জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন বিদ্যমান মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সংখ্যা কমিয়ে ও সেগুলোকে একীভূত করে নতুন নামে মন্ত্রণালয় ও বিভাগের নামকরণের প্রস্তাব করেছে। এ ছাড়া একাধিক বিভাগ সংবলিত মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীকে পরামর্শ ও সমন্বয় করতে সেগুলোতে প্রিন্সিপাল সেক্রেটারির প্রস্তাব করা হয়েছে।
শনিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে। এদিন জনপ্রশাসনসহ ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন বিদ্যমান বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগ পুনর্বিন্যাসের প্রস্তাব করেছে। কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী, মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা হবে ২৭টি (রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়সহ)। মন্ত্রণালয়/বিভাগের সংখ্যা ৪৫টি, মন্ত্রীর সংখ্যা ২৭, প্রতিমন্ত্রী/উপমন্ত্রী ১২ জন, মন্ত্রিপরিষদ সচিব ১ জন, প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি ১৭ জন (একাধিক বিভাগ সংবলিত মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীকে পরামর্শ প্রদান ও সমন্বয়ের জন্য একজন প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি থাকতে পারে), সচিবের সংখ্যা ৪২ জন।
বিদ্যমান মন্ত্রণালয়/বিভাগকেও পুনর্গঠনের প্রস্তাব করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তা হলো౼
১. রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ের আপন বিভাগ ও জনবিভাগকে বহাল রেখে সেখানে দায়িত্ব বণ্টন করবেন রাষ্ট্রপতি। আর এর সাচিবিক দায়িত্ব থাকবেন প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি।
২. প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন বিদ্যমান সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ নামে প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কেবিনেট সেক্রেটারি এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জন্য প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি প্রস্তাব করা হয়েছে।
৩. বিদ্যমান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় রেখে সেখানে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগকে একীভূত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি এবং সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের জন্য মিলিটারি সেক্রেটারি প্রস্তাব করেছে কমিশন। এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী।
৪. জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে একই নামে রেখে প্রধানমন্ত্রী ও একজন প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়ে একজন সচিবের প্রস্তাব করা হয়েছে।
৫. আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে একই নামে রেখে একজন মন্ত্রীকে দায়িত্ব দিয়ে একজন সচিবের প্রস্তাব করা হয়েছে।
৬. স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে জননিরাপত্তা বিভাগ ও সুরক্ষা বিভাগকে একীভূত করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, একজন মন্ত্রী এবং একজন সচিবের প্রস্তাব করা হয়েছে।
৭. পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে একই নামে রেখে একজন মন্ত্রী ও একজন সচিবের প্রস্তাব করেছে কমিশন।
৮. অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন অর্থ বিভাগ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে আগের অবস্থায় রেখে একজন মন্ত্রী ও একজন প্রতিমন্ত্রী এবং একজন প্রিন্সিপাল ফাইন্যান্স সেক্রেটারি ও তিনজন সচিবের প্রস্তাব এসেছে।
৯. শিল্প মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়কে একীভূত করে শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নামে প্রস্তাব করা হয়। আর এর অধীনে শিল্প বিভাগ, পাট ও বস্ত্র বিভাগ এবং বাণিজ্য বিভাগের প্রস্তাব করা হয়েছে। এই মন্ত্রণালয়ের একজন মন্ত্রী ও একজন প্রতিমন্ত্রী এবং একজন প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি ও দুজন সচিবের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
১০. পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিকল্পনা বিভাগ, আইএমইডি বিভাগ ও পরিসংখ্যান বিভাগ রেখে এই মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিকল্পনা কমিশন (বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত হবে। তারা শুধু সামষ্টিক অর্থনৈতিক পলিসি সম্পর্কে পরামর্শ দেবেন), আইএমইডি বিভাগ ও পরিসংখ্যান বিভাগের প্রস্তাব করা হয়েছে। এই মন্ত্রণালয়ের একজন টেকনোক্রাট মন্ত্রী এবং একজন সচিবের প্রস্তাব করা হয়েছে।
১১. সড়ক যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়কে একীভূত করে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং এর অধীনে সড়ক যোগাযোগ বিভাগ, সেতু বিভাগ ও রেলওয়ে বিভাগের প্রস্তাব করে একজন মন্ত্রী ও একজন প্রতিমন্ত্রী, একজন প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি ও তিন জন সচিবের প্রস্তাব করা হয়েছে।
১২. নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে নৌপরিবহন ও অসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয় করে নৌপরিবহন বিভাগ ও অসামরিক বিমান চলাচল বিভাগ প্রস্তাব করা হয়েছে। সেখানে একজন মন্ত্রী ও একজন প্রতিমন্ত্রী এবং একজন প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি ও দুজন সচিবের প্রস্তাব করেছে কমিশন।
১৩. বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিদ্যুৎ বিভাগ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ রেখে একজন মন্ত্রী ও একজন প্রতিমন্ত্রীকে দায়িত্ব দিয়ে একজন প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি ও দুজন সচিবের প্রস্তাব করা হয়েছে।
১৪. স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্থানীয় সরকার বিভাগ এবং পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ রেখে একজন মন্ত্রী, একজন প্রতিমন্ত্রী এবং একজন প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি ও দুজন সচিবের প্রস্তাব দেওয়া হয়।
১৫. স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বাস্থ্য বিভাগ এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ রেখে একজন মন্ত্রী ও একজন প্রতিমন্ত্রী এবং একজন প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি ও দুজন সচিবের প্রস্তাব করেছে কমিশন।
১৬. শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে একীভূত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নামে প্রস্তাব করে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষা বিভাগ এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ করে একজন মন্ত্রী, একজন প্রতিমন্ত্রী এবং একজন প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি ও তিনজন সচিবের প্রস্তাব করেছে সংস্কার কমিশন।
১৭. তথ্য মন্ত্রণালয় এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় নামে প্রস্তাব করে তথ্য বিভাগ এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ করে একজন মন্ত্রী, একজন প্রতিমন্ত্রী এবং একজন প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি ও দুজন সচিবের প্রস্তাব করেছে।
১৮. তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে একীভূত করে বিজ্ঞান ও তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় নাম দিয়ে তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ ও বিজ্ঞান গবেষণা বিভাগের প্রস্তাব করেছে কমিশন। এই মন্ত্রণালয়ের একজন টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীকে দায়িত্ব দিয়ে একজন প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি ও দুজন সচিবের প্রস্তাব করা হয়েছে।
১৯. কৃষি মন্ত্রণালয় এবং মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়কে কৃষি মন্ত্রণালয় করে কৃষি বিভাগ ও মৎস্য ও পশুসম্পদ বিভাগের প্রস্তাব করে একজন মন্ত্রী, একজন প্রতিমন্ত্রী এবং একজন প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি ও দুজন সচিবের প্রস্তাব করা হয়েছে।
২০. পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে ভূমি, পানি, বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর অধীনে ভূমি বিভাগ, পানিসম্পদ বিভাগ এবং বন ও পরিবেশ বিভাগের প্রস্তাব করে একজন মন্ত্রী এবং একজন প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি ও দুজন সচিবের প্রস্তাব করেছে কমিশন।
২১. খাদ্য মন্ত্রণালয় এবং ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়কে খাদ্য, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় করে এর অধীনে খাদ্য বিভাগ, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ করে একজন মন্ত্রী এবং একজন প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি ও দুজন সচিবের প্রস্তাব করেছে কমিশন।
২২. পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে একই নামে রেখে আগের মতো একজন মন্ত্রী ও একজন সচিবের প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
২৩. সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে একীভূত করে মুক্তিযুদ্ধ, সমাজকল্যাণ, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব করা হযেছে। এই মন্ত্রণালয়ের অধীন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিভাগ, সমাজকল্যাণ বিভাগ এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক বিভাগের প্রস্তাব করে একজন মন্ত্রী, একজন প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি এবং তিন বিভাগের জন্য তিনজন সচিবের প্রস্তাব করা হয়েছে।
২৪. শ্রম ও জনশক্তি এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় নামে প্রস্তাব করে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান বিভাগ এবং শ্রম ও জনশক্তি বিভাগের প্রস্তাব করা হয়েছে। এই মন্ত্রণালয়ে একজন মন্ত্রী, একজন সচিবের প্রস্তাব করা হয়েছে।
২৫. গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে একই নামে রেখে একজন মন্ত্রী ও একজন সচিবের প্রস্তাব রয়েছে।
২৬. যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে একীভূত করে যুব, ক্রীড়া ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং একজন মন্ত্রী ও একজন সচিবের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
২৭. ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে একই নামে রেখে বর্তমানের মতো একজন মন্ত্রী ও একজন সচিবের প্রস্তাব রেখেছে কমিশন।
এর আগে গত ৫ ফেব্রুয়ারি জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন। সেখানে সারসংক্ষেপে বলা হয়, বর্তমানে মোট ৪৩টি মন্ত্রণালয় এবং ৬১টি বিভাগ রয়েছে। মন্ত্রণালয়গুলোকে যুক্তিসংগতভাবে কমিয়ে কমিশন সরকারের সব মন্ত্রণালয়গুলোকে ২৫টি মন্ত্রণালয় ও ৪০টি বিভাগে পুনর্বিন্যাস করার সুপারিশ করছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন।
এ ছাড়া মন্ত্রণালয়গুলোকে সমপ্রকৃতির পাঁচটি গুচ্ছে বিভক্ত করার সুপারিশ করছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। একই সঙ্গে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো কমানোরও সুপারিশ করা হয়।
মন্তব্য করুন