আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তথ্য কমিশন দলীয় ক্যাডারের মাধ্যমে পরিচালিত হতো বলে মন্তব্য করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ও দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান।
এছাড়া বিদ্যমান আইনে এখনো কেন তথ্য কমিশন গঠন হয়নি এর জবাব সরকারকে দিতে বলেছেন তিনি।
বৃহস্পতিবার (০৬ মার্চ) ঢাকার ধানমন্ডিতে টিআইবির কার্যালয়ে তথ্য অধিকার ফোরাম আয়োজিত ‘তথ্য কমিশনের কার্যকারিতা ও তথ্য অধিকার আইনের সংশোধনী’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন।
২০০৯ সালের মার্চে তথ্য অধিকার আইন প্রণয়ন করা হয়। ওই বছরের জুলাইয়ে সাবেক সচিব এম আজিজুর রহমানকে প্রধান তথ্য কমিশনার করে তিন সদস্যের তথ্য কমিশন গঠন করে সরকার। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার পালাবদলের পর গত ১০ সেপ্টেম্বর ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সময় নিয়োগ পাওয়া প্রধান তথ্য কমিশনার আবদুল মালেককে অব্যাহতি দেওয়া হয়। একই সঙ্গে অব্যাহিত দেওয়া হয় তথ্য কমিশনার শহীদুল আলমকেও।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তথ্য কমিশনের একেবারে নেতৃত্ব পর্যায়ে ছিল দলীয় ক্যাডাররা। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে এই অবস্থা হবে না, সেটা আমরা আশা করতেই পারি।’
ছয় মাসের বেশি সময় ধরে তথ্য কমিশন না থাকার দায় অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর বর্তায় মন্তব্য করে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘একটি দেশে আইনগতভাবে একটি তথ্য কমিশন থাকার কথা, যা ৬ মাস ধরে নেই। এর মধ্য দিয়ে বৈশ্বিক প্রেক্ষিতে ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন হলো। কমিশন যে নেই, তা সরকারের অজানা নয়। কমিশন গঠনের দায়িত্ব যে সরকারের, সেটাও সরকারের অজানা নয়। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তথ্য কমিশন কার্যকর নেই। আইন উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা করে এটি কার্যকরের দাবি জানানো হয়েছে। তবে এতে কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। উদাসীনতা দেখা যাচ্ছে।’
প্রক্রিয়া পরিবর্তনের লক্ষ্যে সংস্কার কার্যক্রম চলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এ সংস্কার নির্দিষ্ট সময়ে হবে। কিন্তু তার আগেই দুর্নীতি দমন কমিশন, নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠিত হয়েছে বিদ্যমান আইনে। কেন তথ্য কমিশন গঠন হলো না, সেই প্রশ্নের জবাব সরকারকে দিতে হবে। অনতিবিলম্বে সেই দায়িত্ব সরকারের পালন করা উচিত। তথ্য কমিশনার হিসেবে এমন ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে হবে; যারা পেশাগত জীবনে তথ্য প্রকাশের পরিপন্থি অবস্থানে ছিলেন না। নিবন্ধনপ্রাপ্ত, লাইসেন্সপ্রাপ্ত সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান তথ্য অধিকার আইনের অধীন রাখার প্রস্তাব করছি। অর্থাৎ রাজনৈতিক দলও এ আইনের আওতাভুক্ত হোক; সেটা আমরা চাচ্ছি।’
সংবাদ সম্মেলনে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘রাজনৈতিক দলকেও তথ্য অধিকার আইনের আওতায় আনতে হবে। কারণ রাজনৈতিক দলের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক দল যদি স্বচ্ছ, জবাবদিহী না হয়, তাহলে কিন্তু আগের মতই হবে।’
আগের সরকারের মতো বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও নির্বাচন কমিশন (ইসি) থেকে তথ্য চেয়ে পাওয়া যায়নি, এটা কেন হবে—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘ইসিতে যেসব তথ্য থাকে, তার সব দিতে তারা বাধ্য। কেউ কেউ হলফনামা দিতেও গড়িমসি করে, এটা আইনের পরিপন্থি। এ আইনের বাস্তবায়ন নির্ভর করে নাগরিকদের ওপর। এর জন্য লড়াই করতে হবে।’
তথ্য অধিকার ফোরাম বলছে, গোপনীয়তার সংস্কৃতি থেকে উত্তরণের জন্যই তথ্য অধিকার আইন। এটি বাস্তবায়নে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। প্রস্তাব পেশ করার মধ্য দিয়ে মূলত দুটি দাবি জানিয়েছে তথ্য অধিকার ফোরাম। এর একটি হচ্ছে অবিলম্বে তথ্য কমিশন পুনর্গঠন করা। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে প্রস্তাবিত সুপারিশ নিয়ে আইন সংস্কারে সরকারে উদ্যোগ গ্রহণ। সরকারের কাছেও প্রস্তাবগুলো উপস্থাপন করবে তারা। কমিশন কার্যকর না থাকায় মাঠপর্যায়ে অনেকে বলছেন, আইনটি আর কার্যকর নেই।
লিখিত বক্তব্যে মিডিয়া রিসোর্সেস ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভের (এমআরডিআই) নির্বাহী পরিচালক হাসিবুর রহমান বলেন, আপিল কর্মকর্তা চিহ্নিত করতে অসুবিধায় পড়েন আবেদনকারীরা। এটি আরও সহজতর করতে হবে। সরকারের অংশীদারত্ব রয়েছে—এমন সব প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আওতা বাড়াতে হবে। সরকারের সঙ্গে চুক্তি আছে বা সরকারি কোনো সংস্থার কাছ থেকে লাইসেন্স, অনুমোদন নিয়ে যারা কার্যক্রম পরিচালনা করছে, তাদেরও তথ্য অধিকার আইনে তথ্য দিতে হবে। ইউনিয়ন কার্যালয়কে তথ্য প্রদান ইউনিট হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি করা হয়েছে।
তথ্য কমিশনের নাম তথ্য কমিশন বাংলাদেশ করার প্রস্তাব করেছে তথ্য অধিকার ফোরাম। যত দ্রুত সম্ভব তথ্য সরবরাহ করতে আইনে সংশোধনী আনার প্রস্তাব করেছে তারা। এতে বলা হয়, আবেদনের ২০ দিনের মধ্যে তথ্য সরবরাহ করবেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, এটি বর্তমানে আছে ২০ কার্যদিবস। একাধিক কর্তৃপক্ষ হলে ৩০ দিনের মধ্যে তথ্য দিতে হবে। তথ্য প্রদানে অপারগ হলে ১০ দিনের মধ্যে তা জানাতে হবে। কমিশনে সংসদের দুজন প্রতিনিধি থাকেন, সংসদ কার্যকর না থাকলে এ দুজন প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য আইনে সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রধান তথ্য কমিশনার বা কমিশনারের পদ শূন্য হলে সর্বোচ্চ ৪৫ দিনের মধ্যে নিয়োগ সম্পূর্ণ করতে হবে। বর্তমানে তথ্য প্রদানে আপিল কর্মকর্তার জন্য সময় বেঁধে দেওয়া বিষয়টি আইনে নির্দিষ্ট করা নেই। তাই এটি সংশোধন করে উপধারা ২৪ (৩)–এর অধীন তথ্য প্রদানে নির্দেশিত হলে উপধারা (১) ও (২)–এর ক্ষেত্রে ৭ দিনের মধ্যে এবং উপধারা (৪)–এর ক্ষেত্রে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তথ্য সরবরাহ করা হবে। এ ছাড়া তথ্য প্রদানে প্রতিবন্ধকতার দায়ে জরিমানা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
মন্তব্য করুন