পারিবারিক পিছুটানকে উপেক্ষা করেই দোকান কর্মচারী মবিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে তিনি দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তি হারান। কবে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরবেন এখন সে অপেক্ষায় কাটছে তার দিন।
ডাক্তাররা জানিয়েছেন, সঠিক চিকিৎসায় দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তি দুটোই ফিরে পাবেন মো. মবিন (১৭)। দেশের প্রয়োজনে সাড়া দিয়ে অসহায় হয়ে পড়া মবিন এখন দেশবাসীর কাছে দোয়া ও সহযোগিতা চেয়েছেন।
সম্প্রতি শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলার শিধলকুড়া ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের বড় শিধলকুড়া গ্রামে গিয়ে মবিনের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
পারিবারিক ও স্থানীয় সূত্রে আরও জানা যায়, প্রতিবন্ধী ছেলে জুলহাসসহ তিন ছেলেকে রেখে প্রায় পাঁচ মাস আগে মারা যান মবিনের বাবা মোফাজ্জল হোসেন (৬০)। এরপর সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতে মবিনের মা নাজমা বেগম (৫০) দিশেহারা হয়ে পড়লে স্থানীয় ও স্বজনদের পরামর্শে বড় ছেলে নাজমুল হুদা পলাশকে ড্রাইভারের চাকরি ও মবিনকে ঢাকার উত্তরার একটি কম্পিউটারের দোকানে কাজে দেন। খেয়ে না খেয়ে মোটামুটি চলছিল তাদের সংসার। কিন্তু এ চলা থমকে গেছে গত ১৮ জুলাই।
প্রতিদিনের মতো সেদিনও মবিন রাজধানী ঢাকার উত্তরার রাজলক্ষ্মীর পাশের ৩ নম্বর সেক্টরের ২ নম্বর সড়কের ২৭ নম্বর প্লটে লতিফ এম্পোরিয়ামের মো. ওয়াসিম তালুকদারের কম্পিউটারের দোকানে কাজের জন্য যান।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তখন তুঙ্গে। পারিবারিক পিছুটানসহ সকল কিছু ভুলে মবিন দোকান বন্ধ করে মিছিলে যোগ দেন। এরপর মিছিলটি যখন উত্তরা থানার দিকে যায়, তখন থানার ভেতর থেকে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে পুলিশ। একপর্যায়ে একটি বুলেট মবিনের বাঁ কানের ওপর দিয়ে ঢুকে ডান কানের ওপর দিয়ে বেরিয়ে যায়। পাশাপাশি পুলিশের ছোড়া ছররা গুলিতে তার চোখসহ মাথা ক্ষতবিক্ষত হয়। এরপর মবিনের মিছিলের সাথিরা তাকে প্রথমে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল এবং পরে সেখান থেকে চক্ষু বিজ্ঞান হাসপাতালে নিয়ে যায়। এরপর তারা তাকে নিয়ে যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
মবিনের বড় ভাই নাজমুল হুদা পলাশ বলেন, ঘটনার দিন আমি বাসাতেই ছিলাম। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আমার মোবাইলে অপরিচিত একটি নম্বর থেকে কল আসে। জানতে চায়, আমি মবিনের বড় ভাই কি না? আমি হ্যাঁ বললে অপর প্রান্ত থেকে জানায়, আপনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চলে আসেন। আমি বিলম্ব না করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চলে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি, ছোট ভাই মবিন গুলিতে আহত হয়ে পড়ে আছে। পলাশ জানান, এইচএসসি পাশ করে তিনি একটি প্রাইভেট ফার্মে গাড়ি চালাতেন। মুবিনকে চিকিৎসা করাতে গিয়ে ইতোমধ্যে ড্রাইভারের চাকুরিটাও চলে গেছে তার।
এদিকে সংসারে বিধবা মা ও মানসিক প্রতিবন্ধী ছোট ভাই। মবিনের শারীরিক অবস্থাও ভালো না। আর্থিক অবস্থা খুবই করুণ হয়ে পড়েছে। বাবা না থাকায় সংসারের দায়িত্ব পলাশের ওপর। কিন্তু চাকরিটি হারিয়ে পলাশও চোখে অন্ধকার দেখছিলেন।
এদিকে মবিনের পরিবারের সদস্যরা তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে চিকিৎসা করালেও মাথার রক্তক্ষরণ বন্ধ হচ্ছিল না। মবিন টাকার অভাবে হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা করাতে পারছেন না জেনে বর্তমান সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সিএমএইচে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এছাড়া সেনাপ্রধানের সহায়তায় পলাশ ইতোমধ্যে বিজিবিতে যোগ দিয়েছে।
এ জন্যে মুবিনের মা মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা মহোদয় ও মাননীয় সেনাপ্রধানের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং তাদের জন্য দোয়া করেছেন।
দু’চোখের দৃষ্টিশক্তিসহ এক কানের শ্রবণশক্তি হারানো মবিন সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেতে সকলের কাছে দোয়া চেয়েছেন।
মন্তব্য করুন