হদিস মিলছে না ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত লাইসেন্স পাওয়া ৬ হাজারের বেশি মারাত্মক আগ্নেয়াস্ত্রের। এসব অস্ত্র আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী, স্থানীয় সন্ত্রাসী, জেল পলাতক আসামি, পেশাদার অপরাধী এমনকি রাজনৈতিক দলের ক্যাডারদের হাতে চলে গেছে বলে মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা জানিয়েছেন। এসব অস্ত্র ব্যবহার করে যেকোনো সময় ডাকাতি, ছিনতাইসহ বড় ধরনের অপরাধ সংঘটনের আশঙ্কা করা হচ্ছে।
পুলিশের সদর দপ্তরের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছরের ৫ আগস্ট পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়ি থেকে মোট ৫ হাজার ৭৫০টি অস্ত্র লুট হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার (সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী) পর্যন্ত উদ্ধার হয়েছে ৪ হাজার ৩৭৩টি অস্ত্র, যা মোট লুণ্ঠিত অস্ত্রের প্রায় ৭৬ শতাংশ।
লুণ্ঠিত গোলাবারুদের পরিমাণ প্রায় ৬ লাখ ৫১ হাজার ৮২৬ রাউন্ড। এখন পর্যন্ত উদ্ধার হয়েছে প্রায় ৪ লাখ রাউন্ড গোলাবারুদ। তবে ২৪ শতাংশ অস্ত্র ও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ গোলাবারুদ এখনো উদ্ধার করা যায়নি, যা শীর্ষ ও পেশাদার সন্ত্রাসীদের হাতে চলে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
উদ্ধার না হওয়া অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের রাইফেল, স্মল মেশিনগান (এসএমজি), লাইট মেশিনগান (এলএমজি), বিদেশি পিস্তল, শটগান ও চায়নিজ রাইফেল (সিআর)। অপরদিকে, গোলাবারুদের মধ্যে রয়েছে কাঁদানে গ্যাস লঞ্চার, গ্যাসগান, গ্যাস শেল ও স্প্রে, সাউন্ড গ্রেনেড, ফ্ল্যাশ ব্যাংক, স্টান গ্রেনেড এবং কালার স্মোক গ্রেনেডসহ নানা ধরনের বিস্ফোরক ও প্রতিরোধমূলক সরঞ্জাম।
গত বছরের ৫ আগস্ট গণভবনে দায়িত্ব পালনরত স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ) সদস্যদের কাছ থেকে লুট হওয়া ৩২টি অত্যাধুনিক অস্ত্রের এখনো কোনো খোঁজ মেলেনি বলে জানিয়েছে পুলিশ। এসব অস্ত্রের মধ্যে ছিল এসএমজি টি-৫৬, উন্নত অ্যাসল্ট রাইফেল, স্নাইপার রাইফেল, ফ্ল্যাশ ব্যাং গ্রেনেড, অ্যান্টি-ড্রোন গান, অ্যান্টি-ড্রোন সিস্টেম ও বেতার যোগাযোগের ডিভাইস। অস্ত্রগুলো উদ্ধার না হওয়ায় নিরাপত্তা মহলে চরম উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন, লুণ্ঠিত অস্ত্রগুলো ইতোমধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন অপরাধী চক্রের হাতে পৌঁছে যেতে পারে। এতে করে যেকোনো সময় বড় ধরনের আইনশৃঙ্খলা অবনতি বা নাশকতার ঘটনা ঘটতে পারে বলে সতর্ক করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দেশের বিভিন্ন থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি থেকে লুট হওয়া অস্ত্র এখন হত্যাকাণ্ড, দখল ও ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে জানা গেছে। এসব অস্ত্রের ব্যবহার দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় গুরুতর ঝুঁকি তৈরি করছে।
দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, থানা ও ফাঁড়ি থেকে লুট হওয়া অস্ত্র হত্যা, অবৈধ দখল, ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হচ্ছে। গত বছরের ৩ ডিসেম্বর ঢাকা-মাওয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে প্রকাশ্যে ছয় রাউন্ড গুলি ছুড়ে আড়াই মাসের অন্তঃসত্ত্বা নারী সাহিদা ইসলাম রাফাকে হত্যা করে তৌহিদ শেখ তন্ময় নামের এক যুবক। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্রটি ছিল গত ৫ আগস্ট রাজধানীর ওয়ারী থানা থেকে লুট হওয়া একটি বিদেশি পিস্তল।
মুন্সীগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার মুহাম্মদ শামসুল আলম সরকার গণমাধ্যমকে জানান, তৌহিদ ওই পিস্তলটি ওয়ারী থানা থেকে লুট করে এবং ইউটিউব ভিডিও দেখে অস্ত্রটি চালানো শিখে। এরপর সেই অস্ত্র দিয়েই নিজের প্রেমিকাকে হত্যা করে। ঘটনার পর কেরানীগঞ্জের বটতলী বেইলি ব্রিজের নিচ থেকে পিস্তলটি উদ্ধার করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, লুট হওয়া অস্ত্রগুলো শুধুমাত্র ব্যক্তিগত বিরোধ বা প্রতিহিংসার জন্য নয়, বরং সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও সংঘবদ্ধ অপরাধের হাতিয়ারে পরিণত হচ্ছে।
মন্তব্য করুন