বাসস
প্রকাশ : ০৯ মার্চ ২০২৫, ০৯:৩৯ এএম
অনলাইন সংস্করণ

মরলে মরব, আন্দোলনে যাব : বাবাকে বলতেন শহীদ রিয়ান

শহীদ নাসিব হাসান রিয়ান। ছবি : সংগৃহীত
শহীদ নাসিব হাসান রিয়ান। ছবি : সংগৃহীত

স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের খবর শুনে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বিকেলে বিজয় মিছিল নিয়ে শ্যামলীর খিলজি রোড হয়ে রিং রোডের দিকে যাচ্ছিল নাসিব হাসান রিয়ান (১৭) ও তার বন্ধুরা। তখনো অস্ত্র হাতে পুলিশের একটি দল সেখানে অবস্থান করছিল। কিন্তু নাসিব হাসান রিয়ানের বিশ্বাস ছিল শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ায় এখন হয়ত আর পুলিশ গুলি করবে না।

মিছিলের অগ্রভাগে থেকে বিজয়ের আনন্দে মেতে ওঠা সাহসী কিশোর নাসিব হাসান রংপুরের শহীদ আবু সাঈদের মত দুই হাত দুই দিকে প্রসারতি করে পুলিশের উদ্দেশে বলতে থাকে-‘গুলি করবি, কর’। এমনটা শোনামাত্রই পুলিশ ওদের বিজয় মিছিলকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে।

পুলিশের ছোঁড়া একে একে তিনটা বুলেট রিয়ানের শরীরের তিন স্থানে লাগে। বুলেটের আঘাত সহ্য করতে না পেরে রিয়ান মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। প্রথম বুলেটটি বুকে লেগে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায়। দ্বিতীয়টি কানের নিচে দিয়ে ঢুকে গলা ভেদ করে। তৃতীয় বুলেটটি বুকে-কাঁধে লেগে মাংস ছিঁড়ে বেরিয়ে যায়।

রাজধানীর শ্যামলীর বাসায় বাসস-এর সঙ্গে আলাপকালে শহীদ নাসিব হাসান রিয়ানের বাবা কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা মো. গোলাম রাজ্জাক এসব কথা জানান। ছেলের সম্পর্কে এসব কথা বলতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠেন তিনি। বলতে থাকেন ছেলের সঙ্গে থাকা বিভিন্ন স্মৃতির কথা।

ছেলের মৃত্যুর বর্ণনা দিতে গিয়ে শহীদ রিয়ানের বাবা বলেন, ‘ওরা আমার ছেলেটাকে গুলিতে গুলিতে ক্ষত-বিক্ষত করেছে। একটা ছেলেকে মারতে কি এত বুলেট লাগে! না জানি আমার সোনার টুকরো ছেলেটা কতটা কষ্ট পেয়ে শহীদ হয়েছে।’

গোলাম রাজ্জাক জানান, আমার তিন ছেলে, রিয়ান মেজো, বড় ছেলে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। রিয়ান ধানমন্ডি গভর্নমেন্ট বয়েজ স্কুল থেকে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পাশ করে ‘বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) কলেজে ভর্তি হয়েছিল। আমি ওকে ছাত্রদের আন্দোলনে যেতে বার বার নিষেধ করেছি, কিন্তু আমাদের না জানিয়ে চুপিচুপি চলে যেত।

১৮ জুলাই ওর বন্ধু ‘ফারহান ফাইয়াজ’ শহীদ হওয়ার পর থেকে বিয়ানকে কোনোভাবেই আর বাসায় রাখা যাচ্ছিল না। আমাদের বলত, ‘ন্যায্য দাবি চাইতে গিয়ে আমার ভাইয়েরা মরে যাচ্ছে, আমি কিছুতেই ঘরে বসে থাকতে পারি না। আমি বাঁচতে চাই না, বাবা; আমিও মরে যাব; আন্দোলনে গিয়ে মরলে মরব।’

আমাকে রিয়ান আরও বলত, ‘বাবা আমার বন্ধু মারা গেছে, ছাত্ররা মারা যাচ্ছে, আমি আন্দোলনে যাব, তুমি আমাকে নিষেধ করো না। সব মানুষ তো একদিন মরতে হবে।’

রাজ্জাক বলেন, আমার ছেলেকে নিয়ে বড় আশা ছিল, সে দেশ ও দশের সেবায় নিয়োজিত হবে। আমরা তো করতামই, আমাদের আত্মীয়রাও রিয়ানকে নিয়ে খুব গর্ববোধ করত। কারণ ও খুব মেধাবী ছিল। তার রেজাল্ট সব সময় ভালো ছিল।

তিনি আরও বলেন, আমার ছেলে রিয়ান সবসময় অন্যের বিপদে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করত। আমরা বলতাম তুমি খুব ছোট, তোমার বয়স হয়নি। তবু সে বিভিন্ন সময় তার বন্ধুদের বিপদে সহায়তা করেছে। অবশেষে পুলিশের গুলিতে শহিদ হল আমাদের রিয়ান। এ কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন শহীদের পিতা।

শহীদ রিয়ানের মা শাম্মী আক্তার বলেন, ৫ আগস্ট বিকেল ৪টার দিকে বিজয় মিছিল নিয়ে ওরা খিলজি রোড দিয়ে রিংরোডের দিকে যায়। আমাদের ওপরতলার একটা ছেলে মিডিয়াতে কাজ করে, রিংরোডে ছবি তুলতে গিয়ে, দেখেছে, রিয়ান গুলি খেয়েছে! সে তার মাকে জানিয়েছে।

আমি ছাদে শুকাতে দেওয়া কাপড় আনতে গিয়ে শুনতে পাই ওরা বলাবলি করছে-‘রিয়ানের গুলি লাগছে।’ এ কথা শোনামাত্রই আমি দৌড়াতে দৌড়াতে বাসায় এসে ওর আব্বাকে বলি, ‘আমার রিয়ান কই, ‘আমার রিয়ান কই!’

বাবা রাজ্জাক বলেন, একথা বলেই ওর মা দেখি ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে যাচ্ছে, আর বলছে, ‘আমার রিয়ানের কী হলো, কী হলো’, আমিও সঙ্গে সঙ্গে বাসার নিচে নেমে যাই; তখনি আমার বড় ছেলে রাফি ফোন দিয়ে বলে, ‘আব্বু তুমি কই, শিগগিরই আসো, রিয়ানের গুলি লাগছে।’

প্রথমে বিয়ানকে রিংরোডের একটা প্রাইভেট হাসপাতালে নেই। ওর বন্ধুরা বলে বেঁচে আছে। তখন দ্রুত সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমার তখনই মনে হয়েছে, ছেলে আর নেই। সেই সময় রিংরোডের মুখে চারটা ডেডবডি পড়ে ছিল। তখনও প্রচণ্ড গোলাগুলি হচ্ছে। গোলাগুলি একটু থামলে অ্যাম্বুলেন্স না পেয়ে এক আত্মীয়ের গাড়িতে ওকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে যাই।

গোলাম রাজ্জাক জানান, ‘সেদিন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে এত লাশ! এর আগে কখনও দেখিনি। চারতলার প্রত্যেকটা ওয়ার্ডে ১০-১২টা করে গুলিবিদ্ধ লাশ ছিল। আমার ছেলেকে ইমার্জেন্সিতে নিয়ে গেল, একটা পাইপ মুখে ঢুকিয়ে পাঞ্চ করল। এরপর চিকিৎসক বললেন, ‘ও অনেক আগেই মারা গেছে, আনতে অনেক দেরি হয়ে গেছে।’ এরপর আমরা ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ নিয়ে আসি।

পরে শ্যামলী জামে মসজিদে রাত ১২টার দিকে নিজ হাতে ছেলেকে গোসল করাই। ওখানেই জানাজা দিয়ে রাত ১টার দিকে কেরানীগঞ্জের (রিয়ানের নানাবাড়ি) আমবাগিচা কবরস্থানে ওর নানার কবরের পাশে লাশ দাফন করি।

সরেজমিন শ্যামলীর বাসায় গিয়ে দেখা যায়, পড়ার টেবিল ও সেলফে বই, ব্যাগ থরে থরে সাজানো। দেয়ালে ঝুলছে বেল্ট, পরিপাটি বিছানা। নেই শুধু বিছানায় আয়েশ করে বিশ্রাম নেওয়া বাবা-মায়ের আদরের রিয়ান।

ছেলের ব্যবহৃত জিনিসপত্র দেখিয়ে বাবা রাজ্জাক বলেন, টম ও জেরি নামে রিয়ানের দুটি পোষা বিড়াল আছে।

রিয়ানের মা আরও জানান, গত কুরবানির ঈদের পরের দিন সকালে রিয়ান বন্ধুদের সঙ্গে চাঁদপুর যায়, সেখানে গিয়ে পানিতে ডুবে গিয়েছিল। পরে অ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতালে নিয়ে আসি। সেই সময় সে লাইফ সাপোর্টে ছিল। দুই দিন পর ওর জ্ঞান ফিরে। তখন একবার ও মৃত্যু থেকে বেঁচে যায়।

ওকে বলেছি- দেখ, আল্লাহ একবার তোকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে, বারবার কি এমন হবে? তুই মৃত্যুটাকে এত খেলা মনে করিস কেন? ও বলত মরলে মরব। ছেলের ইচ্ছে ছিল পাইলট হবে। আমি বলতাম তোমাকে ডাক্তারি পড়াব। ও বলত আমি পাইলট হব। ছোট ভাই রাফসানকে তুমি ডাক্তারি পড়াইয়ো।

বাবা রাজ্জাক জানান, আমি চাই রিয়ানের কবরটি সরকারিভাবে বাঁধানো হোক। শ্যামলীর কোনো একটা রাস্তা রিয়ানের নামে নামকরণ করা হোক। তাতে আমার রিয়ান মানুষের মাঝে বেঁচে থাকবে। পরবর্তী প্রজন্ম দোয়া ও শ্রদ্ধাভরে রিয়ানকে স্মরণ করবে।

শহীদ নাসিব হাসান রিয়ানের বাবা গোলাম রাজ্জাক বলেন, আমার ছেলে নাসিব হাসান রিয়ান দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। মৃত্যুভয় তাকে আন্দোলনে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে পারেনি। শহীদ নাসিবের স্বপ্ন ছিল পাইলট হওয়া, কিন্তু সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। সে দেশের জন্য জীবন দিয়েছে।

শহীদ রিয়ানের মা শাম্মী আক্তার বলেন, আমার ছেলে রিয়ান আমার কলিজার টুকরো তাকে পুলিশ খুব কষ্ট দিয়ে হত্যা করেছে। সে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নায়কের ভূমিকা পালন করছিল। সে ছাত্র আন্দোলনের অগ্রভাগের ছাত্রনেতা ছিল। আমরা সবাই আমার ছেলে রিয়ানের জন্য দোয়া করবেন।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

অন্তর্বর্তী সরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শতভাগ ব্যর্থ : আমিনুল হক 

ধর্ষকদের বিচার দাবিতে ইবি শিক্ষার্থীদের মহাসড়ক অবরোধ

জয়-ববির সঙ্গে এনসিপির হুমায়রার ছবি দাবিতে প্রচার, যা জানা গেল

নেইমারের বার্সায় ফেরার স্বপ্ন শেষ

ধর্ষকের শাস্তি মৃত‍্যুদণ্ড চান নিলয় আলমগীর

শাবিপ্রবির ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ

চট্টগ্রামে কাপড়ের কারখানায় আগুন

কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের জন্য দুঃসংবাদ

বাসের ধাক্কায় একই সঙ্গে প্রাণ হারালেন স্বামী-স্ত্রী

যুবদল নেতা হত্যা মামলায় স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা গ্রেপ্তার

১০

সম্পত্তির জন্য স্ত্রী-সন্তানদের নির্যাতনের শিকার খুইল্লা মিয়া

১১

গাণিতিক সূত্রে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব প্রমাণ সম্ভব, দাবি বিজ্ঞানীর

১২

গাঁজা সেবনের অভিযোগে শিক্ষার্থীদের হাতে ধরা খেল পুলিশ

১৩

যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপের আলোচনায় প্রতিনিধি পাঠাচ্ছে ইসরায়েল

১৪

মবের সঙ্গে জড়িত সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা : তথ্য উপদেষ্টা

১৫

ঘুরতে বেরিয়ে ট্রাক্টরচাপায় প্রাণ গেল দুই বন্ধুর

১৬

কাজে গতি ফেরাতে কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিএসইসি চেয়ারম্যানের বৈঠক কাল

১৭

‘ইসলাম ধর্ষককে প্রকাশ্য বিচারের নির্দেশ দিয়েছে’

১৮

ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে সব ছাত্র সংগঠনকে এক হওয়ার আহ্বান

১৯

বিচারহীনতার কারণেই নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা থামছে না : ইউট্যাব

২০
X