াও প্রবাসী আয়ের অন্যতম একটি অংশ মুদ্রা পাচারে ব্যবহার হচ্ছে। প্রবাসীরা বিভিন্নভাবে টাকা পাঠাচ্ছে, কিন্তু হুন্ডির কারণে তা দেশের বাইরেই থাকছে।
কোভিড-১৯ ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে প্রবাসী আয় অর্থনৈতিক অভিঘাত মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তবে বিগত বছরগুলোতে চাকরি নিয়ে বিদেশযাত্রার তুলনায় রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমে আসছে, যা অর্থনীতিতে নতুন শঙ্কার জন্ম দিয়েছে।
বিভিন্ন প্রকাশিত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রতি মাসে গড়ে এক লাখ বাংলাদেশি চাকরি নিয়ে বিদেশে গেছেন। কিন্তু ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত ৯ মাসে বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধির হার মাত্র ৫ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন অবৈধ পথে বা হুন্ডিতে যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে যোগ হচ্ছে না।
প্রবাসী ও আয়ের হিসাব
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২৩-এ বলা হয়, ২০১২-১৩ অর্থবছরে চাকরি নিয়ে বিদেশে গেছেন চার লাখ ৪১ হাজার বাংলাদেশি। ওই বছর রেমিট্যান্স এসেছিল ১৪ হাজার ৪৬১ মিলিয়ন ডলার, টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১৫ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা। পাঁচ বছর পর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে জনশক্তি রপ্তানি হয় ৮ লাখ ৮০ হাজারজন, রেমিট্যান্স আসে ১৪ হাজার ৯৮১ মিলিয়ন ডলার বা এক লাখ ২৩ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৯ লাখ ৮৯ হাজার জন বিদেশে কাজের উদ্দেশ্যে গমন করে এবং এ সময়ে রেমিট্যান্স এসেছে ২১ হাজার ৩১ মিলিয়ন ডলার, টাকায় যার পরিমাণ এক লাখ ৮১হাজার ৫৮০ কোটি।
২০১২-১৩ অর্থবছরে ৮ লাখ ৪১ হাজার জনশক্তি রপ্তানির বিপরীতে রেমিট্যান্স এসেছিল এক লাখ ১৫ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে ৯ লাখ ৮৯ হাজার জন বিদেশে কাজের উদ্দেশ্যে গমন করে এবং এ সময়ে রেমিট্যান্স এক লাখ ৮১ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা। অন্যদিকে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জনশক্তি রপ্তানি হয়েছে সাত লাখ ৩৪ হাজার, তার বিপরীতে রেমিট্যান্স এসেছে ১৪ হাজার ১৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা এক লাখ ৩৬ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা।
কেন এমন হচ্ছে
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম বলেন, দেড় কোটি প্রবাসী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ করছেন। তিনি বলেন, প্রবাসীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। কিন্তু রেমিট্যান্সের হার তার তুলনায় বৃদ্ধি না পাওয়ার মূল কারণ বৈধ চ্যানেলে (ব্যাংকের মাধ্যমে) প্রবাসী আয় আসছে না। কারণ প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে আয় পাঠাতে আগ্রহী নন। এর পেছনে মূল ভূমিকা হুন্ডির।
প্রথিতযশা এ অর্থনীতিবিদ মনে করেন টাকা পাচার দেশের এক নম্বর অর্থনৈতিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে এবং হুন্ডি এর পেছনে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করছে। তিনি বলেন, ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠালে প্রবাসীরা ডলারের বিপরীতে যে টাকা পান, হুন্ডিতে পাঠালে তার চেয়ে অতিরিক্ত চার থেকে পাঁচ টাকা পান। এ কারণে প্রবাসীরা হুন্ডিকে বেছে নিচ্ছেন এবং তাদের আয় আমাদের রেমিট্যান্সে সেভাবে যোগ হচ্ছে না।
করণীয় কী
ড. মইনুল ইসলামের মতে, প্রবাসীর সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমন আয়ের পরিমাণও বেড়েছে। কিন্তু সেই আয় আমাদের রির্জাভে যোগ করতে হলে প্রথমেই হুন্ডির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। আর এটি সম্ভব কেবল দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে। তিনি বলেন, হুন্ডি বন্ধ বা এর প্রভাব কমিয়ে আনতে গেলে প্রথমেই দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী, আমলা ও রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কারণ দুর্নীতিবাজরাই পুঁজি পাচারকারী এবং হুন্ডির মাধ্যমে প্রবাসীদের আয় বা রেমিট্যান্সের প্রধান ক্রেতা। এই শ্রেণিকে দমন করা গেলে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় তাদের (প্রবাসীর) সংখ্যার মতো দ্বিগুণ বা আরও বেশি হবে।
বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘প্রথমত, প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠাতে গিয়ে অনেক বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। দেখা যাচ্ছে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠাতে গেলে কোনো প্রবাসী বসে থেকে সঙ্গে সঙ্গেই দেশে টাকা পাঠাতে পারছেন। অথচ একই ব্যক্তি যদি সোনালী ব্যাংকের সৌদি শাখা বা অন্য কোনো দেশের অন্য কোনো ব্যাংকের ব্রাঞ্চে বসে টাকা পাঠান সে টাকা দেশে থাকা আত্মীয়স্বজনের হাতে পেতে সময় লেগে যায় পাঁচ দিন থেকে এক সপ্তাহ। শুধু তাই নয়, এর বাইরেও নানারকম বিড়ম্বনায় পড়তে হয় প্রবাসীদের। এ কারণে এমন অনেক প্রবাসী আছেন দেশে অর্থ কম পাঠিয়ে সে দেশেই রেখে দিচ্ছেন বা অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করছেন। এ কারণে দেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানি বাড়লেও রেমিট্যান্স বাড়ছে না। অবৈধ পথে আসছে বেশি। এর ফলে রেমিট্যান্সের কারণে যে পরিমাণে রিজার্ভ বৃদ্ধি পাওয়ার কথা সেটি হচ্ছে না।’
বিএমইটির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানি হয়েছে ছয় লাখ ১৭ হাজার ৫৭৬ জন, গত বছর এ সময়ে রপ্তানি হয়েছে ছয় লাখ ১৫ হাজার ১১৮ জন। মাসভিত্তিক পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, গত বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানি হয় এক লাখ ৯ হাজার ৬৯৮ জন, আর চলতি বছরের জানুয়ারিতে বিদেশে গেছেন এক লাখ চার হাজার ৫১৩ জন। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে জনশক্তি রপ্তানি হয় ৯২ হাজার ৫৬৯ জন, এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে হয় এক লাখ ৯ হাজার ৫৯ জন। গত বছরের মার্চ মাসে জনশক্তি রপ্তানি হয় এক লাখ ২০ হাজার ৩১৬ জন, এ বছরের মার্চ মাসে রপ্তানি হয় এক লাখ ৯ হাজার ৪৩৮ জন। গত বছরের এপ্রিল মাসে জনশক্তি রপ্তানি হয় এক লাখ ৩ হাজার ৯৭৫ জন, এ বছর হয়েছে ৭৮ হাজার ৮৮৩ জন। গত বছরের মে ও জুন মাসে জনশক্তি রপ্তানি হয় যথাক্রমে ৭৭ হাজার ৪২১ ও এক লাখ ১১ হাজার ৫৩৯ জন, চলতি বছরের একই সময়ে হয়েছে যথাক্রমে এক লাখ এক হাজার ৫৫৮ ও এক লাখ ১৪ হাজার ১৭৫ জন।
জনশক্তি রপ্তানির তুলনায় রেমিট্যান্স আসার চিত্রটি সম্পূর্ণ বিপরীত। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বেশির ভাগ সময়ই রেমিট্যান্সে নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা গেছে। এমনকি ঈদুল ফিতরের মাসেও কমেছে রেমিট্যান্সপ্রবাহ। ঈদুল ফিতরের মাস এপ্রিলে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৬৮ কোটি ৩৪ লাখ ডলার। এ ছাড়া মার্চে রেমিট্যান্স এসেছে ২০২ কোটি ২৪ লাখ ডলার, ফেব্রুয়ারিতে ১৫৬ কোটি ডলার, জানুয়ারিতে ১৯৫ কোটি ৮৮ লাখ ডলারের সমপরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে। যদিও বড় অঙ্কের রেমিট্যান্সপ্রবাহ দিয়েই অর্থবছর শুরু হয়েছিল। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে রেমিট্যান্স এসেছিল ২০৯ কোটি ৬৩ লাখ ডলার। পরের মাস আগস্টেও সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল। সেই মাসে ২০৩ কোটি ৬৯ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স এসেছিল। তবে ছন্দপতন ঘটে তার পরের মাস সেপ্টেম্বরে। সেই মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ১৫৩ কোটি ৯৬ লাখ ডলার। এরপরে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত রেমিট্যান্সপ্রবাহ ২০০ কোটি ডলারের নিচেই ছিল। মার্চে রেমিট্যান্সপ্রবাহ ২০০ কোটির ঘর ছাড়ালেও এপ্রিলে তা আবার ২০০ কোটির নিচে নেমে যায়। অর্থবছরের শেষ মাস জুনে তা আবার ২০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। যার ফলে অর্থবছর শেষে ২ হাজার ১৬১ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে।
মন্তব্য করুন