জুলাই আন্দোলনে গণহত্যায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। এতে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে এবং বিচার বিভাগের জন্য একগুচ্ছ সুপারিশ করা হয়েছে।
বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশে জুলাই এবং আগস্ট ২০২৪-এ সংঘটিত প্রতিবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং অবমাননার বিষয়ে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় (ওএইচসিএইচআর)।
এতে বলা হয়, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন এবং অন্যান্য অপব্যবহার, জোরপূর্বক গুম এবং যৌন ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার তদন্ত ও বিচারের জন্য কার্যকর, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ এবং সমন্বিত প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে। এর মধ্যে ২০২৪ সালের কোটা বিক্ষোভের পূর্ববর্তী মামলা এবং প্রতিশোধমূলক সহিংসতা সম্পর্কিত মামলাগুলো রয়েছে। যেসব অপরাধী নির্দেশদাতা ও নেতৃত্বদানকারীদের হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে তাদের বিদ্যমান আইন ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের আলোকে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে, ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য কার্যকর প্রতিকার এবং ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে।
অবিলম্বে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সরকারি আদেশ এবং অন্যান্য অভ্যন্তরীণ নথি এবং ফরেনসিক প্রমাণসহ প্রাসঙ্গিক প্রমাণগুলো সংকলন এবং সংরক্ষণ করুন করতে হবে। এছাড়া এবং প্রমাণ ধ্বংস বা লুকানোর চেষ্টাকারী কর্মকর্তাদের এবং অন্যদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ও ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সাক্ষী সুরক্ষার ওপর দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা আইনী প্রণয়ন এবং জরুরি ভিত্তিতে ভিকটিম ও সাক্ষী সুরক্ষা প্রোগ্রাম প্রতিষ্ঠার জন্য জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ কররতে হবে। নিরাপত্তা বাহিনীর স্বাধীনতা সুরক্ষা এবং সাক্ষীদের ভয় দেখানো প্রতিরোধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা এবং ফৌজদারি তদন্তের উদ্যোগ নিতে হবে।
ইস্যুভিত্তিক সাধারণ নির্দেশাবলি আইনের স্থগিতাদেশ বাতিল করতে হবে। ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ১৩২ ধারা এবং অন্যান্য অনুরূপ আইনে যে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছিল তা রহিতকরণ সাপেক্ষে সরকারি কর্মকর্তাদের তদন্ত এবং বিচারের জন্য অনুমতি প্রদান করতে হবে।
বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে সংঘটিত গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে জড়িত অপরাধগুলোকে নিয়মিত আদালতে বিচার যায় তা নিশ্চিত করার জন্য আইনি কাঠামোর সংস্কার করতে হবে। এমনকি যদি সামরিক সদস্যদের বা সামরিক এখতিয়ারের অধীন অন্যকোনো কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়।
গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগে অভিযুক্ত নির্দেশ এবং নেতৃত্ব পর্যায়ে কর্মকর্তাদের সাময়িক বরখাস্ত করতে হবে। যেসব অপরাধগুলোর তদন্ত ঝুলে আছে সেগুলোর সম্পূর্ণ, স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ তদন্ত সম্পন্ন এবং বিচারের আওতায় আনতে হবে।
সার্বিক ও প্রেক্ষাপটের উপযোগী ক্রান্তিকালীন বিচার মডেল গড়ে তোলার লক্ষ্যে দেশব্যাপী অন্তর্ভুক্তিমূলক সংলাপ এবং পরামর্শের উদ্যোগ নিতে হবে। এ মডেলে ন্যায্য এবং ফৌজদারি বিচার সম্পন্ন করার জন্য বিশেষত যারা সবচেয়ে দায়ী অপরাধী। ব্যাপকভাবে ভিকটিমকেন্দ্রিক এ বিস্তৃত প্রক্রিয়া জন্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের দীর্ঘ পরম্পরা তা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখবে। এর লক্ষ্য অপরাধের পুনরাবৃক্তি প্রতিরোধ, সামাজিক সৌর্হাদ্য বৃদ্ধি এবং জাতীয় নিরাময় বা হিলিং প্রতিক্রয়া ত্বরান্বিত করা। সত্যসন্ধান, ক্ষতিপূরণ, স্মৃতিচারণ, নিরাপত্তা সেক্টর পর্যালোচনা ও নিশ্চিত করতে হবে যাতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃক্তি না ঘটে।
ভিকটিমকেন্দ্রিক যে ক্ষতিপূরণ প্রক্রিয়া তার জন্য অগ্রমী এবং পর্যাপ্ত বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে। স্বাধীন এবং নিরপেক্ষভাবে ভিটটিমদের দাবিগুলো মূল্যায়ন করতে হবে, সাম্য ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ, চিকিৎসা ও অন্যান্য সহায়তা প্রদান করতে হবে।
সততা, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ এবং যোগ্যতাসহ পেশাদার পূর্ণকালীন কর্মীদের দিয়ে একটি স্বাধীন পাবলিক প্রসিকিউশন সার্ভিস প্রতিষ্ঠা করতে হবে। রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্টতা বা পূর্বধারণাসহ কোনো ধরনের পক্ষপাতের ছাড়াই লোকবল নিয়োগ দিতে হবে এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে ৷ পাবলিক প্রসিকিউটররা ভয়ভীতি, হয়রানি বা অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ ছাড়াই কাজ করতে সক্ষম এমন পরিবেশ নিশিচত করতে হবে।
আইনে এবং প্রয়োগিক ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক এবং ব্যক্তি পর্যায়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। বিচারকদের নিয়োগ, বরখাস্ত, প্রত্যাহার এবং শৃঙ্খলা সম্পর্কিত পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে একটি দায়িত্বশীল স্বাধীন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে যাতে করে বিচারকরা রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হস্তক্ষেপ, দুর্নীতি, ভয়ভীতি এবং হয়রানিরসহ অপ্রত্যাশিত বা অযাচিত হস্তক্ষেপ থেকে সুরক্ষা পায়। বিচারকদের জন্য পর্যাপ্ত পারিশ্রমিক নিশ্চিত করা এবং বিচারকদের চাকরির মেয়াদ শেষ না পর্যন্ত অবসর গ্রহণের মতো পরিস্থিতি তৈরি না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। মানবাধিকারসহ উপযুক্ত প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ দিতে হবে, যাতে ম্যাজিস্ট্রেটরা নিষ্ঠার সাথে এবং স্বাধীনভাবে তাদের তত্ত্বাবধানে চলমান কাজগুলো যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে পারে, বিশেষত নিরাপত্তা বাহিনী দ্বারা গ্রেপ্তার এবং আটক এবং বলপ্রয়োগের ক্ষেত্রে।
আইন প্রয়োগকারী কার্যক্রম যার অন্তভুক্ত গ্রেপ্তার, অনুসন্ধান, জব্দ এবং নজরদারির কাজগুলো যাতে যথাযথভাবে করতে পারে সে জন্য বিচার বিভাগকে উপযুক্ত বাজেট এবং প্রয়োজীয় জনবল দিতে সহায়তা করতে হবে। বিচার বিভাগের সরকার বা রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে এবং প্রতিষ্ঠানিক উপায়ে এর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
বলপূর্বক নিখোঁজসংক্রান্ত মানবাধিকার লঙ্খনের ঘটনাগুলো প্রকাশ এবং এতদসংক্রান্ত সুপারিশ ও ফলাফলগুলো দক্ষতার সঙ্গে পরিবীক্ষণ ও বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা জন্য জাতীয় কমিশনকে সহায়তা এবং পর্যাপ্ত রিসোর্স সরবরাহ করতে হবে। গোয়েন্দা, আধাসামরিক, পুলিশ বা সামরিক বাহিনী দ্বারা পরিচালিত আটকের সমস্ত গোপন স্থান সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশ করতে হবে এবং সেগুলো বন্ধ করতে হবে। এই ধরনের জায়গায় সংঘটিত বলপূর্বক গুম, নির্যাতন এবং অন্যান্য অপরাধের চিহ্নিত অপরাধীদের তদন্ত ও বিচারের আওতায় আনতে হবে।
মন্তব্য করুন