জুলাই গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের প্রেক্ষিত বদলে দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
মহান স্বাধীনতা দিবস ও পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষ্যে মঙ্গলবার (২৫ মার্চ) জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এ কথা জানান তিনি।
তিনি বলেন, আমাদের দেশের নারীরা দীর্ঘ আন্দোলনের মাধ্যমে বহু বছর ধরে অনেক বাধা পেরিয়ে একটু একটু করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরেও এ দেশের নারীরা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক বৈষম্যের শিকার।
প্রধান উপদেষ্ট বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত যত আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে তার মধ্যে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল সবচাইতে বেশি। গণ-অভ্যুত্থানে নারীরা দুঃসাহসিক ভূমিকা রেখেছে। পুরোনোকে দূরে ঠেলে দিয়ে নতুনের ভিত্তি স্থাপনের প্রতিজ্ঞা নিয়েছে। তারা ব্যাপক সংস্কারের কথা বলেছে। সর্বত্র নারীদের ভূমিকা আরও জোরালো করার কথা বলেছে।
তিনি বলেন, আমি মনে করি, জুলাই গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের প্রেক্ষিত বদলে দিয়েছে। জুলাইয়ের পর নারীদের অবস্থান ইতিবাচকভাবে পরিবর্তন হবে সেটাই আমরা চাই। আমরা বাংলাদেশ নিয়ে নতুন করে ভাবতে চাই। আর এই নতুন ভাবনায় নারীদের অবস্থান উচ্চতম পর্যায়ে অগ্রাধিকার পাক সেটাই আমরা চাই।
তিনি আরও বলেন, পরিবারের সকল সদস্য, পাড়া-প্রতিবেশী, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, স্কুল—আপনারা আপনাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে ছেলে শিশু ও মেয়ে শিশুর মধ্যে যেন কোনো বৈষম্য না সৃষ্টি না হয় তা নিশ্চিত করুন। আসুন, নতুন বাংলাদেশে সবাই মিলে শিশুদের জন্য সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করি।
ড. ইউনূস বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া নারীরা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। দেশে বিরাজমান বৈষম্যগুলো চিহ্নিত করে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ ও বৈষম্য নিরসনে আমাদের প্রত্যেককে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
তিনি আরও বলে, নারীর প্রতি বিদ্বেষমূলক কথাবার্তা, নারীকে খাটো করে রাখার প্রবৃত্তি যারা ধারণ করে তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন। আধুনিক প্রযুক্তি সকল প্রকার বাধা ভেঙে দেয়ার মহাশক্তি আমাদেরকে দিয়েছে। সে বাধা যত শক্তই হোক, যত উঁচুই হোক। সকল দূরত্ব ঘোচানোর জন্য প্রযুক্তিকে অবশ্যই যেন আমরা ব্যবহার করতে আরম্ভ করি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, নারীদের সুরক্ষায় পুলিশ হটলাইন নম্বর চালু করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে শর্ট-কোড চালু করা হচ্ছে। কল-টেকার হিসেবে শতভাগ নারী কর্মীদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, যেন নির্দ্বিধায় কথা বলা যায়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন হয়েছে। এসব মামলার তদন্ত ও বিচারের সময় কমিয়ে আনা হয়েছে, বিচার বিলম্বে বাধা দুর করা হচ্ছে। ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে ডিএনএ ল্যাব স্থাপনের কাজ চলছে। খুব দ্রুতই বিশেষ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে নতুন অনেক বিচারক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। ভিকটিম শিশুরা যাতে দ্রুত বিচার পায় সেজন্য আলাদাভাবে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল স্থাপনের বিধান রাখা হচ্ছে।
ড. ইউনূস বলেন, দেশের সবার মতো আমিও অত্যন্ত আনন্দিত যে এবার নারী ফুটবল টিম দক্ষিণ এশিয়ায় চ্যাম্পিয়ান হয়েছে। দেশজুড়ে আয়োজিত ‘তারুণ্যের উৎসব ২০২৫’ এ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ২৭ লক্ষ ৪০ হাজার মেয়েরা প্রায় তিন হাজার খেলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ গ্রহণ করেছে। উৎসবে দেশের সুবিধাবঞ্চিত ও সুবিধাপ্রাপ্ত অঞ্চল, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এবং ২১টি নৃগোষ্ঠীর তরুণ-তরুণীসহ সকলের সার্বজনীন অংশগ্রহণ ছিল।
তিনি বলেন, এ উৎসবের অন্যতম লক্ষ্য ছিলো তরুণদের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলা, সহযোগিতার নীতি প্রচার এবং তাদেরকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা যাতে করে তারা আত্মনির্ভর হতে পারে, দেশের সম্পদ হিসেবে গড়ে ওঠতে পারে। আমরা তারুণ্যের এই উৎসব সারা বছর জুড়ে উদযাপন করার ঘোষণা দিয়েছি। এ উৎসবে আমরা গ্রাম উপজেলা শহর বন্দর সকল এলাকার আবালবৃদ্ধবণিতাকে এবং স্কুল কলেজ মাদ্রাসা সরকারি বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানের সবাইকে নানা প্রকারের সৃজনশীল কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে আসার জন্য আমি অনুরোধ জানাচ্ছি। প্রতিটি এলাকায় এই উৎসবে যোগদান করতে মেয়েদের যেন বিশেষভাবে উৎসাহিত করা যায় সেজন্য সকলকে আহ্বান জানাচ্ছি। কোথায় এটা কীভাবে উদযাপিত হচ্ছে সে ব্যাপারে জানার জন্য আমি আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করলাম। বিভিন্ন পর্যায়ে দেশের সেরা গ্রাম, সেরা উপজেলা সেরা শহর, সেরা প্রতিষ্ঠান, সেরাব ব্যক্তিকে পুরস্কার দেয়ার জন্য আমরা প্রস্তুত থাকবো।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, নারী অধিকারের পাশাপাশি একইরকম গুরুত্বের সঙ্গে মনে রাখতে হবে সংখ্যালঘুদের নাগরিক অধিকার। সমতল ও পাহাড়ের জাতিগোষ্ঠীর নাগরিক অধিকার। কারো কোনো নাগরিক অধিকারকে অবহেলা করলেই এ জাতির জন্য মহাসংকট সৃষ্টি করবে। নাগরিক হিসেবে আমরা কেউ যেন অন্য নাগরিকের অধিকার হরণের দায়ে অভিযুক্ত হতে না পারি সে ব্যাপারে আমাদের নিশ্চিত থাকতে হবে। তাহলেই সত্যিকার নতুন বাংলাদেশ জন্মলাভ করবে।
মন্তব্য করুন