জুলাই বিপ্লবে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন। এরপর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান ভারতে। এ খবর শোনার পর থেকে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে লাখ লাখ ছাত্র-জনতা ও সাধারণ মানুষ বিজয়-উল্লাস শুরু করেন।
তবে ৫ আগস্ট সারা দেশজুড়ে যখন বিজয় উৎসব চলছিল তখনও রাজধানীর মিরপুর এলাকায় পুলিশের সঙ্গে সাধারণ ছাত্র-জনতার ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও গোলাগুলি চলছিল। এর একপর্যায়ে আনন্দ মিছিল দেখতে গিয়ে মিরপুর থানার সামনে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন রিকশাচালক মতিউর রহমান (৫১)।
তার আকস্মিক মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না স্ত্রী ও সন্তানরা। অভাবের সংসার এখন কীভাবে চলবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তারা। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে কঠিন বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন স্ত্রী ও তিন সন্তান।
রাজধানীর মিরপুরের শিয়ালবাড়ি স্টাফ কোয়ার্টারের ৪ নম্বর ভবনের বাসায় বাসসের প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ মতিউর রহমানের বড় মেয়ে নুরুন্নাহার এসব কথা জানান।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ মতিউর রহমানের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার কমলাকান্তপুর গ্রামে। তার পিতার নাম আয়ুব আলী। চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে মতিউর ছিলেন সবার ছোট। রাজধানীর মিরপুর-২ এলাকায় সরকারি আবাসনে পরিবারের সঙ্গে বসবাস করতেন তিনি। মতিউরের গ্রামের বাড়ি কমলাকান্তপুর হলেও তাকে দাফন করা হয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার হরিপুর মহল্লার পূর্বপাড়া কবরস্থানে।
মতিউরের দুই মেয়ে ও এক ছেলে লেখাপড়া করে। বড় মেয়ে নার্সিংয়ে স্নাতক শেষ করে ইন্টার্ন করছেন শ্যামলী ইবনে সিনা হাসপাতালে। মেঝ মেয়ে দশম শ্রেণিতে ও ছেলে নবম শ্রেণিতে পড়ে মিরপুরের একটি স্কুলে।
সম্প্রতি আলাপকালে শহীদ মতিউরের মেয়ে নুরুন্নাহার বলেন, আমার বাবা ঢাকার আগারগাঁওয়ে পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রধান কার্যালয়ে অফিস সহায়ক পদে চাকরি করতেন। আব্বুর চাকরি স্থায়ী ছিল না। চাকরি স্থায়ী করার দাবিতে ২০১৯ সালে তিনি উচ্চ আদালতে মামলাও করেছিলেন। পরে ২০২২ সালে তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়। এতে কর্মস্থল থেকে শূন্য হাতে ফেরেন তিনি।
তিনি বলেন, পরিবার চালাতে বাধ্য হয়ে বাবা রিকশা চালানো শুরু করেন। আমাদের তিন ভাইবোনের পড়াশোনা ও সংসারের খরচ বাবার উপার্জনের ওপর নির্ভরশীল ছিল। এখন বাবা চলে যাওয়ায় আমাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
৫ আগস্ট গুলিতে মতিউর রহমান শহীদ হওয়ার ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে নুরুন্নাহার বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পতনের দিন ঢাকার রাস্তায় সর্বস্তরের মানুষ আনন্দ-উল্লাস করছিলেন। টিভিতে সেই দৃশ্য দেখে বাবাও অনেক খুশি হয়েছিলেন। দুপুর পর্যন্ত রিকশা চালিয়ে পাঁচ কেজি চাল কিনে বাসায় ফিরেছিলেন। দুপুরে খাওয়ার পর টিভিতে খবর দেখছিলেন। সরকারের পতন দেখে বাবা বলেছিলেন, এখন থেকে দেশে ভালো হবে। হয়তো আমার চাকরিটাও ফিরে পেতে পারি। যাই, রাস্তায় মানুষের আনন্দটা দেখে আসি। এই বলে বাসা থেকে বেরিয়ে যান বাবা। পরে বিকেলে মিরপুর থানার সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে বাবা লাশ হয়ে ফিরে আসেন। বাবা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী কেউ ছিলেন না, শুধু মানুষের আনন্দ দেখতে গিয়েছিলেন।
৫ আগস্ট রাত ১২টার দিকে বাবার লাশ নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের পথে রওনা হন নুরুন্নাহার ও তার পরিবারের সদস্যরা। ৬ আগস্ট ভোরে রাজশাহীতে পৌঁছলে চাচারা ফোন করে জানান, গ্রামের কবরস্থানে মতিউরের দাফন হবে না। কারণ, তিনি নাকি কবরস্থানের জন্য কোনো চাঁদা দেননি। পরে নানার বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার হরিপুর মহল্লার পূর্বপাড়া কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হয়।
কয়েক দিন পর পরিবারের সদস্যরা পারিবারিক জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। তারা গ্রামের বাড়িতে গেলে চাচারা জানিয়ে দেন, তাদের কোনো জমিজমা বা বসতবাড়ি নেই। তাদের বাবা নাকি সব সম্পত্তি চাচাদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। বিক্রির দলিল দেখতে চাইলে চাচারা তা দেখাতে অস্বীকৃতি জানান।
নুরুন্নাহার বলেন, ঢাকায় সরকারি আবাসনে কতদিন থাকতে পারব জানি না। আমাদের আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। আমি নার্সিংয়ে স্নাতক শেষ করেছি, ইন্টার্ন করছি। আমার মায়ের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আরবি পড়ানো ও টিউশনি করেই সংসার চলত। বাবা ছাড়া এখন কী হবে, বুঝতে পারছি না।
শহীদ মতিউর রহমানের স্ত্রী রোজিনা বেগম বলেন, যারা দেশের জন্য জীবন দিলেন, তাদের রেখে যাওয়া সোনার বাংলা যেন কোনো অপশক্তি কেড়ে নিতে না পারে, সেদিকে নজর রাখতে হবে।
নিহতদের শহীদের মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, যারা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত হয়েছেন, তাদের সবাইকে যেন শহীদের মর্যাদা দেওয়া হয়। শুধু মুখে শহীদ বললে হবে না, রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে।
সহায়তা পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে রোজিনা বেগম বলেন, জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে পাঁচ লাখ টাকার চেক ও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে দুই লাখ টাকা পেয়েছি। এছাড়া আমার বড় মেয়েটা নার্সিং পাস করেছে, তাকে যদি সরকার একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিত, তাহলে আমরা খেয়েপরে বেঁচে থাকতে পারতাম।
নিজ গ্রামে দাফন না হওয়া প্রসঙ্গে মতিউরের বড় ভাই এরফান আলী বলেন, আমার ভাই গ্রামে আসত না, কবরস্থান কমিটিকে বার্ষিক চাঁদা দিত না। কবর দিতে হলে ১০-১২ হাজার টাকা দিতে হতো, কিন্তু আমরা সেটার ব্যবস্থা করতে পারিনি। তাই এখানে লাশ নিয়ে আসতে মানা করেছিলাম।
বাড়িঘর ও জমিজমা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাড়িতে তার একটিই ঘর ছিল। কিছু জমিজমাও ছিল। সবই আমাদের দুই ভাইয়ের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে।
মন্তব্য করুন