রাজধানীর পূর্বাচলে বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টারে শেষ দিন ছিল আজ। শনিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) তিন দিনব্যাপী ১৩ম আন্তর্জাতিক পোলট্রি শোয়ের শেষ দিনে স্টলগুলোতে ছিল উপচেপড়া ভিড়। এদিনে কয়েক হাজার উদ্যোক্তা পোলট্রি ব্যবসা নিয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করেছেন।
মেলার সমাপনী অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এ শিল্প ও পরিবেশ সুরক্ষায় পোলট্রি আবর্জনা ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব দিতে হবে। পোলট্রি খামার স্থাপনকারী ও শিল্প উদ্যোক্তাদের পদচারণায় মুখরিত ছিল তিনদিনের এ মেলা। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞরাও যোগ দেন মেলায়। পোলট্রি, অ্যানিমেল ও মেডিসিন কোম্পানিসহ মোট ৮২৫টি দেশি-বিদেশি স্টল ছিল মেলায়। ছিল পোলট্রি ব্যবসায়ী, পোলট্রি ফিড ব্যবসায়ী, পোলট্রির সরঞ্জামাদি ব্যবসায়ী, মেডিসিন কোম্পানি, রিপ্রেজেনটেটিভ, ডাক্তার, বিশেষজ্ঞ, ইঞ্জিনিয়ারসহ পোলট্রি শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত হাজারও উদ্যোক্তা। সাসটেইনেবল পোলট্রি ফর এমাজিং বাংলাদেশ’ প্রতিপাদ্যে আয়োজিত এই মেলায় ১৮টি দেশের দুই শতাধিক কোম্পানি প্রযুক্তি ও সেবা নিয়ে মেলায় হাজির হয়। বাচ্চা উৎপাদন, লালনপালন, মার্কেটিং, পোলট্রি খাদ্য উৎপাদন, মৎস্য উৎপাদন, মাছের খাদ্য উৎপাদন, গরুর খামারসহ পোলট্রি, গবাদিপশু ও মৎস্য খাতের সবই ছিল এ মেলায়।
শেষ দিন হওয়ায় মেলা প্রাঙ্গণে ছিল উপচেপড়া ভিড়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা পোলট্রি খামারি ও উদ্যোক্তারা যেন হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন। ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন স্টল দেখছেন। কোন স্টলে নতুন কি প্রযুক্তি এসেছে ও মুরগির রোগ বালাই ও ভ্যাকসিনেশনের দিকেই বেশি নজর। খামার সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি সংগ্রহ করেছেন পোলট্রি ব্যবসায় সফল হওয়ার নানা কৌশল। স্টলগুলোতে থাকা এক্সপার্ট ও কোম্পানিগুলোর খামারের নতুন প্রযুক্তি, নতুন জাত ও টেকনিক্যাল বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে উৎসাহিত করেছেন উদ্যোক্তাদের। ওয়ার্ল্ড পোলট্রি সায়েন্স অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েশনের বাংলাদেশ শাখা ও বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের আয়োজনে এ মেলার সেমিনারে সারাবিশ্বের পোলট্রি খামারিরা এবং পোলট্রিসহ অন্যান্য অ্যানিমেল ব্যবসায়ী এবং বিশেষজ্ঞরা এখানে একত্রিত হয়েছিলেন। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞরা পোলট্রির নানা সমস্যা ও পোল্ট্রি শিল্পের ভবিষ্যৎ অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা করেন। শেষ দিনে সেমিনারে বিশেষজ্ঞরা বলেন, পোলট্রির বর্জ্য শোধন না করে জমিতে বা পানিতে সার হিসেবে ব্যবহার করলে সবজি এবং মাছে ক্ষতিকর উপাদান পাওয়া যায়। তাই বায়োগ্যাসে ব্যবহারের পর শোধন করে তারপরই সার হিসেবে পোলট্রি বর্জ্য ব্যবহার করতে হবে। তাই পরিবেশের জন্য ও এ শিল্পের সুরক্ষায় পোলট্রির আবর্জনা ভালোভাবে শোধন করা পরামর্শ দেন তারা।
মেলার আয়োজক সংস্থা ওয়ার্ল্ডস পোলট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ শাখার সভাপতি মসিউর রহমান বলেন, আন্তর্জাতিক পোলট্রি মেলায় দেশি-বিদেশি বিজ্ঞানীদের মধ্যে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের একটি অনন্য প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে। বিদেশি বিজ্ঞানীরা তাদের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের সঙ্গে শেয়ার করেছেন, যা দেশের পোলট্রি শিল্পের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এই মেলা থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনগুলো মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নের মাধ্যমে পোলট্রি শিল্পের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে হবে। পাশাপাশি দেশে-বিদেশের হাজার হাজার উদ্যোক্তার মধ্যে শক্ত সেতুবন্ধন তৈরি হবে। এই মেলা পোলট্রি শিল্পের উন্নয়নে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে এবং দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
গত বৃহস্পতিবার বিকেলে পোলট্রি মেলার উদ্বোধন করেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। এসময় তিনি উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনাদের এগিয়ে যাওয়া মানে বাংলাদেশ এগিয়ে যাওয়া। আমাদের দায়িত্ব হলো ক্ষুদ্র খামারিদের রক্ষা করা। মুরগিকে খারাপ কিছু খাওয়ানো হলে তা আবার খাদ্যের সাথে মিশে মানুষের পেটে যাচ্ছে। সেজন্যই অর্গানিক ফুড বিশ্বে নতুন চিন্তার দাড় উন্মুক্ত করেছে। অগার্নিক হওয়া মানে আধুনিক হওয়া; তাই অর্গানিক আরও বেশি বৈজ্ঞানিক। বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) সভাপতি শামসুল আরেফিন খালেদ বলেন, ২০৫০ সাল নাগাদ দেশের জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডিম, দুধ ও মাংসের চাহিদাও দ্বিগুণেরও বেশি হবে। এ চাহিদা মেটাতে স্বল্প জমি ব্যবহার করে অধিক খাদ্য উৎপাদন করতে হবে। আর এজন্য পোলট্রি খাতে আধুনিক জ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহার করা জরুরি।
ওয়াপসা-বাংলাদেশ শাখার সাধারণ সম্পাদক ডা. বিপ্লব কুমার প্রামাণিক বলেন, বাংলাদেশে পোলট্রি শিল্পের যাত্রা শুরু হয়েছিল ওয়াপসা-বিবি আয়োজিত আন্তর্জাতিক পোলট্রি মেলার হাত ধরে। জরাজীর্ণতাকে কাটিয়ে নতুন এক সম্ভাবনাময় দেশ গড়ার ডাক এসেছে আমাদের সবার জন্য। সাধারণ খামারিদের কথা ভাবতে হবে, কারণ তাদের সংখ্যাই বেশি। খামার থেকে শুরু করে খাবারের প্লেট পর্যন্ত পুরো চেইনকেই সঠিক ব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে হবে। তিনি আশা করে বলেন, এবারের আয়োজনও দেশের পোলট্রি খাতকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করবে।
মেলায় উদ্যোক্তারা বলেন, সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা না থাকলে কাউকেই পোলট্রি খামারের নিবন্ধন দেওয়া ঠিক হবে না। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয় মাথায় রেখে বিজ্ঞানীদের শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন মুরগির জাত উদ্ভাবন করতে হবে। রিসাইক্লিংয়ের কথাও গুরুত্বের সাথে ভাবতে হবে। সরকার পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ শিল্প স্থাপনে প্রণোদনা এবং স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করে- এই বিষয়ে উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে হবে।
মন্তব্য করুন