অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস দীর্ঘমেয়াদে দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের আইনি কাঠামো তৈরির জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে সংস্কার প্রক্রিয়া সঠিকভাবে এগিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি রাজনৈতিক দলের নেতাদের উদ্দেশে বলেন, ‘সংস্কার যদি আমরা সঠিকভাবে করতে পারি, তাহলে বাঙালি জাতি হিসেবে যতদিন টিকে থাকবে ততদিন আপনাদের অবদান থেকে যাবে’।
শনিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠকে অধ্যাপক ইউনূস এ কথা বলেন।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আজ প্রথম সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। সংলাপে প্রধান উপদেষ্টা সভাপতিত্ব করেন।
প্রধান উপদেষ্টা তার বক্তব্যের শুরুতে জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ও আহত যোদ্ধাদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন।
আজকের সংলাপের মাধ্যমে সরকারের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হলো উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, আজ আমাদের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়েছে। আপনারা দ্বিতীয় পর্বের স্রষ্টা। আপনারা সংস্কার সুপারিশগুলো জাতির সামনে নিয়ে আসবেন। আপনাদের সহযোগিতা করার জন্য কমিশনের সদস্যরা নিয়োজিত থাকবেন। আলাপ-আলোচনা করে ঠিক করুন, যেন আমরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে কাজে নেমে পড়তে পারি। নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার গঠিত হবে কেউ যেন তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে না পারে।
ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশগুলো সুবিবেচনা প্রসূত ইঙ্গিত করে ড. ইউনূস আরও বলেন, দেশের ঐক্য ও বিদেশের সমর্থন বিবেচনা করে সংস্কার কমিশন সুপারিশ নিয়ে এসেছে। এটি মূল্যবান সম্পদ। এই সম্পদ বাংলাদেশের ইতিহাসে রক্ষিত হবে। সবাই মিলে পরামর্শ দেন কোনগুলো বাস্তবায়ন করব। নীতিমালা বানিয়ে দিলে স্বচ্ছভাবে দেশ চলতে থাকবে। কলকাঠি নাড়ানো ছাড়া যে একটা দেশ নিয়মের মধ্যে চলতে পারে, সেটাই আমাদের করতে হবে।
সরকার সংস্কার প্রস্তাব চাপিয়ে দেবে না উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, সংস্কারটা যেন এমনভাবে হয় যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম আমাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকে। ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরা তাদের জায়গা থেকে ভালো কিছু দেয়ার চেষ্টা করেছেন। এখান থেকে কতটুকু গ্রহণ করব, কীভাবে অগ্রসর হবো এর জন্য আপনাদের সঙ্গে আলোচনা করা। কোনটা কাজে লাগাতে পারব, কোনটা গ্রহণ করব। আপনারা জনগণের প্রতিনিধি, তাই আপনাদের সঙ্গে এ নিয়ে একটা বাস্তবভিত্তিক আলোচনা হতে হবে। এমন মজবুতভাবে আইনকানুন করব, যাতে সবাই মেনে চলে এবং মেনে চলার মাধ্যমে একটা সুন্দর সমাজ তৈরি করা যায়।
তিনি বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে সুপারিশগুলো নিয়ে এসেছি। চাপানোর ক্ষমতা আমাদের নেই। আমরা কেবল বুঝাবো কেন প্রয়োজন এবং কীভাবে করা যায়। বাকিটা আপনাদের কাজ। একটু রদবদল করলে দেখবেন সুন্দর হয়ে যাবে। আমরা কেবল সাচিবিক কাজ করে দিবো।
সরকারের প্রথম পর্বে (ছয় মাস) দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সমর্থনের কথা উল্লেখ করে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান বলেন, প্রথম পর্বের একটা অভিজ্ঞতা হলো, সরকার দেশের জনগণের ও আন্তর্জাতিক বিশ্বের সমর্থন দুটোই পেয়েছে। সারা পৃথিবীজুড়ে আমাদের প্রতি বড় রকমের সমর্থন গড়ে উঠেছে। যে কারণে অপরপক্ষ (ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারী সরকার) সুবিধা করতে পারছে না, বহু গল্প করার চেষ্টা করছে, কিন্তু কোনো গল্প টিকাতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে গিয়ে গল্প চালাতে পারল না। ছোট রাষ্ট্র, বড়, মাঝারি এবং ধনী সকল রাষ্ট্র আমাদের সমর্থন করছে। কারোর কোনরকম দ্বিধা নেই।
তিনি বলেন, কোনো রাষ্ট্রের প্রধানের সঙ্গে যখন আমরা কথা বলি, তখন তারা বলে আপনাদের কী লাগবে। আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি। একটি দেশের সরকার প্রধানের সঙ্গে এর চেয়ে ঘনিষ্ঠভাবে কথা বলা, আর কী হতে পারে। তারা এ পর্যন্ত আমাদের মেনে নিয়েছে এবং ক্রমাগতভাবে তাদের সমর্থন বেড়ে চলেছে। অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক- এই দুই সমর্থন পাওয়ার পরও যদি আমরা নতুন বাংলাদেশ গড়তে না পারি, সেটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যের হবে। আমরা এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাই না।
সংস্কার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আন্তর্জাতিক মহল আমাদের বলে যে তোমাদের অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা করতে পারি কিন্তু সংস্কারটা তোমাদের করতে হবে।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সমর্থন, সহযোগিতা এবং তাদের শুভেচ্ছা আমাদের জন্য মস্ত বড় সম্পদ। আমরা তাদেরকে বহু রকমের স্বপ্নের কথা বলেছি,তারা বলেছে তোমরা করতে পারলে আমাদের সমস্যা নেই। কোন কোন শক্তিশালী দেশ আমাদের বিশেষভাবে সহায়তা করতে চায়। তাই বলছি, সংস্কার সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ব্যর্থ হতে চাই না।
তিনি রাজনৈতিক নেতাদের উদ্দেশ্য করে আরও বলেন, যে আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মাধ্যমে স্বৈরাচারী সরকার সুযোগ পেয়েছিল, সেই কাঠামো থেকে যেন আমরা অন্যরূপে বেরিয়ে আসতে পারি। হাডুডু খেলার ক্ষেত্রে আইন মেনে চললেও দেশটাকে একটা তামাশায় পরিণত করা হয়েছিল। আইন বলে কিছু ছিল না, নিয়ম বলে কিছু ছিল না। জুলাই বিপ্লবে যারা আত্মাহুতি দিয়েছেন, তারা নির্দেশ দিয়ে গেছে আমরা যেন সেই আইনকানুন বাদ দিয়ে ফেলে নতুন বাংলাদেশের জন্য প্রস্তুত হই। কী আইন প্রয়োজন হবে সেগুলো মাথায় রেখে সংস্কার কমিশন করা হয় এবং কমিশনে যারা ছিলেন,তারা তাদের কাজটি করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, সংস্কার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে আমরা যদি আমাদের ঐক্যকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে পারি, তাহলে সেটি বংশ পরম্পরায় চলতে থাকবে। মসৃণভাবে সংলাপ চালিয়ে নেয়ার জন্য তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, আমরা এক লন্ডভন্ড অবস্থার মধ্যে দায়িত্ব নিয়েছিলাম। এই ছয় মাসের অভিজ্ঞতা হলো,দলমত নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক ব্যক্তি সবাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সহায়তা দিয়েছে। আমাদের মধ্যে অনেক তর্কবিতর্ক আছে, তবে আমাদের মধ্যে ঐক্য আছে এবং এটি বজায় থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।
জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী সরকার কর্তৃক দেশের মানুষের ওপর চালানো নির্মম নির্যাতনের বিষয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনের প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করেন ড. ইউনূস।
তিনি বলেন, জাতিসংঘের এই প্রতিবেদন হলো আমাদের প্রতি বিদেশিদের আর একটা সমর্থন। এখন কারোর বানানো বয়ান আর কেউ শুনবে না, ওইটা চূড়ান্ত। আর কত সমর্থন চাই আমরা, একেবারে অক্ষরে অক্ষরে তারা বলে দিয়েছে কাকে কোথায় মারা হয়েছে। এর থেকে বের হওয়ার তো কারোর উপায় নেই। বাংলাদেশকে ঘিরে যে অপপ্রচার চলছিল,এই প্রতিবেদন তা বন্ধ করে দিয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
সরকারের প্রথম ছয় মাসের কথা উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, যারা আমাদের ব্যাহত করার চেষ্টা করেছে, তাদেরকে ভালভাবে মোকাবিলা করতে পেরেছি। দ্বিতীয় পর্বেও এই হাঙ্গামা হবে। যাদের বাংলাদেশের মানুষ তাড়িয়ে দিয়েছে, অস্বীকার করেছে ও ত্যাগ করেছে, তারা ফিরে আসার জন্য অত্যন্ত ব্যাকুল। সেজন্য আমাদের শক্ত থাকতে হবে, মজবুত থাকতে হবে। একত্রে থাকতে হবে।
স্বৈরাচারী সরকারের গোপন বন্দিশালা ‘আয়নাঘর’ পরিদর্শনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ড, ইউনূস আরও বলেন, মানুষ কতটা নির্মম হতে পারে, নৃশংস হতে পারে, এর চেয়ে বড় নমুনা মনে হয় আর পাওয়া যাবে না। আমাদের দেখতে কষ্ট লেগেছে, কিন্তু যারা এখানে বছরের পর বছর কাটিয়েছে, তাদের প্রতিটি বর্ণনা ও অভিজ্ঞতা গুম কমিশনের রিপোর্টে তুলে ধরা হয়েছে।
তিনি বলেন, প্রতিজ্ঞা করি আমরা যেন গণঅভ্যুত্থানের যোদ্ধাদের আত্মত্যাগের প্রতি অসম্মান না জানাই। যে কারণে তারা আত্মত্যাগ করেছিল সেটা যেন পরবর্তী সব প্রজন্ম মনে রাখে, তাদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে, তাদের আত্মত্যাগকে সার্থক করার জন্য আমরা সবাই মিলে সবরকম চেষ্টা করবো, তাদের সে স্বপ্ন যেন বাস্তবায়ন করতে পারি।
মন্তব্য করুন