রবিবার, ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৮ মাঘ ১৪৩১
কালবেলা ডেস্ক
প্রকাশ : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:৪৭ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

ভিক্ষায় নেমেছেন শহীদ আকাশ বেপারির স্ত্রী লাকি

আকাশ বেপারি। ছবি : বাসস
আকাশ বেপারি। ছবি : বাসস

রিকশাযোদ্ধা শহীদ আকাশ বেপারি জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় হতাহতদের নিয়ে মরণভয় তুচ্ছ করে ছুটে যেতেন হাসপাতালে। গুলিতে মরে যাওয়ার ভয়কে জয় করে এমন অসংখ্য আকাশ বেপারি তখন আহত ও নিহত মানুষকে হাসপাতালে নিয়ে গেছেন। বিনিময়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নেননি কোনো টাকাপয়সা। এমনকি তারা পুলিশ বা সরকারি দলের সন্ত্রাসীদের রক্তচক্ষুকেও পরোয়া করেননি।

আকাশ বেপারির রিকশা চালানো ও স্ত্রী লাকি আক্তার বাড়ি বাড়ি কাজ করে আয়ের টাকা দিয়ে সংসার চলত কোনো রকমে। কিন্তু দিন এনে দিন খাওয়া এ মানুষটির অনুপস্থিতিতে পরিবার নিয়ে ভয়াবহ সংকটে পড়েছেন লাকি। একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটিকে হারিয়ে তাদের নিরেট উপবাসে দিন কাটছিল। উপায়ান্তর না পেয়ে শেষ পর্যন্ত ভিক্ষায় নেমেছেন লাকি।

আকাশ বেপারির (৩৬) স্থায়ী ঠিকানা মাদারীপুরের হাবিঙ্গ ইউনিয়নের উত্তর দুধখালী গ্রামে। যদিও এখন সেখানে কিছুই নেই। মো. আজিজ বেপারি ও সামরতো বানের সন্তান তিনি। তার অন্য কোনো ভাই কিংবা বোন আছে কি না, তাও জানে না পরিবারটি।

ভিটেমাটিহীন এ মানুষটিকে বিয়ে করেন কুমিল্লার মেয়ে লাকি আক্তার (৩৩)। তাদের কোলজুড়ে আসে দুটি সন্তান। থাকতেন রাজধানীর তুরাগের বাদালদি এলাকায়। বড় মেয়ে শারমিন আক্তার (১৫) স্থানীয় স্কুলে নবম শ্রেণিতে এবং ছোট মেয়ে শাহনাজ আক্তার (১২) অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। এর মাঝে হঠাৎ তিনি কুড়িয়ে পান বাপ্পি (২২) নামের অপ্রকৃতিস্থ এক ছেলেকে। যাকে তিনি নিজ সন্তানের মতো আগলে রাখতেন। তার টয়লেট-গোসল থেকে খাওয়াদাওয়া সব তিনি নিজ হাতে করে দিতেন।

শোকে মুহ্যমান আকাশের স্ত্রীর মুখে কোনো কথাই বেরোচ্ছিল না। তবু তিনি বাপ্পি প্রসঙ্গে বলেন, ‘ছেলেটিকে আমার স্বামী খুবই আদর করত এবং নিজের সন্তানের চেয়েও বেশি ভালোবাসত। সারা দিন রিকশা চালিয়ে রাতে বাসায় এসে ওকে নিজ হাতে গোসল করিয়ে খাইয়ে দিতেন। আমাদের বলতেন, তোমরা ওর কাজ করতে পারবা না। আমি খেয়ে থাকি, না খেয়ে থাকি, ওকে দেখে রাখব। যত দিন বেঁচে থাকি ভিক্ষা করে হলেও ওর পাশে আমি থাকব।’

গত ৫ আগস্ট আকাশ বেপারি তার রিকশা নিয়ে বের হন। এর আগে প্রতিদিনই তিনি আন্দোলনে সহায়কের ভূমিকায় ছিলেন। তবে এদিন ভয়ে তার বড় মেয়ে কোনোভাবেই বাসা থেকে তাকে বের হতে দিচ্ছিল না।

এ প্রসঙ্গে বড় মেয়ে শারমিন বলে, আমি বাসায় ভেতর থেকে তালা মেরে চাবি লুকিয়ে রাখতাম। যেন তিনি বের হতে না পারেন। বাবাকে বলতাম, বাবা, তুমি ছাড়া তো আমাদের আর কেউ নেই। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমাদের কী হবে? কিন্তু ওই দিন কাউকে কিছু না বলে তিনি বের হয়ে যান। আমরাও ভাবতেছিলাম, আজ যেহেতু বিজয় হয়েছে, তাহলে আর কোনো সমস্যা হবে না।

শারমিন বলতে থাকে, ৫ তারিখ সন্ধ্যা পার হয়ে যায়। বাবা বাসায় আসে না। পরের দিন আমরা সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজ করি, কিন্তু কোথাও তার সন্ধান পাই না। এরপর টানা পাঁচ দিন খুঁজতে খুঁজতে যখন কোনোভাবে কূল-কিনারা করতে পারতেছিলাম না, তখন একটি লিফলেট ছাপাই। যে লিফলেটটি ১১ তারিখ জসীমউদ্দীন মোড় থেকে হাউজ বিল্ডিং পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে আমরা দিই। তারপর ওই লিফলেটটি পেয়ে সালেহ রায়হান ভাই সরাসরি ফোন করেন। আমরা ভাবতেই পারি নাই, বাবা আর নেই।

আকাশের মেয়ে বলে, তিনি (সালেহ রায়হান) যখন বলেন যে এই ছবির সঙ্গে তাদের একজন শহীদের মিল আছে, আমরা প্রথমে বিশ্বাসই করিনি। পরে তিনি বাবার ছবি আমার হোয়াটসঅ্যাপে দেন। ছবি দেখেই তো মা চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যান। তখন তিনি বলেন, আত্মীয়স্বজন না আসাতে আজকে সকালেই এই লাশটি আমরা ঢাকা মেডিকেলে পাঠিয়ে দিয়েছি। গত ছয় দিন ধরে কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতালে পড়ে ছিল।

শারমিন বলে, ‘আমরা তাড়াতাড়ি হাসপাতালে যাই। কিন্তু হাসপাতালের লোকজন মাকে ছাড়া বাবার লাশ আমাদের দেবে না। তখন মাকে আনতে আমরা আবার উত্তরা যাই। তারপর মাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার পরে বাবার লাশ বুঝে পাই।

তারা জানান, দেশের বাড়ির ঠিকানাও হারিয়ে গেছে আকাশ বেপারির। তাই কবর হয়েছে বাউনিয়া, তুরাগেই। মানুষের বাড়িতে কাজ করে তার স্ত্রীর মোট আয় ৮ হাজার টাকা। ঘরভাড়া ৭ হাজার। বাকি ১ হাজার দিয়ে তারা কীভাবে চলবেন? তাই বাকি খরচ জোগাতে ভিক্ষায় নামতে হয়েছে লাকিকে।

শারমিন জানায়, এখন পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামী দুই লাখ টাকা দিয়েছে। তবে আকাশ বেপারির ঋণ ছিল ১ লাখ ৫২ হাজার। এখন কোথাও চলে যাবে, সেই উপায়ও নেই। কারণ গ্রামের বাড়িতে কোনো ঘরবাড়ি না করেই কবরে শুয়ে আছেন আকাশ। তবে সব সময় বিশ্বাসী ছিলেন যে ভালো কাজের প্রতিদান আল্লাহ পরকালে দেবেন।

কাঁদতে কাঁদতে আকাশের বড় মেয়ে বলে, জুলাই রেভলুশনারি অ্যালায়েন্সের সালেহ রায়হান ভাই যদি আমাদের পাশে না থাকতেন, তাহলে যে কী হতো! অর্থাভাবে আমাদের দুই বোনের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ভাই আমাদের স্কুলের টাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এ ছাড়া যেকোনো সমস্যায় একটা ফোন দিলেই ভাই ছুটে আসেন বা সমস্যার সমাধান করে দেন। অথচ তিনি নিজেও একজন ছাত্র। বিভিন্নজনের কাছে বলে কয়ে আমাদের পরিবারটাকে ধরে রাখার চেষ্টা করতেছেন।

উল্লেখ্য, জুলাই আন্দোলন নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘জুলাই রেভলুশনারি অ্যালায়েন্স’। জুলাই আন্দোলনের সামনের সারির যোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত এ সংগঠন। এর আহ্বায়ক ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সালেহ মাহমুদ রায়হান।

তিনি জানান, উত্তরা তিন নম্বর সেক্টর মসজিদে প্রতি শুক্রবার আকাশের স্ত্রী ভিক্ষা করেন। আর বাকি ছয় দিন মানুষের বাসা-বাড়িতে কাজ করে তিন সন্তানের মুখে অন্ন জোগান দেন। সকাল ৭টায় বাসা থেকে বের হয়ে রাত সাড়ে ৮টায় তিনি বাসায় ফেরেন।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

জাকসু নির্বাচন / ছাত্রদল ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি অবস্থান 

ইজতেমায় বিদেশি মেহমানখানায় চায়ের মধ্যে সন্দেহজনক পাউডার, অতঃপর...

ভারত থেকে এলো আরও ১৬ হাজার ৪০০ টন চাল

চক্ষু হাসপাতালের সামনে আন্দোলনে আহতদের সড়ক অবরোধ 

বিয়ে নিয়ে সারজিসের স্ট্যাটাস

দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে ফেরি চলাচল বন্ধ

চট্টগ্রামে ফের নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল

আরও শক্তিশালী হচ্ছে মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা

‘ভারতের চ্যাপ্টার শেষ, আর কোনো দাসত্ব করা যাবে না’

এনপিপির কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত, সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি গঠন

১০

রংপুরকে এলিমিনেটরে ঠেলে দিয়ে কোয়ালিফায়ারে চিটাগাং

১১

চাতাল থেকে ধান-গম সংগ্রহ করবে ‘ব্রি গ্রেইন কালেক্টর’

১২

ভোলায় জলদস্যুদের গুলিতে জেলে নিহত

১৩

শিশুদের পরিপূর্ণ বিকাশ নিশ্চিত করতে সার্ফ এক্সেলের নতুন উদ্যোগ

১৪

দলের সভামঞ্চ ভেঙে ফেলার অভিযোগ বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে

১৫

‘স্বৈরাচারের অবশিষ্ট অংশ দেশ দখলের চেষ্টা করছে’

১৬

মেধাবী তিন শিক্ষার্থীর মাঝে তারেক রহমানের শিক্ষা উপকরণ উপহার

১৭

ভিক্ষায় নেমেছেন শহীদ আকাশ বেপারির স্ত্রী লাকি

১৮

মাছ চুরির মামলায় আ.লীগ নেতা গ্রেপ্তার

১৯

পাংশায় শ্রমিক দলের কমিটি নিয়ে মিথ্যাচারের প্রতিবাদ

২০
X