ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবার ও ১০ শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঘুষ, দুর্নীতি, প্রতারণা, জালিয়াতি, মুদ্রা পাচার, কর ও শুল্ক ফাঁকি এবং অর্থ পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানে ১১টি তদন্ত দল গঠন করেছে সরকার। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এর সমন্বয়ে গঠিত দলগুলোর সঙ্গে দেখা করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। সেখানে সমন্বিতভাবে তদন্ত প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
বৃহস্পতিবার (১৬ জানুয়ারি) বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত ‘মানিলন্ডারিং অপরাধ অনুসন্ধানে গঠিত যৌথ অনুসন্ধান ও তদন্ত দলের কার্যক্রম বিষয়ে আলোচনা’ বিষয়ক একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। আরও উপস্থিত ছিলেন- বি এফ আই ইউ এর নতুন প্রধান শাহিনুল ইসলাম, উপপ্রধান এ কে এম এহসান, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আরশাদুর রউফ, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর জাকির হোসেন চৌধুরী এবং ড. কবির হোসেন।
সূত্র জানায়, মানিলন্ডারিং অপরাধ অনুসন্ধানের জন্য ১১টি যৌথ অনুসন্ধান ও তদন্ত দল গঠন করা হয়েছে। যেসব দল আলাদা আলাদা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তদন্ত করবে। আগামী সপ্তাহ থেকে তদন্ত কমিটি গুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে অফিস শুরু করবে। ওদের জন্য আলাদা স্থান বরাদ্দ করা হয়েছে।
শেখ হাসিনার পরিবারের ও তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান ও ট্রাস্ট এর বাইরে যে ১০ শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে, সেগুলো হলো সাইফুজ্জামান চৌধুরী (আরামিট গ্রুপ), এস আলম গ্রুপ, বেক্সিমকো, নাসা, সিকদার, বসুন্ধরা, সামিট, ওরিয়ন, জেমকন ও নাবিল গ্রুপ। এসব গ্রুপের মালিক, স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানও তদন্তের আওতায় থাকবে বলে জানা গেছে।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, ১১ তদন্ত কমিটির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎ করেছেন গভর্নর। সেখানে নিজ নিজ তদন্তের অগ্রগতি অবহিত করেছে দলগুলো। পরে তথ্য আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে জটিলতা দূর এবং তদন্ত প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার জন্য সমন্বিতভাবে কাজ করতে পরামর্শ দিয়েছেন আহসান এইচ মনসুর।
সূত্র আরও জানায়, সম্প্রতি মন্ত্রিত্ব হারানো ব্রিটিশ নাগরিক টিউলিপ সিদ্দিকের বিষয়েও গুরুত্ব দিচ্ছে তদন্ত দল। শেখ হাসিনা পরিবারের দুর্নীতির সঙ্গেই তার দুর্নীতি, অর্থ পাচার, ঘুষ বাণিজ্য এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করবে দলটি।
জানা গেছে, তদন্ত দলগুলোকে বেশ কিছু শর্ত দেওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী তাদের সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ আইন ও বিধিমালা মেনে অনুসন্ধান ও তদন্ত করতে হবে। অনুসন্ধান ও কার্যক্রমের তথ্যাদির গোপনীয়তা ও সংবেদনশীলতা কঠোরভাবে রক্ষা করতে হবে। দলের প্রধানকে নিজ সংস্থার অনুমোদন নিয়ে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করতে হবে। যৌথ অনুসন্ধান দলের তদন্ত কার্যক্রম সমন্বয় করে তার অগ্রগতি ও পরবর্তী কার্যক্রম অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে জানাতে হবে।
গত ২ ডিসেম্বর আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ আলাদা চিঠির মাধ্যমে বিএফআইইউকে আইন ও অর্থ পাচার প্রতিরোধ বিধিমালার আওতায় কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে যৌথ তদন্তের বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তের কথা জানায়। এরপর ৬ জানুয়ারি যৌথ তদন্তের নেতৃত্ব ও শর্ত চূড়ান্ত করা হয়।
এ নিয়ে দুদক, সিআইডি ও কাস্টমস গোয়েন্দাকে দেওয়া বিএফআইইউর চিঠিতে বলা হয়, এসব গ্রুপ ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি, প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে অর্থ আত্মসাৎ, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ঘুষ, দুর্নীতিসহ অবৈধ পন্থায় অর্থ উপার্জনের তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া এসব ব্যবসায়ী গ্রুপের বিরুদ্ধে কর ও শুল্ক ফাঁকি, বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন অবৈধ পন্থায় বিদেশে অর্থ পাচারের তথ্য রয়েছে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রমের হালনাগাদ প্রতিবেদন সময়-সময় সংস্থাগুলোকে বিদেশে পাচার করা সম্পদ বাংলাদেশে ফেরত আনা ও ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্স ও বিএফআইইউতে সরবরাহ করতে হবে।
অনুসন্ধান ও তদন্তের আওতায় আসা গ্রুপগুলোর বেশির ভাগের ব্যাংক হিসাব ইতোমধ্যে জব্দ করেছে বিএফআইইউ। এসব ব্যবসায়ী গ্রুপের সম্পদের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণ, ঋণের ব্যবহার, অর্থের গতিপথ, তাদের ব্যবসায়িক ও অন্যান্য লেনদেন, ঋণের সুবিধাভোগীসহ বিভিন্ন বিষয়ে অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, কানাডা ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ (ইউএই) বিভিন্ন দেশে তাদের সম্পদের বিষয়ে জানতে চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
মন্তব্য করুন