সম্প্রতি মিয়ানমারে ভয়াবহ ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠেছে দেশটি। বাদ পড়েনি মিয়ানমারে পার্শ্ববর্তী দেশ থাইল্যান্ডও। এবার মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের মতো বাংলাদেশেও একই মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার শঙ্কা রয়েছে বলে সতর্ক করেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স।
ইতোমধ্যে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে নিহতের সংখ্যা রেকর্ড ছাড়িয়েছে। ভূমিকম্পের সময় ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির মাত্রা কেন বাড়ে, তা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠতে পারে। বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণে ওঠে এসেছে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা ভূমিকম্পের ধ্বংসাত্মক প্রভাব কমানো বা বাড়ানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে।
চলুন তা জেনে নেওয়া যাক-
কম্পনের মাত্রা ও স্থায়িত্বকাল
ভূমিকম্প কতটা ভয়াবহ হবে, তা নির্ভর করে দুটি প্রধান বিষয়ের ওপর—এর মাত্রা ও স্থায়িত্বকাল। ভূমিকম্প মাপার প্রচলিত পদ্ধতি রিখটার স্কেল হলেও এখন আরও নির্ভুলভাবে মাপার জন্য মোমেন্ট ম্যাগনিটিউড স্কেল (Mw)ব্যবহৃত হচ্ছে। রিখটার স্কেলকে পুরোনো মনে করা হলেও, যেকোনো স্কেলেই কম্পনের মাত্রা বিশ্লেষণ করা জরুরি।
ভূমিকম্পের মাত্রা বলতে বোঝানো হয় ভূ-অভ্যন্তরের টেকটোনিক প্লেটগুলো কতটা সরেছে এবং সেই সরানোর পেছনে কী পরিমাণ শক্তি কাজ করেছে। পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠ মূলত বিভিন্ন প্লেট দিয়ে তৈরি, যা নরম স্তরের ওপর ভাসছে। যেখানে এক প্লেট আরেকটির সঙ্গে ধাক্কা খায় বা ফাটল ধরে, সেটাই ফল্ট লাইন নামে পরিচিত। এখান থেকেই ভূমিকম্পের উৎপত্তি।
কম্পনের মাত্রা যদি ২.৫ বা তার কম হয়, সাধারণত মানুষ তা টের পায় না, তবে ভূমিকম্প পরিমাপের যন্ত্রে ধরা পড়ে। পাঁচ মাত্রার বেশি কম্পন হলে তা অনুভূত হয় এবং সামান্য ক্ষয়ক্ষতি ঘটতে পারে। সাত মাত্রার ওপরে গেলে ক্ষতির আশঙ্কা বাড়ে, আর আট মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্ভাবনা থাকে।
এ ছাড়া ভূমিকম্পের স্থায়িত্বও ব্যাপক ভূমিকা রাখে। কয়েক সেকেন্ডের কম্পন তেমন প্রভাব ফেলে না, কিন্তু মাঝারি থেকে বড় ভূমিকম্প কয়েক মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রায় ৯.১ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল, যা কয়েক মিনিট স্থায়ী ছিল। সেই কম্পনের পরিণতিতে সুনামি আঘাত হানে এবং ১৪টি দেশে প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ইন্দোনেশিয়া।
ভূমিকম্পের মাত্রা ও স্থায়িত্ব তাই ক্ষয়ক্ষতির চিত্র বদলে দিতে পারে। এ কারণেই ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও পূর্বাভাস ব্যবস্থার গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে।
গভীরতা
ভূমিকম্প কতটা শক্তিশালী হবে, তা শুধু কম্পনের মাত্রার ওপর নির্ভর করে না। অনেকটা নির্ভর করে ভূমিকম্পের গভীরতা ওপর। কম্পনটি মাটির কতটা গভীরে ঘটেছে, সেটার ওপরও নির্ভর করে এর ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা।
এ বিষয়ে ভূতত্ত্ববিদ ড. কারমেন সোলানা বলেন, ভূমিকম্প যদি অগভীর হয়, তাহলে এর শক্তি ও কম্পন প্রশমিত হওয়ার সুযোগ কম থাকে। ফলে মাটির ওপরে প্রভাব তীব্র হয়, ক্ষয়ক্ষতিও বেশি হয়।
ভূমিকম্পের মাত্রা যতই বেশি হোক না কেন, যদি সেটি গভীরে ঘটে, তাহলে ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যায়। তাই ভূমিকম্প বিশ্লেষণে মাত্রার পাশাপাশি গভীরতাকেও সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়।
ভবনের অবস্থা
ভূমিকম্প প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়, তবে সহনশীল ঘরবাড়ি নির্মাণের মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতি কমানো যায়। এ জন্য এমন ভবন তৈরি করতে হয়, যা প্রবল কম্পনেও স্থিতিশীল থাকে। জাপান এ ক্ষেত্রে সারা বিশ্বের জন্য এক উদাহরণ।
টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক এবং কাঠামোগত প্রকৌশলী জুন সাতো বলেন, ভূমিকম্পের সময় যদি কোনো ভবন সৃষ্ট শক্তিকে শোষণ করতে সক্ষম হয়, তবে সেটি ধসে পড়ে না।
এর পেছনে মূল বিষয়টি হলো, ভবনকে এমন একটি ভিতের ওপর দাঁড় করানো, যা ভূমিকম্পের কম্পন শোষণ করতে পারে। সাধারণত ৩০ থেকে ৫০ সেন্টিমিটার পুরু রাবারের ব্লক ব্যবহার করে এমন ভিত তৈরি করা হয়। তবে এই প্রযুক্তি ব্যয়বহুল, ফলে নির্মাণ খরচ অনেকটাই বেড়ে যায়।
যেখানে ভূমিকম্পের ক্ষতি সবচেয়ে বেশি হয়, সেসব এলাকায় সাধারণত ভবনগুলো দুর্বল উপাদানে তৈরি হয়। যেমন, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে মরোক্কোর ভূমিকম্পে যেসব ঘর ধসে পড়েছিল, তার বেশিরভাগই ছিল সূর্যের তাপে শুকানো ইটের তৈরি, যা ভূমিকম্প সহনশীল নয়।
মাটির ধরন
ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা শুধু কম্পনের শক্তির ওপর নির্ভর করে না, মাটির ধরনও এতে বড় ভূমিকা রাখে। মাটি কতটা শক্ত বা তার ওপরের স্তরের কী প্রকৃতি, তার ওপর নির্ভর করে ভূমিকম্পের প্রভাব কতটুকু বাড়বে বা কমবে।
যুক্তরাষ্ট্রের জিওলজিক্যাল সার্ভে (USGS) অনুযায়ী, যদি ভূ-পৃষ্ঠ বা এর কাছাকাছি স্তরে কাদামাটি থাকে, তবে সেটি শক্তিশালী কম্পন সহ্য করতে পারে না। কম্পন শুরু হলে, মাটি তরল পদার্থের মতো আচরণ করতে শুরু করে, যার ফলে ধ্বংসযজ্ঞের মাত্রা ব্যাপকভাবে বাড়ে। ১৯৬৪ সালে জাপানে নিগাতয় ভূমিকম্পে ঠিক এমন পরিস্থিতি ঘটেছিল।
এটি স্পষ্ট যে, ভূমিকম্পের ক্ষতি এবং প্রভাব শুধুমাত্র কম্পনের মাত্রার ওপর নয়, মাটির ধরনও প্রভাবিত করে ক্ষতির পরিমাণ।
মন্তব্য করুন