বাংলাদেশকে বহু জাতি, বহু ধর্ম ও বহু সংস্কৃতির দেশ উল্লেখ করে মৌলিক জায়গা থেকে বহুত্ববাদী রাষ্ট্র নির্মাণের জন্য জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও হিন্দু ধর্মগুরুরা। স্বামী বিবেকানন্দের মতাদর্শ তুলে ধরে তারা বলেন, তারা কোনো বিভাজন নয়, ঐক্য চান। সাম্প্রদায়িকতাকে সর্বান্তকরণে পরিহার করতে হবে, এটাই বিবেকানন্দের শিক্ষা।
রোববার (১২ জানুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর আর কে মিশন রোডে রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামী অক্ষরানন্দ মিলনায়তনে ‘স্বামী বিবেকানন্দ ও যুবসমাজ’- শীর্ষক আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন তারা। স্বামী বিবেকানন্দের ১৬২তম জন্মোৎসব উদযাপনে ‘বিবেকানন্দ শিক্ষা ও সংস্কৃতি পরিষদ, বাংলাদেশ’-এর উদ্যোগে এই অনুষ্ঠান হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. সত্যপ্রসাদ মজুমদার বলেন, শুধু ভারতবর্ষ নয়, স্বামী বিবেকানন্দ এসেছিলেন পৃথিবীর কল্যাণের জন্য। স্বামীজী বলেছেন, বিদেশে গিয়ে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ কর, দক্ষ হও। এরপর ফিরে এসে দেশের জন্য, মানুষের কল্যাণে কাজ করো। আমরা উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে যাচ্ছি, দক্ষ হচ্ছি- কিন্তু ফিরছি না। সবাই মিলে দেশের জন্য আমাদের কাজ করতে হবে।
বিবেকানন্দ শিক্ষা ও সংস্কৃতি পরিষদ বাংলাদেশের উপদেষ্টা এবং ঢাকাস্থ রামকৃষ্ণ মিশনের পরিচালন পর্ষদের সহ-সভাপতি সুবল চন্দ্র সাহা বলেন, স্বামীজি শিক্ষা-কর্মসংস্থান চেয়েছিলেন। শিক্ষিত হলে তার কর্মসংস্থান হবে। আমার আহ্বান, শিক্ষার বিস্তারে সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে এগিয়ে আসুন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, বাংলাদেশ বহু জাতি, বহু ধর্ম, বহু সংস্কৃতির দেশ। এটাই গণতন্ত্রের সংস্কৃতি। শুধু মুসলমান নয়- হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আদিবাসী, বিশ্বাসী, অবিশ্বাসী সবাই এই রাষ্ট্রে বাস করে। এখানে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়েও পুরোপুরি বহুত্ববাদ ছিল না, বর্তমানে আমরা বহুত্ববাদের নমুনা দেখতে পাচ্ছি না। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত সংবিধান সংস্কার কমিশনে একজন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক কিংবা একজন আদিবাসী নেই। তাহলে তো ইনক্লুসিভ বাংলাদেশ হলো না, শুরুতেই আপনি বিয়োগ করে দিলেন। স্বাভাবিকভাবে এই কমিশন যে প্রস্তাবনা দিবে, সেটা তো সবার প্রস্তাবনা হবে না।
তিনি আরও বলেন, মৌলিক রাষ্ট্র নির্মাণের জায়গা থেকে বহুত্ববাদের জন্য, একটি বহুত্ববাদী রাষ্ট্র নির্মাণের জন্য আমরা যদি প্রত্যেকে কাজ করতে পারি, তাহলে কেবল স্বামীজীর বাণী সার্থক ও যথার্থ হবে। এটাই স্বামীজির মতাদর্শ। তিনি অসাম্প্রদায়িক পৃথিবী চেয়েছেন। এ জন্য আমাদের লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. কালিদাস ভক্ত বলেন, আমাদের সমাজের অবস্থা এমন হয়েছে, একটা ভালো কাজ করতে যাব- নানা বিপত্তি। পাছে লোকে যেন কিছু বলে। সব বিপত্তি পেরিয়ে আমাদের দেশের জন্য, মানুষের জন্য কাজ করতে হবে। আমরা কোনো বিভাজন নয়, একতা চাই।
সভাপতির বক্তব্যে ঢাকাস্থ রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী পূর্ণাত্মনন্দজি মহারাজ বলেন, এক ধরনের দ্বিধা, সংশয় ও শঙ্কার মধ্যে আমাদের চলতে হচ্ছে। শিক্ষকদের জোর করে অবসর নিতে বাধ্য করানো হচ্ছে। এটা ভালো লক্ষণ নয়। স্বামীজির আদর্শ মেনে আমরা বিভাজন নয়, একত্বের কথা বলছি। সাম্প্রদায়িকতাকে সর্বান্তকরণে পরিহার করতে হবে, এটাই বিবেকানন্দের শিক্ষা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হৃদয় বনিক এবং রাজীব দাসের যৌথ সঞ্চালনায় এতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বিবেকানন্দ শিক্ষা ও সংস্কৃতি পরিষদ বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক ড. সুকান্ত রায়। আরও বক্তব্য রাখেন ঢাবির শিক্ষার্থী চয়ন মন্ডল, সাবিহা মাহাবুব বৈশাখী প্রমুখ।
আলোচনা সভা ছাড়াও এ দিন ঢাকাস্থ রামকৃষ্ণ মিশনে নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে স্বামীজির জন্মোৎসব উদযাপিত হয়। সকাল সাড়ে ৯টায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন এবং রামকৃষ্ণ মিশন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কুচকাওয়াজের মধ্য দিয়ে জন্মোৎসবের কার্যক্রম শুরু হয়।
এরপর স্বামী বিবেকানন্দের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ, প্রদীপ প্রজলন, টাঙ্গাইলের উত্তর রোয়াইলের সারদা-নিবেদিতা স্কুলের শিক্ষার্থীদের বৈদিক শান্তিমন্ত্র উচ্চারণসহ একে একে নানা কর্মসূচি পালিত হয়।
মন্তব্য করুন