কালবেলা ডেস্ক
প্রকাশ : ২৯ আগস্ট ২০২৩, ১১:২৭ পিএম
আপডেট : ৩০ আগস্ট ২০২৩, ১০:৪৪ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

পূর্বাভাসভিত্তিক অর্থায়ন ও সাড়াদান কমাতে পারে দুর্যোগের ঝুঁকি: গবেষণা

সভায় বক্তব্য দেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল হাসান। সৌজন্য ছবি
সভায় বক্তব্য দেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল হাসান। সৌজন্য ছবি

হাওর এলাকায় সাম্প্রতিককালে ঘন-ঘন আকস্মিক বন্যা ও বজ্রপাতের মতো দুর্যোগপ্রবণতা দেখা যাচ্ছে। মূলত নদীর তলদেশের গভীরতা হ্রাস পাওয়া, খাল ও অন্যান্য প্রাকৃতিক জলধারা হ্রাস ইত্যাদির সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশেষ করে উজান অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের তীব্রতা ও হার উভয়ই বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার ফলস্বরূপ, নিম্নাঞ্চলে আকস্মিক বন্যার সম্ভাবনা বেড়েছে।

তবে এ ধরনের দুর্যোগের আগেই আগাম সতর্কবার্তার পাশাপাশি পূর্ব-নির্ধারিত পদক্ষেপ এবং প্রাক-দুর্যোগ অর্থায়নের মাধ্যমে ঝুঁকি হ্রাস সম্ভব। এ ধরনের পদক্ষেপের ফলে দুর্যোগ পরবর্তী ত্রাণ সহায়তার উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে দুর্যোগ সহনশীলতাও বৃদ্ধি সম্ভব। মূলত পূর্বাভাসভিত্তিক সাড়দান কার্যক্রম একটি উদ্ভাবনী পদ্ধতি যার মাধ্যমে পূর্বাভাসের প্রেক্ষিতে সম্ভাব্য আপদের ঘটার পূর্বেই যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে পার্বত্য অঞ্চলে তুষারপাতের পরিমাণ বৃদ্ধিও আকস্মিক বন্যার আরেকটি সম্ভাব্য কারণ। ২০২২ সালে আকস্মিক বন্যার তীব্রতা নিকট অতীতের সমস্ত রেকর্ড অতিক্রম করেছে এবং একই বছরের জুনে প্রায় তিনবার উত্তরপূর্বাঞ্চলের হাওর অঞ্চলসমূহ বন্যায় প্লাবিত হয়।

নিড অ্যাসেসমেন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ (এনএডব্লিউজি) প্রাথমিক প্রভাব মূল্যায়ন দেখা যায়, এই আকস্মিক বন্যায় ৯টি জেলায় আনুমানিক ৭২ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং সেখানে ১ হাজার ৬০৫টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। অস্থায়ীভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে ৪ লাখ ৮১,৮২৭ জন।

পাশাপাশি ৮৩ হাজার ৩৯৪ হেক্টর ফসলি জমি, ৪৯ হাজার ৮৮৫টি স্যানিটেশন সুবিধা, ৪৪ হাজার ২৫৪টি পানির উৎস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্লাবন অঞ্চলের ব্যাপ্তি এবং ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের সংখ্যায় উভয়ই তুলনামূলকভাবে বেশি ছিল সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলায়।

২০২২ সালের বন্যা নিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের (MoDMR) প্রভাব ও ক্ষতির প্রতিবেদনে দেখা যায়, সিলেট, সুনামগঞ্জ এবং নেত্রকোনা জেলায় ক্ষতির অর্থনৈতিক পরিমাণ যথাক্রমে ৫০৭.৯ মিলিয়ন, ১৪৬.৫ মিলিয়ন এবং ৩৮.৩ মিলিয়ন ডলার। আকস্মিক বন্যার পাশাপাশি হাওর অঞ্চলের মতো বিস্তীর্ণ জলাশয়পূর্ণ অঞ্চলগুলোতে প্রাক-বর্ষা ও বর্ষা ঋতুতে তাপমাত্রার আধিক্যের কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বজ্রপাতের হারও বৃদ্ধি পেয়েছে।

বাংলাদেশে বজ্রপাতের চিত্র এবং সচেতনতা তৈরির জন্য প্রস্তুতকৃত একটি কেস স্টাডি অনুসারে, বাংলাদেশ ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যে বেশি বজ্রপাতে জন্য একটি হটস্পট এলাকা যেখানে বর্ষাকালে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে গড়ে ৪০টি বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে।

ফাউন্ডেশন ফর ডিজাস্টার ফোরামের অনুমান ২০১০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে বজ্রপাতে ৩ হাজার ২৭৩ জন মারা গেছেন। এরমধ্যে শুধু ২০২১ সালে ২৬৩ জন এবং ২০২২ সালে ২৪৭ জন মারা গেছেন।

গবেষকদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সাথে মিলিত হয়ে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের তীব্রতা এবং সম্ভাব্যতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে; সেইসাথে বিপজ্জনক এলাকায় বসবাসকারী সম্প্রদায়ের উপরও ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে বিগত কয়েক দশকে, বাংলাদেশ সরকার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক অগ্রগতি করেছে। উন্নত প্রযুক্তি এবং প্রাপ্ত তথ্য উপাত্তের মাধ্যমে দুর্যোগ পূর্বাভাসের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে।

বাংলাদেশ সরকারের দুর্যোগ সম্পর্কিত স্থায়ী আদেশাবলী (২০১৯)-এ পূর্বাভাসভিত্তিক সাড়াদান/ অর্থায়ন (এফবিএ/এফ) সংক্রান্ত একটি জাতীয় টাস্কফোর্স গঠনের নির্দেশনা রয়েছে। পূর্বাভাসভিত্তিক কার্যক্রম দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় একটি নতুন মাত্রা যোগ করে যেখানে সুফল- এর মতো প্রকল্পসমূহ পূর্বাভাসভিত্তিক কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাস্তবসম্মত প্রমাণ তৈরি করছে।

স্কেলিং আপ ফোরকাস্ট বেইজড অ্যাকশন অ্যান্ড লার্নিং ইন বাংলাদেশে, যা ব্যাপকভাবে সুফল প্রকল্প নামে পরিচিত, একটি কনসোর্টিয়াম প্রকল্প যা ইউরোপীয় ইউনিয়ন সিভিল প্রোটেকশন অ্যান্ড হিউম্যানিটারিয়ান এইড অপারেশনস (একো) এর অর্থায়নে কেয়ার বাংলাদেশের নেতৃত্বে কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড এবং রাইমস এর অংশগ্রহণে বাস্তবায়িত হচ্ছে।

উত্তর-পশ্চিম মৌসুমি বন্যাপ্রবণ এলাকায় ২০১৯ সাল থেকে প্রকল্পটি কাজ শুরু করে। প্রকল্পের গবেষণা থেকে এটি স্পষ্ট যে - পূর্বাভাসভিত্তিক কার্যক্রম এর মাধ্যমে ক্ষতি কমিয়ে খানাপ্রতি ২৪৪ ডলার সঞ্চয় করা সম্ভব।

মৌসুমি বন্যার ক্ষেত্রে পূর্বাভাসভিত্তিক কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে অর্জিত অভিজ্ঞতা থেকে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আকস্মিক বন্যা এবং বজ্রপাত প্রবণ হাওর এলাকায় প্রকল্পটি এর কাজ প্রসারিত করছে। কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর ও বগুড়ার পাশাপাশি এই প্রকল্পটি এখন সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনায় পূর্বাভাসভিত্তিক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করবে।

সুফল প্রকল্পের অন্যতম লক্ষ্যই হলো কমিউনিটি এবং প্রতিষ্ঠানসমূহের পূর্বাভাসভিত্তিক কার্যক্রমে সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ঝুঁকি হ্রাস করা। ইতোমধ্যেই প্রকল্পটি বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের (FFWC) সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রভাবভিত্তিক পূর্বাভাস প্রদান এবং মৌসুমি বন্যার ক্ষেত্রে বর্ধিত সময়ে পূর্বাভাস প্রদানে কাজ করছে।

প্রকল্পটি আগামীতে বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাথে আকস্মিক বন্যার আগাম সতর্কতা উন্নত করতে এবং স্থানীয় সময়ে বজ্রপাতের পূর্বাভাস প্রদানে কাজ করবে। সুফল প্রকল্পের মূলে হলো স্থানীয় জনগণ যাদের উন্নতিই এর কাজের কেন্দ্রবিন্দু। পূর্বাভাস উন্নত করার সাথে সাথে প্রকল্পটি আগাম কার্যক্রম গ্রহণে অর্থায়নেও নিরলস কাজ করে যাচ্ছে।

বর্তমানে বাংলাদেশে পূর্বাভাসভিত্তিক কার্যক্রম গ্রহণে কোনো সুনির্দিষ্ট অর্থায়ন ব্যবস্থা নেই। যদিও, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন-২০১২-এর অধীনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা তহবিল বিধিমালা-২০২১ অনুযায়ী সম্ভাব্য আপদের পূর্বেই কার্যক্রম গ্রহণে স্থানীয়ভাবে অর্থায়নের সুযোগ তৈরি রয়েছে।

ইসলামিক রিলিফ বাংলাদেশের সাথে যৌথভাবে সুফল কনসোর্টিয়াম ‘নিরাপদ’- সংস্থার মাধ্যমে উক্ত তহবিলের প্রয়োগ ও ব্যবহার সম্পর্কিত গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে যেখানে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক আতিকুল হক সার্বিক দিকনির্দেশনা প্রদান করেন।

এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৯ আগস্ট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরে সুফল কনসোর্টিয়ামের পক্ষে কেয়ার বাংলাদেশ একটি সভার আয়োজন করা হয় যেখানে গবেষণালব্ধ ফলাফল সমূহ উপস্থাপন করা হয়।

কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর ও বগুড়া জেলায় বাস্তবায়িত গবেষণায় দেখা যায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জেলা পর্যায়ের তহবিলটি এখনো সম্পূর্ণরূপে কার্যকর নয়। গবেষণার অংশগ্রহণকারীদের মতে, প্রতি অর্থবছরের সাথে স্থানীয়ভাবে সংগ্রহকৃত অর্থ অব্যবহৃত থেকে গেলে তা সরকারের কেন্দ্রীয় কোষাগারে প্রেরণ অনেক দাতাকেই বাৎসরিক তহবিলে অর্থ প্রদানে নিরুৎসাহিত করতে পারে।

সভায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জেলা পর্যায়ে তহবিল সক্রিয়করণে বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল হাসান বলেন, আগাম কার্যক্রম গ্রহণে স্থানীয় পর্যায়ে এই তহবিলের বিশেষ ভূমিকা রাখবে। তবে এই তহবিল ব্যবহারের জন্য পূর্বাভাসের প্রেক্ষিতে অর্থ সংস্থানের জন্য অবশ্যই পুনঃনির্ধারিত ট্রিগার থাকতে হবে।

তিনি আরো বলেন, ২০২২ সালের মতো আকস্মিক বন্যা আমাদের কারো কাম্য নয়। হাওর অঞ্চলে দুর্যোগ ঝুঁকি কমাতে পূর্বাভাসভিত্তিক সাড়াদান কার্যক্রমকে আরও সম্প্রসারিত করতে হবে। বাংলাদেশ উপকূলীয় অঞ্চলে সাইক্লোন মোকাবিলায় অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে; পূর্বাভাসভিত্তিক কার্যক্রম দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় যোগ করতে পারে একটি নতুন মাত্রা।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

জিডি নিয়ে পুলিশ পরিচয়ে অভিনব প্রতারণা, গ্রেপ্তার ১

‘জাতিগত সম্প্রীতিকে উপেক্ষা করে দেশ বিভক্তের ষড়যন্ত্র চলছে’

অবশেষে গাজায় যুদ্ধবিরতি

এনসিটিবি ঘেরাও কর্মসূচিতে হামলার ঘটনায় ছাত্রশিবিরের প্রতিবাদ

এই ঘটনার অবশ্যই বিচার হবে : আসিফ নজরুল

দেড়যুগের কারাজীবনের অবসান / লুৎফুজ্জামান বাবর মুক্তি পাচ্ছেন বৃহস্পতিবার

আরও ১৪ সাংবাদিকের ব্যাংক হিসাব তলব

সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের আকাশে উড়ার স্বপ্নপূরণ করল নভোএয়ার

প্রবাসী স্বামীকে ভিডিও কলে রেখে গলায় ফাঁস দিলেন স্ত্রী

যুবদলে হাইব্রিড ও দুর্বৃত্তদের স্থান নেই : শরীফ উদ্দিন জুয়েল

১০

ঢাবি শিক্ষার্থীদের স্মার্টকার্ড সমস্যা সমাধানে উপাচার্যকে স্মারকলিপি 

১১

শিক্ষিকাকে ধর্ষণের অভিযোগে প্রধান শিক্ষককে গণধোলাই দিল জনতা

১২

প্রেজেন্টেশনে মুজিববর্ষের লোগো, নেসকোর ৩ কর্মকর্তা বদলি 

১৩

ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় ছাত্রদলের নিন্দা

১৪

যশোরে খেজুর গুড়ের মেলা শুরু

১৫

এলইডি স্ক্রিনে কেন ভেসে উঠছে জয় বাংলাসহ বিভিন্ন লেখা

১৬

বিমানবন্দরে ২ হাজার ইয়াবাসহ যাত্রী আটক

১৭

চিটাগং ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির দ্বিতীয় সমাবর্তন শনিবার

১৮

এইচএমপিভি সংক্রমণ রোধে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে যাত্রীদের যা মানতে হবে

১৯

সেন্টমার্টিনে ভয়াবহ আগুন পুড়ল ৩ রিসোর্টের ২৬ কক্ষ, তদন্ত কমিটি গঠন

২০
X