আমাদের সমবায় আইনটা এমন হওয়া উচিত, যা সমবায়ীদের, বিশেষ করে একদম নিচে যারা রয়েছেন সেসব সমবায়ীকে সাহায্য করবে বলে মন্তব্য করেছেন মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল। শুক্রবার (১ ডিসেম্বর) বিকেলে রাজধানীর নিউমার্কেটে দৈনিক কালবেলার প্রধান কার্যালয়ের সেমিনার কক্ষে ‘প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমবায় গঠনে অন্তরায় ও উত্তরণ: প্রসঙ্গ সমবায় সমিতি আইন’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে তারা এ মন্তব্য করেন।
বেসরকারি সংস্থা অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি) ও দৈনিক কালবেলা গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামালের সভাপতিত্বে ও কালবেলা মাল্টিমিডিয়ার শিফট ইনচার্জ অমিত হাসান রবিনের সঞ্চালনায় স্বাগত বক্তব্য দেন কালবেলার সম্পাদক ও প্রকাশক সন্তোষ শর্মা। সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন সমবায় অধিদপ্তরের অতিরিক্ত নিবন্ধক (সমিতি ব্যবস্থাপনা) আহসান কবীর।
বৈঠকে আলোচক ছিলেন এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আইনুন নাহার লিপি ও রাজশাহীর রুলফাওর পরিচালক আফজাল হোসেন। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. রিজওয়ানুল ইসলাম।
বৈঠকে সুলতানা কামাল বলেন, যেভাবে আইনগুলো আমাদের কাছে আসে, যেভাবে প্রয়োগ কিংবা বাস্তবায়ন হয় তাতে অসুবিধার মধ্যে পড়ি। কেন আমরা বারবার আইনগুলো নিয়ে অসুবিধার মধ্যে পড়ব? আইন ব্যবহারের এত প্রক্রিয়া থাকবে কেন? যাদের সহযোগিতার জন্য আইনটি করা তারা কেন অসুবিধায় পড়বেন? আইন তৈরি করবেন সংসদ সদস্যরা। কিন্তু সংসদ এখন অকার্যকর হয়ে আছে। সংসদে কোনো তর্ক-বিতর্ক হয় না। সংসদে আইন তৈরি হয় না। আইন তৈরি হয় মন্ত্রণালয়ের ভেতরে তাও মন্ত্রীদের দিয়ে না; হয় আমলাদের দিয়ে। আমলারা যেভাবে সমস্যার বিচার বিশ্লেষণ করেন ও সুবিধা-অসুবিধাগুলো দেখেন তাদের যে মনমানসিকতা তার প্রতিফলন আইনের মধ্যে দেখতে পাই।
তিনি আরও বলেন, স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে দেশ পরিচালনা হচ্ছে বলে শুনতে পাই। আমরা নাকি খুবই আরাম-আনন্দে আছি। উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন নেই। আমরা একটা বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থায় বাস করব, যেটা বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন, আমরা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে চেয়েছিলাম। আমরা রক্ত দিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছি একটি সাম্যের সমাজ হবে, সেটা আমরা করতে পারিনি। শুধু সমবায়ের ক্ষেত্রে নয়, প্রতিটি বেসরকারি সংগঠন, বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যে কোনো জায়গায় সরকারের আইনের মূল লক্ষ্য নিয়ন্ত্রণ করা। নিয়ন্ত্রণমুখী মনোভাব নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা হচ্ছে, যা সব জায়গায় দেখতে পাচ্ছি।
তিনি বলেন, দুর্নীতির কথাটা কিন্তু খুব বেশি কেউ উচ্চারণ করেননি। দেখা যায়, আইনের ব্যতিক্রম যেটা থাকে, সেটাই আইন হয়ে যায় এবং দুর্নীতির কারণে সেটাই চলতে থাকে। দুর্নীতি এখানে বিরাট বড় একটা ভূমিকা পালন করে। এ কারণে বিত্তশালীদের নিবন্ধন অনেক সহজ হয়ে যায়।
সুলতানা কামাল বলেন, সুনামগঞ্জে জলমহাল কার দখলে জানা আছে? তারাই আবার সংসদ সদস্য, আইনপ্রণেতা, আমলা। সংসদে দেখলাম এতদিন ছিল ব্যবসায়ী ৬০ শতাংশ, এবার কিন্তু আমলারাও ধীরে ধীরে ঢুকে যাচ্ছে। আমরা এমন সংসদ একটি পাব রাজনীতিকরা নেই.. তারা খুব কোণঠাসা। সারাজীবন রক্ত দিলেন, রাস্তায় হাঁটলেন সবকিছু করলেন কিন্তু সংসদে গিয়ে পেছনে বসে থাকলেন! সামনে কারা বড় বড় বিত্তশালী, যাদের পেশিশক্তি আছে, যারা আমলাতান্ত্রিক সুবিধা নিয়ে চলেছেন। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় আমরা থাকা অবস্থায় তারা এ প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। যেটা বেআইনি ও অন্যায়। কিন্তু সেটা ইলেকশন কমিশন চোখেও দেখছেন না, সেটা নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া আমরা দেখতে পাচ্ছি না।
তিনি বলেন, আমাদের সমবায় আইনটা এমন হওয়া উচিত, যা সমবায়ীদের, বিশেষ করে একদম নিচে যারা রয়েছেন সেসব সমবায়ীদের সাহায্য করবে।
বাংলাদেশের কৃষির বিষয়ে সুলতানা কামাল বলেন, এ কথা ঠিক যে কৃষির অভূতপূর্ব অগ্রগতি হয়েছে বাংলাদেশে। আমি মাথানত করে ক্ষুদ্র নারী কৃষকদের বলছি, তাদের জন্যই কিন্তু এটা হয়েছে। কিন্তু আমরা কৃষি ব্যাংকের দিকে তাকাই, কৃষি ব্যাংকের লোন কাদের কাছে যায়?
তিনি বলেন, কৃষিতে অন্তত ৯০ ভাগ কাজ নারীরা করেন। কাজেই সেখানে তাদের জন্য যদি একটা বিপণন ব্যবস্থা না হয়, তাদের জন্য যদি ম্যানেজমেন্টের ব্যবস্থা না করা যায়, এটা অন্যায়। আমি মনে করি এটা রাষ্ট্রীয় অপরাধ। এটা মানুষের স্বার্থের প্রতি রীতিমতো উপেক্ষা, যেটা গ্রহণযোগ্য নয়।
তিনি আরও বলেন, আমরা এমন একটা গভর্নমেন্ট পেয়েছি যেটা গভর্নেন্স ছাড়া আর সবকিছুতে উৎসাহিত। ব্যবসা, বিদেশ যাওয়া, দুর্নীতি করা, যে করেই হোক বিত্তশালী হওয়া, অতিরিক্ত ধনী হওয়ার জন্য যা কিছু করা দরকার, সমস্ত কিছু করবে; কিন্তু গভর্নেন্স বলে যে একটা বিষয় আছে, সেটা করবে না। সিন্ডিকেট বন্ধ করতে পারবে না, চোরাচালানিদের ধরতে পারবে না, মানিলন্ডারিং বন্ধ করতে পারবে না, ট্রাফিক কন্ট্রোল করতে পারবে না।
সুলতানা কামাল বলেন, আমাদের তো আন্দোলন করতে দেবে না। লাঠি বন্দুক তো তারা (আইন শৃঙ্খলাবাহিনী) ব্যবহারের জন্যই পেয়েছে। এবং সেই লাঠি বন্দুক তারা ব্যবহার করবে। সমবায়ীরা যখন আন্দোলন করতে যাবে, তাদের ওপর যে লাঠি বন্দুক ব্যবহার হবে না সেটার গ্যারান্টি কে দেবে! কাজেই লাঠি বন্দুকের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। পৃষ্ঠপোষকতার মানসিকতা আনতে হবে এবং আইন অবশ্যই জনবান্ধব হতে হবে, আইন অবশ্যই সমবায়বান্ধব হতে হবে।
মন্তব্য করুন