মেঘনাপারের হাতিয়া উপজেলার বাসিন্দা রাবেয়া বেগম (৫৯)। দীর্ঘদিন হাঁটু-কোমর ব্যথায় ভুগছেন। ডাক্তার দেখিয়েছেন বিএসএমএমইউ বহির্বিভাগে। মেট্রোযোগে যাচ্ছিলেন দিয়াবাড়ি ছেলের বাসায়। যাত্রাপথে তার সঙ্গী অষ্টম শ্রেণিপড়ুয়া নাতনি আঞ্জুমান।
প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে রাবেয়া বেগম বলেন, ‘ট্রেন চালু ওয়নের আগে একবার আইছিলাম। জ্যামের কষ্ট, দূরের কষ্ট। ভাড়াও লাগত বেশি। আইলে দিন শেষ ওই (হয়ে) যাইতো। ওন আর সম লাগে না। বউরে (ছেলের বউ) দেই আইছি চুলায় ভাত বসাইছে, যাই গরম ভাত খাইউম (খাব)। অল্পদিনে ঢাকা এমন বদলাইছে বিশ্বাস ওয় না (হয় না)।’
আঞ্জুমান বলে, ‘আব্বুর অফিস বাংলামোটর। আম্মু উত্তরায় আমার স্কুলে পড়ান (শিক্ষিকা)। আব্বু আগে ছুটির দিন ছাড়া সময় দিতে চাইতেন না। তেমন দেখাও হতো না। এখন রোজ তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরেন। ছোটো ভাইসহ আমাকে পড়াতে বসান। মাঝেমধ্যে আমরা বাইরে ঘুরতে যাই।’
রাজধানীর হাজারো পরিবার এমন পরিবর্তনের সাক্ষী। বাঁচবে সময়, বাঁচবে পরিবেশ, যানজট কমাবে মেট্রোরেল এমন ভিশন যেন বাস্তবে ধরা দিয়েছে।
তারা বলছেন, দিয়াবাড়ি থেকে মতিঝিল অংশে চালু হওয়া এমআরটি-৬-এর মধ্য দিয়ে মেট্রোযুগে প্রবেশে গণপরিবহন ব্যবস্থায় বিপ্লব সৃষ্টি হয়েছে। দ্রুতগামী, নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, সময়সাশ্রয়ী, বিদ্যুৎচালিত ও পরিবেশবান্ধব হওয়ায় দিনদিন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে পরিবহনটি। দেশে প্রথম পাতাল ও উড়ালের সমন্বয়ে এমআরটি-১ চালু হলে গণপরিবহনব্যবস্থায় ঢাকা মহানগরী ও পার্শ্ববর্তী এলাকা যানজট নিরসনে আরেক ধাপ এগিয়ে যাবে।
পাতাল মেট্রোরেল (এমআরটি লাইন-১) দুটি রুটে বিভক্ত। এর মধ্যে বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত রুট হবে পাতাল এবং নতুন বাজার থেকে পিতলগঞ্জ ডিপো পর্যন্ত পূর্বাচল রুট হবে উড়াল। ৩১.২৪১ কিলোমিটার দীর্ঘ দুই অংশের মধ্যে বিমানবন্দর পাতাল রেল অংশের দৈর্ঘ্য ১৯.৮৭২ কিলোমিটার। পূর্বাচল রুটের দৈর্ঘ্য ১১.৩৬৯ কিলোমিটার। মোট ২১টি স্টেশনের মধ্যে বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর রুটে ১২টি এবং পূর্বাচল রুটে থাকবে ৯টি।
মেট্রোরেলের পাতাল অংশের টানেল নির্মাণ করা হয়েছে মূল সড়ক থেকে মাটির ১০ মিটার গভীরে। উড়াল স্টেশনের সিঁড়ি, লিফট ও এস্কেলেটর ব্যবহার করে যেমন রাস্তার এপার-ওপার যাতায়াত করা যাবে, তেমনই সাধারণ সড়কের আন্ডারপাসের মতো পাতাল স্টেশনের সিঁড়ি, লিফট ও এস্কেলেটর ব্যবহার করে সড়কের এপার-ওপার যাতায়াত করতে পারবেন যাত্রী ও পথচারীরা। তবে সাধারণ পথচারীরা উড়াল বা পাতাল স্টেশনের পেইড জোন বা মূল প্ল্যাটফরমে যেতে পারবেন না।
১৭টি স্টেশনবিশিষ্ট উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত এমআরটি-৬ নির্মাণের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো হচ্ছে এমআরটি-১ নির্মাণের ক্ষেত্রে। দেখা যায়, যেসব এলাকা ইতোমধ্যে নগরীতে পরিণত হয়েছে এবং ট্র্যাফিক ঘনত্ব বেশি, সেসব এলাকায় উড়াল মেট্রোরেল সড়কের মাঝ (মিডিয়ান) বরাবর নির্মাণকালে জনদুর্ভোগ বেশি। অন্যদিকে নগরীর পার্শ্ববর্তী এলাকায় ট্র্যাফিক ঘনত্ব ও জনবসতি কম হওয়ায় উড়াল মেট্রোরেল নির্মাণকালে জনদুর্ভোগ নেই বললেই চলে। এ প্রেক্ষাপটে বিমানবন্দর রুট পাতাল এবং পূর্বাচল রুট উড়াল হিসাবে নির্মাণ করা হচ্ছে।
ডিএনটিসিএ সূত্রে জানা যায়, এমআরটি-১-এর নির্মাণকাজ মোট ১২টি প্যাকেজের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পিতলগঞ্জ ডিপোর ভূমি উন্নয়নসংক্রান্ত প্যাকেজের (সিপি-০১) বাস্তবায়ন অগ্রগতি ২৯ শতাংশ। অবশিষ্ট ১১টি প্যাকেজের দরপত্র আহ্বান কার্যক্রম বিভিন্ন পর্যায়ে প্রক্রিয়াধীন। পিতলগঞ্জ ডিপোর ভূমির অধিগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। ডিপো এক্সেস করিডর, বাড্ডা রিসিভিং সাব-স্টেশন এবং নর্দা, নতুনবাজার ও উত্তর বাড্ডা পাতাল মেট্রোরেল স্টেশনত্রয়ের ভূমি অধিগ্রহণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে সমবান্ধব পরিকল্পনায় বলা হয়েছে দ্বিতীয় ধাপে চালু হতে চলা এমআরটি-১-এর সম্ভাব্য সমাপ্তি হবে ২০২৬ সালে।
ভূমিকম্পে পাতাল রেল ক্ষতির মুখে পড়তে পারে কি না জানতে চাইলে ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (লাইন-১) প্রকল্প পরিচালক মো. আবুল কাসেম ভূঁঞা বলেন, যে কোনো মাত্রার ভূমিকম্পে পাতাল রেলের ক্ষতি হবে না। কারণ পাতাল অংশের টানেল মাটির অনেক গভীরে চারদিকের মাটি দ্বারা আষ্টেপৃষ্ঠে আবদ্ধ থাকে। তাই ভূমিকম্পের সময় টানেল ও আশপাশের মাটি একই ছন্দে নড়ে। এতে টানেলের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে না এবং পাতাল রেলপথের কোনো ক্ষতি হবে না।
উল্লেখ্য, অতি ঘনবসতিপূর্ণ এবং নিত্যদিনের অসহনীয় যানজটকবলিত ঢাকা শহরে উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তোলার স্বার্থে পাতাল রেল নির্মাণ পরিকল্পনা নেয় সরকার। এমআরটি লাইন-১ এর রুট অ্যালাইনমেন্ট ২০১৫ সালে প্রণীত আরএসটিপিতে (রিভাইজড স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান) প্রস্তাব করা হয় এবং সেই মোতাবেক সম্ভাব্যতা যাচাই ২০১৭-১৮ সালে সম্পন্ন হয়।
জাইকার সমীক্ষায় আন্তর্জাতিক মান ও রীতিনীতি, দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা এবং ঢাকায় অবকাঠামো নির্মাণ উপযোগিতার বিষয় বিবেচনা করে এমআরটি লাইন-১-এর উড়াল ও পাতাল পথ চূড়ান্ত করা হয়। দেশের প্রথম পাতাল মেট্রোরেল প্রকল্প এমআরটি-১-এর নির্মাণকাজ ২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মন্তব্য করুন