১৯ জুলাই, ২০২৪। সারা দেশের মতো নারায়ণগঞ্জের চিটাগাং রোডেও পালিত হচ্ছিল ‘কমপ্লিট শাটডাউন’। সেদিন সকাল থেকেই নারায়ণগঞ্জের চিটাগাং রোড এলাকায় চলছিল গুলির বিকট শব্দ। একের পর এক ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ায় পুরো এলাকা পরিণত হয় ভয়ানক রণক্ষেত্রে।
সে দিন এই রণক্ষেত্রে প্রাণ যায় সজলের। প্রাণ বাঁচাতে একটি চায়ের দোকানে আশ্রয় নিয়েছিলেন সজল। কিন্তু লুকিয়েও শেষরক্ষা হয়নি। পুলিশের গুলিতে নিহত হন সিদ্ধিরগঞ্জের মৌচাক এলাকার বাসিন্দা সজল।
সজলের বয়স মাত্র ২৩। জীবনের পুরোটা সময় পরিবার আর সমাজের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া এক তরুণ, যিনি নিজের সব কষ্ট ঢেকে রাখতেন অনাবিল হাসির মোহন প্রলেপে। চার ভাইবোনের মধ্যে বড়। সজলের মা-বাবা কখনোই ঠিকমতো পেটপুরে খেতে পারেননি। কিন্তু ছেলেমেয়েদের মুখে যেন কখনো অভাবের ছায়া না পড়ে- এই ছিল তাদের ব্রত। এই শিক্ষাটি মনেপ্রাণে মানতেন সজলও। ভাইবোন পড়ালেখা করলেও নিজে বাবার সঙ্গে সংসারের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন সজল। চিটাগাং রোডে বাবার সঙ্গে জুতার কারখানায় কাজ করতেন।
আব্দুল হামিদ ও রুনা বেগমের চার সন্তানের মধ্যে বড় ছিল সজল। ছোটবেলা থেকেই শান্ত স্বভাবের। সজলের বোন রাইফা (১৭), ছোট বোন রুবিনা (১৪) ও ইব্রাহিম (১১) মাদ্রাসায় পড়ালেখা করছে।
সজলের মা রুনা বলেন, ‘আমি জানতাম সজল লুকায় লুকায় আন্দোলনে যায়, সামনে রাগ দেখাইলেও যাইতে বাধা দেই নাই৷ কিন্তু ওইদিন মনটা কেমন কেমন জানি করতাছিল। গুলির আওয়াজ ঘরেও পাইতেছিলাম৷’
আগের রাতে সজলের মা রুনা বেগম ঘুমাতে পারেননি। বুকের ভেতরটা কেমন জানি অস্থির লাগছিল। বারবার ছেলেকে বলছিলেন, ‘তুই যাস না রে বাবা, রাস্তায় কিছু হইব। তোর মুখের দিকে তাকাইলেই ডর লাগে।’
রুনা বেগম বলেন, ‘দুপুরে খাওয়ার পর আমি সজলরে বলছিলাম, তুই বাহিরে যাইছ না, আমার পাশে শুইয়া ঘুমা। মা তোমার লগেই ঘুমামু, একটু আসতাছি বলে আন্দোলনে চলে গিয়েছিল সজল। এই শেষ কথা হয় আমার ছেলের সাথে।’
শহীদ সজলের মা রুনা বেগম তার আদরের বড় সন্তানকে হারিয়ে এখনো গভীর শোকে ডুবে আছেন, যা তাকে মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত করে তুলেছে। মা আন্দোলনে যেতে নিষেধ করলে সজল বলত, ‘সবাইকেই দেশের জন্য রাস্তায় নামতে হইবো মা, ঘরে থাইকাও কেউ নিরাপদ নাহ্। আমি মরে গেলে তুমি শহীদের মা হবা। মনে করবা আমার আয়ু ওইটুকুই ছিল।’
রুনা বেগম ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমারে শহীদের মা বানাইয়া পোলায় কবরে ঘুমায় রইছে। আর আমার পাশে শুইয়া ঘুমাইতে আইবো না। কইবো না, মা তোমার লগেই ঘুমামু!’
সজলের বাবা বলেন, ‘আওয়ামী লীগের বিক্ষোভে পড়ে কয়েক বছর আগে আমার অনেক টাকার ক্ষতি হয়। সেইডা নিয়া আমার কোনো খেদ নাই। আমার ছেলে বা আমরা তো কেউ কোটায় চাকরি করতাম না। আমাগো সেই চাহিদা ছিল না। কিন্তু হাসিনার মতো খারাপ মানুষকে সরকার থেকে নামাইতে চাইছিলাম। হাসিনাকে নামাইতে গিয়া সন্তান হারাইছি। ছেলেরে বিসর্জন দিয়া এই দেশের স্বাধীনতা পাইছি।’
ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে সজলের বাবা-ক্ষুব্ধ এই মা বলেন, ‘আমার ছেলেরে যারা মারছে তাগো আমি বিচার চাই, আমি বাঁইচা থাকতে ওই জালেমগো বিচার দেখতে চাই।’
মন্তব্য করুন