নানা চাপেও পররাষ্ট্র নীতি সমুন্নত রাখায় বাংলাদেশের প্রশংসা করে সফররত রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের চাপের মধ্যেও বাংলাদেশ তার স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতি বজায় রেখেছে। আমাদের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে বাইরের কিছু শক্তি হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করছে, যা গ্রহণযোগ্য নয়। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে আগামী অক্টোবরে জ্বালানি সরবরাহ শুরু হবে বলে জানান তিনি। এছাড়াও বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকটের সুরাহার পক্ষে রাশিয়া।
এদিকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন শান্তিপূর্ণ আলেচনার মাধ্যমে ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান করার আহ্বান জানিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার (৭ সেপ্টেম্বর) ঢাকা-মস্কো দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে বাংলাদেশ ও রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন। ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে সের্গেই ল্যাভরভ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে একটি মাইলফলক রচনা করলেন। কারণ এটিই কোনো রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রথম বাংলাদেশ সফর।
আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলন শেষে জাকার্তা থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা ১৭ মিনিটে বিশেষ বিমানে ঢাকায় আসেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন। সেখান থেকে তারা হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে আসেন। সেখানে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে নিজ নিজ দেশের নেতৃত্ব দেন। বৈঠকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন, রাশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কামরুল আহসান, বাংলাদেশে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেজান্ডার মন্টিটস্কিসহ দুদেশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অংশ নেন। বৈঠকের পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এই প্রথম আমি ঢাকায় এসেছি। বাংলাদেশ আমাদের অনেক পুরনো বন্ধু। আমাদের সম্পর্কের ভিত্তি হলো বন্ধুত্ব ও সমতা। করোনা মহামারীসহ নানা জটিল পরিস্থিতিতে দুদেশের রাজনৈতিক সংলাপ হয়েছে। এবারের বৈঠকের আলোচনা আরও নিবিড় হয়েছে। গত ৫০ বছরে আমাদের মধ্যে বাণিজ্য বেড়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পরই বাংলাদেশ আমাদের দ্বিতীয় বৃহত্তম অংশীদার। ২০২২ সালে আমাদের দুই দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার। সামনের দিনে ঢাকা-মস্কোর সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন ল্যাভরভ।
রুপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রকে দুদেশের ফ্লাগশিপ প্রোগ্রাম হিসেবে উল্লেখ করে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ নির্ধারিত সময়েই অগ্রসর হচ্ছে। এ প্রকল্পের জ্বালানি (নিউক্লিয়ার ফুয়েল) আগামী অক্টোবরে বাংলাদেশে আসবে। দুই দেশ প্রতিশ্রুতিশীল গ্যাস ক্ষেত্র প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে। বাংলাদেশে এলএনজি সরবরাহের কাজও রয়েছে। রাশিয়া থেকে বাংলাদেশের গম ও সার আমদানি সহজ করতেও দুদেশ কাজ করছে।
রুপপুরের প্রকল্পের অর্থ পরিশোধের সংকট নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে রুশ পরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অর্থ মেটানোর প্রক্রিয়া দ্রুত নিষ্পত্তিতে আমরা কাজ করছি। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে রূপপুর প্রকল্পে সরবরাহব্যবস্থা বিঘ্নিত হচ্ছে। তাই লেনদেন সমস্যা সুরাহার জন্য ডলারের বিকল্প হিসেবে স্থানীয় মুদ্রায় পেমেন্টর বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
যুক্তরাষ্ট্র ইস্যুতে এক প্রশ্নের জবাবে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ইন্দো-প্যাসিফিকের নামে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের বন্ধুরা অকাস এবং কোয়াড গঠনের মাধ্যমে ব্লক রাজনীতির চর্চা তৎপরতা চালাচ্ছে। বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করেছে রাশিয়া। আমরা যদি পরিস্থিতি বিবেচনা করি, তাহলে দেখতে পাই তাদের লক্ষ্য চীনকে প্রতিহত ও রাশিয়াকে একঘরে করে ফেলা। যা কার্যত ন্যাটোর সম্প্রসারণেরই অংশ। এটা আসিয়ানের স্পিরিটের পরিপন্থি। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগীরা আসিয়ানের নিরাপত্তাব্যবস্থাকে অবহেলা করতে চায়। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের চাপের মধ্যেও বাংলাদেশ তার স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতি বজায় রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের বন্ধুরা বাংলাদেশের ওপর শক্তি প্রয়োগের চেষ্টা করছে, যা ঠিক নয়। বাংলাদেশ-রাশিয়া একসঙ্গে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কাজ করবে এবং পরস্পর পরস্পরকে সহযোগিতা করবে।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে ল্যাভরভ বলেন, রোহিঙ্গা সংকট নিরসনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের বাইরে আর কারও সংযুক্তি ঠিক হবে না। বাইরের লোক কম থাকলেই ভালো। বাইরের সম্পৃক্ততা সীমিত করতে হবে। বাইরের হস্তক্ষেপ হিতে বিপরীত হতে পারে। আমরা দ্বিপক্ষীয় আলাপ-আলোচনা করে সমস্যার সমাধানকে সমর্থন করি। প্রয়োজন হলে আমরা মিয়ানমারে আমাদের বন্ধুদের এ ব্যাপারে কাজ করার জন্য অনুরোধ করতে পারব।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়ার একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, 'আমাদের পররাষ্ট্র নীতি হচ্ছে সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়। আমরা ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি বজায় রাখি। আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থ অনুযায়ী পরিচালিত হই। এখন পর্যন্ত আমরা স্বাধীন, সার্বভৌম পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছি। আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে আলোচনা ও সংলাপের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করা। আমাদের অবস্থান খুব পরিষ্কার। অন্য অনেক অঞ্চলে ছায়াযুদ্ধ। কিন্তু আমরা এ অঞ্চলে কোনও ছায়াযুদ্ধ দেখতে চাই না। আমরা মনে করি, সব সমস্যার সমাধান আলোচনা ও সংলাপের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হতে হবে।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী মস্কোর সঙ্গে ঢাকার গভীর সম্পর্কের কথা তুলে ধরে বলেন, মুক্তিযুদ্ধে রাশিয়া আমাদের সর্বাত্মকভাবে সাহায্য করেছে। মুক্তিযুদ্ধের পর দেশ গঠনে তারা আমাদের অনেক সাহায্য করেছে। আমাদের সঙ্গে তাদের গভীর সম্পর্ক।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাশিয়ার প্রতি দ্রুত ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশ সংলাপ এবং আলোচনার মাধ্যমে যেকোনো সংকট সমাধানের পক্ষে।
যৌথ সংবাদ সম্মেলনের পর তার সম্মানে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দেয়া নৈশভোজে অংশ নেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী। আজ শুক্রবার সকাল ৯টায় গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন ল্যাভরভ। এরপর তিনি ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শণে যাবেন। সেখানে তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। এছাড়াও রাশিয়া ফেরত বাংলাদেশের সাবেক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ল্যাভরভের মতবিনিময়ের কথা রয়েছে। শুক্রবার দুপুরের আগেই রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে নয়াদিল্লির উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়ার কথা রয়েছে।
মন্তব্য করুন