বিদেশি ঋণের প্রবাহ কমেছে দেশের বেসরকারি খাতে। সুদের হার বৃদ্ধি ও দেশে ব্যবসার অনুকূল পরিবেশ না পাওয়ায় বিদেশি ঋণ থেকে সরে আসছেন ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি বিদেশি ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের ব্যবসায়ীদের দেওয়া ঋণ নবায়ন করতে চাইছে না। ফলে ক্রমেই কমছে বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণের পরিমাণ। এতে বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণ চার বছরে সর্বনিম্ন স্তরে নেমে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের জানুয়ারি ভিত্তিক প্রকাশিত প্রতিবেদনে তথ্য উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি শেষে বেসরকারি খাতের বৈদেশিক ঋণ দাঁড়িয়েছে ৯.৮০ বিলিয়ন ডলার। ডিসেম্বর শেষে এ ঋণ ছিল ১০.১৩ বিলিয়ন ডলার। চার বছর আগে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে দেশের বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৫.৪৬ বিলিয়ন ডলার। সে হিসাবে চার বছরে বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণ কমেছে ৫.৬৬ বিলিয়ন ডলার।
ব্যাংকাররা বলছেন, কভিড-১৯-এর সময় আন্তর্জাতিক বাজারে সুদের হার সর্বনিম্নে নেমে এসেছিল। এ কারণে ব্যবসায়ীরা দেশের ব্যাংকের তুলনায় বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিতে বেশি আগ্রহী ছিলেন। এখন বিশ্ববাজারে সুদের হার চড়া। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক সুদের হার কয়েক গুণ বাড়িয়েছে। এ কারণে বিদেশি ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো ইউরোপ-আমেরিকায় বিনিয়োগে উৎসাহ দেখাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, প্রায় দুই বছর ধরে বাংলাদেশে ডলারের তীব্র সংকট চলছে। অনেক ব্যবসায়ী ও ব্যাংক নির্ধারিত সময়ে বিদেশি ঋণ ও এলসি পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিদেশি অনেক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগ কমিয়ে আনতে চেয়েছে। অনুরোধ সত্ত্বেও কিছু বিদেশি প্রতিষ্ঠান বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি ঋণ নবায়ন করেনি।
এ কারণে বেসরকারি খাতের ঋণ কমে গেছে। চলতি বছর আরো কিছু স্বল্পমেয়াদি অনেক ঋণের মেয়াদ পূর্ণ হবে। বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো এসব ঋণ নবায়ন না করলে দেশে ডলার সংকট আরো তীব্র হয়ে উঠবে। পাশাপাশি বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নেওয়া ব্যবসায়ীদের বিপদ আরো বাড়বে।
একটি ব্যাংকের একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, গত তিন বছরে টাকার মান প্রায় ৩৫ শতাংশ কমেছে। অর্থাৎ ডলারে ঋণ পরিশোধের জন্য একজন গ্রাহককে অনেক বেশি পেমেন্ট করতে হয়েছে। হয়তো তিনি যখন লোন নিয়েছিলেন তখন ৮৫ টাকার বিনিময়ে ডলার পাওয়া যেত, অথচ পেমেন্ট করতে গিয়ে দেখেছেন ডলারের রেট ১২০ টাকায় উঠে গেছে। ভবিষ্যতে ডলারের দাম ওঠানামা করার এ শঙ্কার মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বাড়াতে ব্যবসায়ীদের নিরুৎসাহ করছে বলে মন্তব্য করেন ওই ব্যাংকার।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ এম হেলাল আহমেদ জনি কালবেলাকে বলেন, দেশের বর্তমানে বিনিয়োগের পরিবেশ এখনও সৃষ্টি হয়নি। এছাড়া সুদের হারও বেশি হওয়ায় ব্যবসায়ীরা বিদেশি ঋণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। পাশাপাশি টাকার অবমূল্যায়নের কারণে বিদেশি ঋণের খরচও বেড়েছে। তাই ব্যবসায়ীরা বিদেশ থেকে ঋণ নেয়া হচ্ছে পরিশোধে মনোযোগ বাড়িয়েছেন। দেশের বিনিয়োগ পরিবেশ ঠিক হলে এবং সুদের হার সহনীয় পর্যায়ে আসলে আবারো বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণ বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন এই অর্থনীতিবিদ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সামষ্টিক তথ্য বলছে, গত সেপ্টেম্বর শেষে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ১০৪.৩৬ বিলিয়ন বা ১০ হাজার ৪৩৬ কোটি ডলার। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাস শেষে যা ছিল ১০০.০২ বিলিয়ন বা ১০ হাজার ২ কোটি ডলার। অর্থাৎ সাত মাসে বিদেশি ঋণ বেড়েছে ৪.৩৪ বিলিয়ন ডলার বা ৪৩৪ কোটি ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুসারে, গত ফেব্রুয়ারির শেষে বিপিএম-৬ পদ্ধতিতে দেশের গ্রস রিজার্ভ ছিল ২০.৯০ বিলিয়ন ডলার। ২০২৪ সালের আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এই রিজার্ভ ছিল ১৯.৮৬ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দেশের রিজার্ভ বেড়েছে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার।
মন্তব্য করুন