নানা অভিযোগে অভিযুক্ত রোমানিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম কল্যাণ উইংয়ে কমরত প্রথম সচিব (শ্রম) মোহাম্মদ মহসীন মিয়াকে প্রত্যাহর করেছে সরকার। রোমানিয়া দুতাবাস থেকে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে যোগদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
রোমানিয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের হয়রানিসহ নানা অভিযোগ ছিল এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। এই কর্মকর্তাকে দ্রুত অপসারণের দাবিতে মানববন্ধন এবং প্রবাসী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপিও দিয়েছিল রোমানিয়া প্রবাসী এবং ভিসাপ্রত্যাশীরা। অবশেষে সেই মহসিনকে প্রত্যাহার করলো প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।
বৃহস্পতিবার (১৩ মার্চ) মহসিনকে প্রত্যাহারের অফিস আদেশ দেয় মন্ত্রণালয়।
অফিস আদেশে বলা হয়, মহসিন মিয়াকে প্রশাসনিক কারণে সংশ্লিষ্ট শ্রম কল্যাণ উইং থেকে প্রত্যাহার করা হলো। তাকে বিধি মোতাবেক আগামী ২৫ মার্চের মধ্যে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে যোগদানের জন্য নির্দেশ দেওয়া হলো।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আশ্রাফ আহমেদ রাসেল স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে আরও বলা হয়, আদেশ অনুযায়ি নির্দিষ্ট তারিখে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে যোগদান না করলে তিনি ঐ তারিখ থেকে তাৎক্ষণিক অবমুক্ত হয়েছেন বলে গণ্য হবেন। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে এ আদেশ জারি করা হলো বলেও অফিস আদেশে উল্লেখ করা হয়।
এর আগে গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর এই মহসীনের বিভিন্ন অপকর্ম নিয়ে ‘কূটনীতিক মহসিনের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই’ শীর্ষক শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে ‘দৈনিক কালবেলা’। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, রোমানিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমবাজার সম্প্রসারণ এবং শ্রমিকদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেখার দায়িত্ব দূতাবাসের শ্রম উইংয়ের প্রথম সচিব মহসিন মিয়ার; কিন্তু সেদিকে নজর না দিয়ে তিনি জড়াচ্ছেন নানারকম কেলেঙ্কারিতে। তার যৌন হয়রানির কারণে এক রোমানিয়ান নারী ছেড়েছেন চাকরি। অন্য নারী সহকর্মীরাও তার এমন ব্যবহারে বিরক্ত।
দূতাবাসের ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে উঠেছে সহকর্মী ও প্রবাসীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও টাকা চাওয়ার অভিযোগ। রোমানিয়ান কোম্পানির সঙ্গে খারাপ ব্যবহারেরও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এতে রোমানিয়ায় দেশের শ্রমবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি কূটনৈতিক কার্যকলাপেও বিরূপ প্রভাব পড়ছে। মহসিনের কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে দ্রুত দেশে ফেরত নেওয়ার আলটিমেটাম দিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
কালবেলার প্রতিবেদনে বলা হয়, মহসিন মিয়া রোমানিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম উইংয়ের প্রথম সচিব। বিসিএস ২৭ ব্যাচের এই কর্মকর্তা ২০২৩ সালে দূতাবাসের শ্রম উইংয়ে যোগ দেন। যোগদানের পর থেকেই তার বিরুদ্ধে অনৈতিক প্রস্তাবসহ নারী সহকর্মীদের সঙ্গে অসদাচরণের অভিযোগ ওঠে। সম্প্রতি বাংলাদেশ দূতাবাসে রিসিপশনিস্ট পদে কর্মরত সুজানা কাজমি নামের এক রোমানিয়ান নারী মহসিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে চাকরি ছেড়েছেন। চাকরি ছাড়ার কারণ হিসেবে মহসিন মিয়া তাকে দীর্ঘদিন ধরে উত্ত্যক্ত করতেন। একারণে তিনি চাকরি ছাড়েন।
সুজানার পরে ওয়েলফেয়ার অ্যাসিন্ট্যান্ট পদে চাকরি করা ইনগ্রিদ নামে আরেক রোমানিয়ান নারীকেও মহসিন অনৈতিক প্রস্তাব দেন বলে অভিযোগ উঠেছে। দূতাবাস সূত্র এবং বাংলাদেশ কমিউনিটির একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইনগ্রিদ দূতাবাসে কর্মরত তার রোমানিয়ার সহকর্মীদের কাছে বলেছেন, সম্প্রতি মহসিন তাকে বুলগেরিয়ায় সরকারি সফরে নিয়ে যান, সেখানে তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে অনৈতিক সম্পর্কের প্রস্তাব দেন। ইনগ্রিদ চিৎকার করলে ভয় পেয়ে মহসিন তাকে ছেড়ে দেন।
ওই প্রতিবেদনে রোমানিয়ায় বসবাসকারী একাধিক প্রবাসী মহসিনের বিরুদ্ধে দূতাবাসের এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দেশে লাশ পাঠানো এবং কাগজ বৈধ করার নামে টাকা চাওয়া এবং প্রবাসীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহারের অভিযোগ করেন। তারা জানান, মহসিনের এই অপতৎপরতার কারণে বর্তমানে বাংলাদেশ দূতাবাসে বৈধ ডিমান্ড লেটার আসা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে, যার ফলে রোমানিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
প্রবাসীরা জানান, মহসিন মিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। সারাক্ষণ প্রভুসুলভ আচরণ করা এ ব্যক্তি শ্রমিক-মালিকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও উচ্চ স্বরে চেঁচামেচি করেন। তিনি বলেন, ভেবেছিলাম এই ভদ্রলোক শ্রমিকদের সুযোগ সুবিধা দেখবেন; কিন্তু তার কারণে শ্রমবাজারের কোনো উন্নতি হয়নি। বরং তার বাজে ব্যবহারের কারণে বিভিন্ন কোম্পানি থেকে অনেক শ্রমিকের চাকরি চলে গেছে।
উল্লেখ্য, ২০২১-২২ সালে রোমানিয়ায় প্রবেশ করা বিদেশিদের মধ্যে বাংলাদেশিরা প্রথম ছিল। তবে ২০২৩ সাল থেকে পাল্টাতে থাকে পরিস্থিতি। দূতাবাসের শ্রম উইংয়ের ব্যর্থতায় বাংলাদেশিদের রোমানিয়া থেকে পালিয়ে যাওয়ার সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং বর্তমানে দেশটিতে খুব কম বাংলাদেশি শ্রমিক প্রবেশ করতে পারছেন। বাংলাদেশের পরিবর্তে সম্ভাবনাময় শ্রমবাজারটি বর্তমানে দখল করেছে নেপাল ও শ্রীলঙ্কা।
এদিকে, মহসিনের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে গত ডিসেম্বর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন প্রবাসীরা। অভিযোগে পত্রে মহসিনকে নারীলোভী, অর্থলোভী ও পতিত স্বৈরাচারের দোসর উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি ১ সপ্তাহের মধ্যে দেশে ফেরত নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে মহসিনের বিরুদ্ধে দূতাবাসের সামনে মানবন্ধন করার হুঁশিয়ারিও দিয়েছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। এছাড়া মহসিনকে দ্রুত অপসারণের দাবিতে বাংলাদেশেও মানববন্ধন করেন রোমানিয়ায় ভিসাপ্রত্যাশীরা।
ওই প্রতিবেদনে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মিশন ও কল্যাণ অনুবিভাগ অতিরিক্ত সচিব মো. শেখাবুর রহমান কালবেলাকে বলেছিলেন, অভিযোগ পেলে অবশ্যই তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর আগেও এমন অভিযোগের কারণে এক কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
মন্তব্য করুন