জেলা কমিশনারকে (ডিসিকে) জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সিআর মামলা প্রকৃতির অভিযোগগুলো গ্রহণের ক্ষমতা দেওয়ায় সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। এই সুপারিশের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে সারা দেশের বিচারকদের নেতৃত্বাধীন সংগঠন বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন।
অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আমিরুল ইসলাম ও মহাসচিব মুহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম স্বাক্ষরিত গতকাল বৃহস্পতিবার দেওয়া ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, অপরাধ আমলে গ্রহণ একটি বিচারিক কাজ যা কোনোভাবেই নির্বাহী বিভাগের কাছে থাকা সমীচীন নয়। ঐতিহাসিক মাসদার হোসেন মামলায় দেশের সর্বোচ্চ আদালত এই বিষয়গুলো নিষ্পত্তি করে নিয়েছেন। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের এরূপ প্রস্তাবনা চূড়ান্তভাবে মীমাংসিত একটি বিষয়কে নতুনভাবে বিতর্কিত করেছে। বৈপ্লবিক পটপরিবর্তনের পর বিচার বিভাগের কার্যকর স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার নিমিত্ত যখন বিভিন্ন পদক্ষেপ চলমান তখন 'জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন-এর এরূপ প্রস্তাব নিশ্চিতভাবে জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনে বাধা সৃষ্টি করবে বলে অ্যাসোসিয়েশন মনে করে।
প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়েছে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চেতনা ধারণ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের সার্বিক সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এ লক্ষ্যে সরকার গত ও অক্টোবর ২০২৪ খ্রি. তারিখ সংবিধান, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন ও পুলিশসহ বিভিন্ন বিভাগ সংস্কারের লক্ষ্যে কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠনের মাধ্যমে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকারের এই পদক্ষেপকে শুরু থেকেই জেলা আদালতের বিচারকগণ স্বাগত জানিয়েছেন। বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন' মনে করে, সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার পথে যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে তা দূর করার এখনই উপযুক্ত সময়।
ইতোমধ্যে বেশিরভাগ সংস্কার কমিশন তাদের সংস্কার প্রস্তাবসমূহ মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিকট জমা দিয়েছেন। জনবান্ধব বিচার বিভাগ গড়ে তুলতে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন যে সংস্কার প্রস্তাব অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিকট জমা দিয়েছে বা ইতোমধ্যেই জনমনে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে। অন্যদিকে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে এমন কিছু প্রস্তাব দেয়া হয়েছে যা স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অন্তরায় বলে অ্যাসোসিয়েশন মনে করে।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জেলা কমিশনারকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সিআর মামলা প্রকৃতির অভিযোগগুলো গ্রহণের ক্ষমতা দেওয়ায় সুপারিশ করা হলো। তিনি অভিযোগগুলোকে তদন্তের জন্য উপজেলার কোনো কর্মকর্তাকে বা সমাজের স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মাধ্যমে সালিশি বা তদন্ত করার নির্দেশ দিতে পারবেন। প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হলে থানাকে মামলা গ্রহণের নিদেশ দিতে পারবেন। পরবর্তীতে মামলাটি যথাযথ প্রক্রিয়ায় আদালতে চলে যাবে। এর ফলে সাধারণ নাগরিকরা সহজে মামলা করার সুযোগ পারেন। অপরদিকে, সমাজের ছোটোখাটো বিরোধ আদালতের বাইরে নিষ্পত্তি হয়ে গেলে আদালতের ওপর অযৌক্তিক মামলার মাপ কমে যাবে।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের উপরিউক্ত প্রস্তাব সাংবিধানিকভাবে অগ্রহণযোগ্য, বিমর বিভাগের স্বাধীনতায় স্পষ্টত হস্তক্ষেপ, আধুনিক জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র চেতনার পরিপন্থি, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নীতি বিরুদ্ধ এবং বিখ্যাত মাসদার হোসেন মামলার রায়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কারণ সংবিধান রাষ্ট্রের সার্বভৌম বিচারিক ক্ষমতা বিচার বিভাগের ওপর অর্পণ করেছে। রাষ্ট্র ব্যবস্থার আধুনিকায়নের অন্যতম অনুষঙ্গ ক্ষমতার পৃথককরণ এবং স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশে স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার যাত্রাটি ছিলে অনেক কণ্টকাকীর্ণ, সকল বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে ১ নভেম্বর ২০০৭ খ্রি. তারিখে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথককরণ হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সভা যে, বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা এখনও অর্জিত হয়নি। তাই বিয়ার বিভাগের কার্যকর স্বাধীনতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। বিচার বিভাগের পৃথককরণ ও স্বাধীনতা পরিপন্থি যেকোনো কর্মকাণ্ড কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়, বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন’ জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সাংঘর্ষিক ও বিতর্কিত প্রস্তাবের তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
মন্তব্য করুন