বাংলাদেশের সরকারি ই-প্রকিউরমেন্ট (ই-জিপি) ব্যবস্থায় বাজার দখল, ঠিকাদারদের যোগসাজশ ও রাজনৈতিক প্রভাবের বিষয় উঠে এসেছে বেসরকারি সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে। পর্যবেক্ষণে তারা বলেছে, সরকারি ক্রয় খাত একটি জিম্মি অবস্থায় রয়েছে।
মঙ্গলবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর ধানমন্ডিতে টিআইবির কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এ প্রতিবেদন তুলে ধরেন।
টিআইবির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১১ সালে ই-জিপি চালুর পর থেকে এ ব্যবস্থার মাধ্যমে ৫ লাখ ৯৬ হাজার ৯২১ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। তবে সর্বোচ্চ অনুমোদিত চুক্তির মূল্য ৮৮১ কোটি টাকা হলেও এর চেয়ে বড় চুক্তিগুলো এখনও এই প্ল্যাটফর্মের আওতায় আনা হয়নি।
প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে ঠিকাদারদের মধ্যে অসম প্রতিযোগিতার প্রবণতা রয়েছে। শীর্ষ ৫ শতাংশ ঠিকাদার মোট প্রকল্প মূল্যের ৬১.৩১ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে, যেখানে সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ ঠিকাদারদের দখলে রয়েছে মাত্র ১ শতাংশেরও কম বাজার। বিশেষ করে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে শীর্ষ ৫ শতাংশ ঠিকাদার মোট প্রকল্প মূল্যের ৭৪.৯৬ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়া গত এক দশকে শীর্ষ ঠিকাদারদের বাজার দখলের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
নির্দিষ্ট মন্ত্রণালয়ভিত্তিক বিশ্লেষণ : সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ (আরটিএইচডি) : মাত্র ১১ শতাংশ ঠিকাদার ৯৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ প্রকল্প মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে। ১ শতাংশ ঠিকাদারই ৭২ দশমিক ৯ শতাংশ বাজার দখল করেছে। এই বিভাগে ৯টি বড় ঠিকাদারি নেটওয়ার্ক সক্রিয় রয়েছে।
. পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় : ৯ শতাংশ ঠিকাদার মোট প্রকল্প মূল্যের ৯১ দশমিক ৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। মাত্র ৩৮ ঠিকাদার ৩০ দশমিক ৯ শতাংশ বাজার দখল করেছে।
. গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় : ৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ ঠিকাদার ৭১ শতাংশ বাজার শেয়ার নিয়ন্ত্রণ করছে। ৮১ জন ঠিকাদার ৩২ দশমিক ৩২ শতাংশ বাজারের মালিক।
. স্থানীয় সরকার বিভাগ (এলজিডি) : ৯.৭৪ শতাংশ ঠিকাদার মোট প্রকল্প মূল্যের ৬২.৮৮ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। মাত্র ১ শতাংশ ঠিকাদার (২৯৪ জন) ২৭.৭ শতাংশ বাজার দখল করেছে।
রাজনৈতিক প্রভাব ও ঠিকাদারদের আধিপত্য : টিআইবির গবেষণায় দেখা গেছে, শীর্ষ ঠিকাদাররা যুগ্ম উদ্যোগ (জেভি) গঠন করে বড় প্রকল্প নিয়ন্ত্রণ করে, যার ফলে তাদের বাজার দখল আরও বেশি হয়।
এছাড়া, রাজনৈতিক নেতৃত্ব পরিবর্তনের ফলে শীর্ষ ঠিকাদারদের আধিপত্য বদলে যায়। যেমন- চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে মেয়র পরিবর্তনের পর শীর্ষ ১০ ঠিকাদারের তালিকা সম্পূর্ণ বদলে গেছে। শিল্প মন্ত্রণালয়েও মন্ত্রী পরিবর্তনের পর শীর্ষ ঠিকাদারদের তালিকায় বড় পরিবর্তন এসেছে।
গবেষণা প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো : টিআইবি সরকারি ই-প্রকিউরমেন্ট ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটির (বিপিপিএ) জন্য বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরেছে—
. যুগ্ম উদ্যোগ (জেভি) ফার্মগুলোর কার্যক্রম কঠোরভাবে পর্যালোচনা করা . একক ঠিকাদার সক্ষম হলে জেভি সীমিত করা . বাজার দখলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া . আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করা . প্রকৃত মালিকানা তথ্য প্রকাশ করা . উচ্চমূল্যের চুক্তি ই-প্রকিউরমেন্টের আওতায় আনা
টিআইবির পর্যবেক্ষণ : সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, পৃথিবীর সব দেশেই সরকারি ক্রয় খাত সবচেয়ে দুর্নীতিপ্রবণ। তবে বেশিরভাগ দেশেই এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। কিন্তু আমাদের দেশে নিয়ন্ত্রণ না হয়ে বরং এটি আরও জটিল পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে। আমাদের গবেষণায় সেটির একটি চিত্র উঠে এসেছে।
তিনি বলেন, ২০১২-২৪ সালের মধ্যে ৫ লাখ ৯৬ হাজার ৯৯১ কোটি টাকার কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে শীর্ষ ১০ মন্ত্রণালয় প্রায় ৯২ শতাংশ অর্থ ব্যয় করেছে। যা ৫ লাখ ৪০ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা। দশটি মন্ত্রণালয়ের গড়ে ৬১ শতাংশ কার্যাদেশ ৫ শতাংশ ঠিকাদারের হাতে চলে গেছে। মন্ত্রণালয় ভেদে এই নিয়ন্ত্রণের হার ৭৪-৮৪ শতাংশ। অন্যদিক থেকে নিম্নপর্যায়ের ১০ শতাংশ ঠিকাদার গড়ে ১ শতাংশের কম কার্যাদেশ পান।
ড. ইফতেখারুজ্জামান জানান, একক নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি নীতিমালার ফাঁক-ফোকর দিয়ে যৌথ মালিকানার ঠিকাদারি এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। যে কারণে যৌথ মালিকানার নামে একক কর্তৃত্ব আরও গভীর হয়েছে। ফলে প্রতিযোগিতার সুযোগ কমে যাচ্ছে, যা সরকারি কেনাকাটায় স্বচ্ছতা হ্রাস করছে। স্থানীয় সরকার বা মন্ত্রণালয়ে নেতৃত্বের পরিবর্তন হলে ঠিকাদারদের হাত বদল হয়, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ একই থেকে যায়। সার্বিকভাবে সরকারি ক্রয় খাত একটি জিম্মি অবস্থায় রয়েছে।
টিআইবি জানায়, সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হলে সরকারি প্রকিউরমেন্ট ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা বাড়বে এবং প্রকৃত প্রতিযোগিতা নিশ্চিত হবে। তাদের মতে, নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, বাজার শেয়ার সীমিতকরণ এবং প্রকৃত মালিকানার তথ্য উন্মুক্ত করা হলে ঠিকাদারদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হবে এবং সরকারি কেনাকাটায় সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে।
মন্তব্য করুন