আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনের অভ্যন্তরে নকশাবহির্ভূত এবং ভবনের ছাদে স্থাপিত রুফটপের রেস্তোরাঁর ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)।
সোমবার (২৮ এপ্রিল) এ বিষয়ে গণবিজ্ঞপ্তি জারির পর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এখন শত শত রেস্তোরাঁ সংকটে পড়েছে। প্রতিষ্ঠানের মালিকরা বুঝতে পারছেন না, এখন কী হবে।
গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকায় কিছু আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনের অভ্যন্তরে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অনুমোদিত নকশায় না থাকলেও বিধিবহির্ভূতভাবে রেস্তোরাঁ (রেস্টুরেন্ট) পরিচালনা করা হচ্ছে এবং ভবনের ছাদে অবৈধভাবে রুফটপ রেস্তোরাঁ পরিচালিত হচ্ছে, যা জনজীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। বিধিবহির্ভূতভাবে রেস্তোরাঁ পরিচালনা করায় ইতিমধ্যে বিভিন্ন স্থানে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ও সম্পদহানির ঘটনা ঘটছে। এসব ক্ষেত্রে অনেক অবৈধ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান অনৈতিক উপায়ে করপোরেশনের ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ করেছে।
ডিএসসিসির গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সম্পদ ও জানমালের ঝুঁকি এড়াতে নকশাবহির্ভূত সব রেস্তোরাঁ এবং ভবনের ছাদে স্থাপিত রুফটপ রেস্তোরাঁর ট্রেড লাইসেন্স বাতিল ঘোষণা করা হলো। বাতিল করা লাইসেন্স দিয়ে কোনো ব্যবসা পরিচালনা করা হলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দ্য মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন (ট্যাক্সেশন) রুলস, ১৯৮৬ অনুযায়ী, সিটি করপোরেশন এলাকায় যে কোনো ধরনের ব্যবসা করতে হলে ট্রেড লাইসেন্স নিতে হয়। সমস্যা হলো, যেসব ভবনে রেস্তোরাঁ করা হয়, সেসব ভবনের নকশায় রেস্তোরাঁ থাকে না। আবার অনেক সময় রেস্তোরাঁ ট্রেড লাইসেন্স নেয় না।
সিটি করপোরেশন জানিয়েছে, বর্তমানে ডিএসসিসি এলাকায় ১ হাজার ২৬টি রেস্টুরেন্টের ট্রেড লাইসেন্স আছে। আর এর মধ্যে শতাধিক ভবনের ছাদে অবৈধভাবে রুফটপ রেস্তোরাঁ আছে। এসব হোটেল রেস্তোরাঁ থেকে ডিএসসিসি বার্ষিক ৪ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করে। এর মধ্যে অধিকাংশ রেস্টুরেন্টে রাজউকের নকশায় নেই।
জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মুনিরুজ্জামান বলেন, ‘করপোরেশন এলাকায় অনেক রেস্তোরাঁ মালিক সঠিক তথ্য না দিয়ে ট্রেড লাইসেন্স নিয়েছে, সেগুলো বাতিল করা হয়েছে। এখন এসব অবৈধ রেস্তোরাঁ বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। তবে ভবনের নকশায় রেস্তোরাঁ থাকলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা সশরীর উপস্থিত হয়ে আমাদের কাছে তথ্য-উপাত্ত দিলে সেগুলো সচল করা হবে।’
রেস্তোরাঁ মালিকেরা বলছেন, বৈধভাবে রেস্তোরাঁ করা অত্যন্ত কঠিন করে রেখেছে সরকার। এ কারণেই বেশির ভাগ রেস্তোরাঁ এত সব অনুমোদন দিতে পারে না। এর সুযোগ নেন অসাধু কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান ডিএসসিসির সিদ্ধান্তকে ‘অযৌক্তিক ও একপাক্ষিক’ আখ্যায়িত করে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘রাজউকের পাস করা ভবনের নকশায় রেস্তোরাঁ নেই বললেই চলে। আমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যা ব্যবসায়ীদের পথে বসাবে। ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করে এখন যদি ডিএসসিসি অভিযানে নামে, তাহলে নতুন করে হয়রানিতে পড়বেন ব্যবসায়ীরা। প্রায় ৩০ লাখ মানুষ জীবিকা হারাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বেইলি রোডের ঘটনার পর পূর্ববর্তী সরকারের সময় এ সমস্যা সমাধানে একটি টাস্কফোর্স গঠিত হয়েছিল। দুটি বৈঠক হলেও সরকার পরিবর্তনের পর আমাদের সঙ্গে আর কোনো আলোচনা হয়নি। আমরা এই সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি এবং আমাদের করণীয় নির্ধারণে বৈঠক করবো।’
তবে ডিএসসিসির এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন নগর–পরিকল্পনাবিদ আর পরিবেশবিদরা। তাদের দাবি নকশাবহির্ভুত রেস্তোরাঁগুলো পুরো ভবনের সাথে পাশের ভবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে আর রুপটপের রেস্তোরাঁর কারণে ভবনের দুর্ঘটনা ঘটলে ছাদ দিয়ে পাশের ভবনে যাওয়ার রাস্তাও বন্ধ হয়। আবার রুপটপের রেস্টুরেন্টের ফলে নগরীর তাপমাত্রাতেও প্রভাব ফেলে। এই বিষয়ে নগর–পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান কালবেলাকে বলেন, ‘যে কোন অনুমোদনহীন রেস্তেরাই ঝুঁকিপূর্ণ। এসব রেস্তোরাঁর বিষয়ে অনেক আগেই সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রয়োজন ছিল। তবে সিটি করপোরেশন আর রাজউক বিভিন্ন সময় হম্বিতম্বি করলেও সেসা আর বাস্তবে রূপ নেয়নি। তবে অনুমোদনহীন রেস্টুরেন্ট বন্ধে একটি গাইডলাইন দরকার। এ গাইডলাইনের আলোকে রেস্টুরেন্ট তৈরি না করলে অনুমোদন দেয়া হবে না।
দক্ষিণ সিটির দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেন, সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে সিটি করপোরেশনকে ঝুঁকিপূর্ণ রেস্তোরাঁর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে।
গত বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বেইলি রোডে গ্রিন কোজি কটেজ নামের ভবনে ভয়াবহ আগুনে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনার পর রেস্তোরাঁর অনুমোদন ও অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থার ঘাটতি সামনে আসে। ওই ভবনে আটটি রেস্তোরাঁ ছিল, তবে ভবনটিতে রেস্তোরাঁ প্রতিষ্ঠার কোনো অনুমোদনই ছিল না।
বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজের সেই ভবনে সেদিন আটকা পড়েছিলেন বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার। তিনি বলেন, ‘নকশা বহির্ভূত রেস্তেরা আর রুপটপের রেস্টুরেন্ট একেকটি মৃত্যুফাঁদ। ভবন করার সময় এসব রেস্তোরাঁর নকশা করা হয়নি। ব্যাবসায়িক স্বার্থে এসব রেস্তেরা করা হয়েছে। যাতে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকে না। একটি ভবনে আগুন লাগলে ভবনের ছাদ দিয়ে পাশের ভবনে যাওয়ার সুযোগ থাকে। কিন্তু রুপটপ রেস্টুরেন্ট করে সেই সুযোগ বন্ধ করে উল্টো ঝুঁকির সৃষ্টি করা হচ্ছে।’
তিনি বলেন,‘এসব বন্ধে সরকারকে কঠোর ভূমিকা নিতে হবে। সাথে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে ভবনের ছাদে ছাদবাগান বা সোলার প্যানেলের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে আমাদের দুই সিটি করপোরেশন হোল্ডিং ট্যাক্স রিবেট করার মাধ্যমে উৎসাহ দিচ্ছেন। রাজধানীতে প্রায় ৫ লাখ বিল্ডিং আছে। এসব বিল্ডিংয়ের ৪০ ভাগ ছাদ বাগান করার উপযোগী। সেখানে ছাদবাগান করলে নগরীর তাপমাত্রাও ২০৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে আসবে।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) চার বছর আগে দেশের রেস্তোরাঁ খাত নিয়ে একটি জরিপ করে। সেই জরিপের তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালে দেশে মোট হোটেল ও রেস্তোরাঁ ছিল ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৭৪টি, যা ২০০৯-১০ অর্থবছরের চেয়ে ৫৮ শতাংশ বেশি। সরকারি সংস্থার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৮৫২টি। বাকি সব ব্যক্তি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন।
রেস্তোরাঁ ব্যবসা করতে চাইলে একজন বিনিয়োগকারীকে সরকারের সাতটি সংস্থার অনুমোদন ও ছাড়পত্র নিতে হয়। রেস্তোরাঁর জন্য প্রথমে নিবন্ধন ও পরে লাইসেন্স নিতে হয় সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে। ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ২০২৪ সালের মার্চ মাসের তথ্য অনুযায়ী, সরকারের সব সংস্থার প্রয়োজনীয় অনুমোদন ও ছাড়পত্র নিয়ে ঢাকায় রেস্তোরাঁ ব্যবসা করছে মাত্র ১৩৪টি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় রয়েছে ১২৮টি রেস্তোরাঁ।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি ঢাকা জেলায় পাঁচটি উপজেলা রয়েছে। সাভার, ধামরাই, কেরানীগঞ্জ, দোহার ও নবাবগঞ্জ—এই পাঁচ উপজেলার মধ্যে শুধু সাভারের ছয়টি রেস্তোরাঁর লাইসেন্স রয়েছে।
মন্তব্য করুন