গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। মূলত এর পর থেকে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের অবনতি ঘটে। সরকারি পর্যায়ে দুই দেশের মধ্যে দু-একটি বৈঠক হলেও তাতে পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। প্রতিবেশী দুই দেশের পাল্টাপাল্টি তলব, বিবৃতি ও পাল্টা বিবৃতি চলছেই। প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে সম্পর্কোন্নয়নের পথ কী?
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো বলছে, অবশেষে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির একটি বৈঠকের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। আর সেটা হতে পারে আগামী এপ্রিলে থাইল্যান্ডের ব্যাংককে। ৪ এপ্রিল ব্যাংককে বিমসটেক সম্মেলনে ড. ইউনূস ও নরেন্দ্র মোদি দুজনই যোগ দিচ্ছেন। ওই সময় তাদের দুজনের মধ্যে আলাদা বৈঠকের প্রস্তুতি চলছে বলে জানা গেছে। আর দায়িত্ব নেওয়ার পর গত বছরের আগস্টে দুজনের মধ্যে ফোনালাপ হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে আবারও দেখা হচ্ছে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে। তাদের মধ্যেও বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। আর সেটা হতে পারে ওমানের রাজধানী মাসকটে ভারত মহাসাগরীয় সম্মেলনে।
অষ্টম ইন্ডিয়ান ওসান কনফারেন্সের তারিখ নির্ধারণ হয়েছে ১৬ থেকে ১৭ ফেব্রুয়ারি। আর ওই সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টার ওই বৈঠকে যোগ দেওয়ার এবং সম্মেলনের ফাঁকে তাদের দুজনের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।
এর আগে অবশ্য গত বছরের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সময় নিউইয়র্কে তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে জয়শঙ্করের বৈঠক হয়েছে। ওটা ছিল ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তাদের প্রথম বৈঠক। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে তখন দুই দেশ পারস্পরিক সম্পর্ক এগিয়ে নিতে সম্মত হয়।
অন্যদিকে বাংলাদেশে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ডিসেম্বরে সংক্ষিপ্ত সফরে ঢাকা আসেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি। তিনি বাংলাদেশের পরারাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিনের সঙ্গে ১২ ঘণ্টার বৈঠক ছাড়াও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন এবং সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
এ ছাড়া আগামী ১৭ থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি ভারতের নয়া দিল্লিতে চার দিনের ৫৫তম বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠক হবে ৷
বাংলাদেশ-ভারতের সমস্যা কোথায়? গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকেই বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের টানাপড়েন শুরু হয়। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ ইস্যু থাকছেই৷ আর বাংলাদেশেও তাই। আর আছে ভারতীয় মিডিয়ার ‘অপপ্রচার’। সেটা বাংলাদেশি মিডিয়ায়ও কমবেশি হচ্ছে। সীমান্ত সংকট আরও বেড়েছে। ভারতের রপ্তানি বাংলাদেশে কমে গেছে। আর বাংলাদেশিদের জন্য ভারতীয় ভিসা বলতে গেলে প্রায় বন্ধ।
বাংলাদেশি কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ৫ আগস্টের পর দুই দেশের সম্পর্কে যে সমস্যা হচ্ছে, তার মূল কারণ হলো ইউনূস সরকারকে ‘গ্রহণযোগ্যতার মধ্যে নিতে চাইছে না ভারত’৷ আর বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান নিয়ে তাদের মতো করে তারা ন্যারেটিভ তৈরি করছে। সেটা ভারতীয় মিডিয়াও করছে। তারা বাংলাদেশকে সমমর্যাদার প্রতিবেশী মনে করছে না। এসবের বাইরে শেখ হাসিনা একটা বড় ইস্যু। বাংলাদেশ মনে করে, ভারত শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে ঠিক করেনি। আর তাকে ফেরত না দিয়ে উল্টো তাকে ‘বাংলাদেশের বিরুদ্ধে’ কাজে লাগাচ্ছে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ূন কবির বলেন, ‘ভারত তো বলেই দিয়েছে যা তারা বাংলাদেশে একটি নির্বাচিত সরকারের অপেক্ষায় আছে। সেই সরকারের সঙ্গেই তারা কাজ করতে চায়। এখান থেকেই বোঝা যায় অন্তর্বর্তী সরকারকে তারা কী চোখে দেখে। এটা তো এই দেশের জন্য সম্মানের নয়। শেখ হাসিনা একটা উপাদান। এটা ছাড়া ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান, স্বাধীনতা, এসব ব্যাপারে বাংলাদেশ নিয়ে ভারত ন্যারেটিভটাই পরিবর্তন করে দিতে চায়। আমাদের মধ্যে এখন একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে ভারত চায় না। পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং অস্বস্তির কারণেই সম্পর্কটা স্বাভাবিক হচ্ছে না বলে আমার ধারণা’ বলেন তিনি।
এম হুমায়ূন কবির বলেন, ‘তারা কোনোভাবেই বাস্তবতাকে মানতে চাইছে না। আহলে এখন যারা বাংলাদেশে ক্ষমতায় আছে তারা কারা? এটা তারা না বুঝলে সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে বলে মনে হয় না৷ আগে তারা যা চাইত তাই পেত। এখন তো আর পায় না।’
আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. লাইলুফার ইয়াসমিন বলেন, ‘আমাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ আমরা নির্ধারণ করব। আমরা আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় আমরা কীভাবে দেখব কীভাবে সমাধান করব সেটা আমাদের বিষয়। ভারতকে এটা বুঝতে হবে। তারা বাংলাদেশের সরকারকে অনির্বাচিত সরকার বলছে। কিন্তু ভারত তো অনির্বাচিত আফগান সরকারের সঙ্গে কাজ করেছে। তারা আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। এই চিন্তা থেকে তাদের বেরিয়ে আসতে হবে।’
আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, ‘ভারত বাংলাদেশকে সম্মানের চোখে দেখে না। এটই বড় সমস্যা৷ তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সব সময়ই মন্তব্য করে৷ এটা সম্পর্কের ক্ষেত্রে বড় বাধা। আর তারা যে বলছে বাংলাদেশে একটি নির্বাচত সরকার এলে সম্পর্ক এগিয়ে নেবে– এটা অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল। কারণ বাংলাদেশে এখন যে সরকার আছে তারা নির্বাচিতের চেয়েও বড়। তারা সবার সম্মতি ও পছন্দের সরকার।’
দ্বিপক্ষীয় সমাধান কীভাবে? পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বা মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক অথবা একদম শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকে যে বাংলাদেশ ভারতের সম্পর্ক ভালো হয়ে যাবে এমন আশা করেন না কেউই। তারপর বৈঠক হওয়া ভালো, তাতে যদি অস্বস্তি কিছুটা কাটে৷ ‘আর আমার মনে হয় সম্পর্ক সাবলীল হতে পারে যদি প্রফেসর ইউনূস ও নরেন্দ্র মোদির মধ্যে কোনো বৈঠক হয়। আসলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বা উপদেষ্টা, সচিব পর্যায়ে বৈঠকে এর কোনো সমাধান আসবে বলে আমার মনে হয় না। এই বৈঠকগুলো আসলে আনুষ্ঠানিকতা মাত্র’ বলেন এম হুমায়ূন কবির ৷
আর অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরীর মতে, ‘উপদেষ্টা বা প্রধান উপদেষ্টা বা প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে বাংলাদেশের সঙ্গে বৈঠক হলে সম্পর্কের বরফ গলতে পাবে। স্বাভাবিক হওয়ার পথ তৈরি হতে পারে৷ তবে এর চেয়েও বড় বিষয় হলো ভারত যে চোখে বাংলাদেশকে দেখে, যেভাবে ট্রিট করে– এটা তাদের বদলাতে হবে। পরিবর্তনটা বুঝতে মেনে নিতে হবে৷ আন্তরিক হতে হবে। বাংলাদেশকে তারা ছোট চোখে দেখে। সেটা হলে তো হবে না।’
অধ্যাপক ড. লাইলুফার ইয়াসমিন মনে করেন, ‘দুই দেশের মন্ত্রী বা শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠক হলে সম্পর্কের বরফ গলতে পারে। কিন্তু তাতেও আমি মনে করি সময় লাগবে৷ কারণ সম্পর্কের দূরত্ব অনেক বেড়েছে৷ সবার আগে আমি মনে করি দুই দেশের মিডিয়াকেই তাদের লাগাম টানতে হবে। বিশেষ করে ভারতীয় মিডিয়া বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ব্যাপক অপপ্রচার করছে৷ বাংলাদেশেও যে একদম হচ্ছে না তা কিন্তু নয়৷ তবে ভারতের তুলনায় অনেক কম।
সূত্র : ডয়চে ভেলে
মন্তব্য করুন