বাসস
প্রকাশ : ১২ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:৫৬ পিএম
আপডেট : ১২ জানুয়ারি ২০২৫, ০৩:০১ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
গণঅভ্যুত্থানে নিহত

শহীদ মনিরুলের স্ত্রীকে বাড়ি ছাড়ার নোটিশ

শহীদ মনিরুল ইসলাম ও তার স্ত্রী আমেনা বেগম। ছবি : সংগৃহীত
শহীদ মনিরুল ইসলাম ও তার স্ত্রী আমেনা বেগম। ছবি : সংগৃহীত

ছোট একটি রুম। এতে নেই কোনো জানালা। একটি দরজা রয়েছে, তাও ভাঙা। রুমে আলো-বাতাস ঢোকার কোনো জায়গা নেই। তাই দিনের বেলাতেও রুমটিতে থাকে ঘুট ঘুটে অন্ধকার। রুমটি কবে রং করা হয়েছে দেখে তা বোঝার উপায় নেই। দেয়ালের আস্তর খসে পড়ছে। রুমের মধ্যেই রান্না করে খেতে হয়। রুমের সামনে জমে আছে ময়লা পানি। সেই পানিতে পা ভিজিয়ে প্রবেশ করতে হয় রুমে।

বলছিলাম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহীদ ঝালমুড়ি বিক্রেতা মনিরুল ইসলাম অপুর (৫৬) পরিবারের কথা। তিনি ৫ আগস্ট রাতে রাজধানীর কোতোয়ালি থানার গোলকপাল লেন এলাকায় পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। এই বাসাতেই ৬ হাজার টাকায় ভাড়া থাকছেন অপুর পরিবার। তিনি শহীদ হওয়ার পর এখনো তার পরিবারের সদস্যরা সেখানেই থাকছেন। বাসাটি ৩৫নং ওয়ার্ডের (বংশাল থানার পেছনে) ৭নং গলির গোলকপাল লেনে।

সরেজমিনে বাসায় গিয়ে দেখা যায়, বংশাল-নবাবপুর মেইন রোড থেকে সেই বাসায় যাওয়ার জন্য চিকন একটি রাস্তা। সেখান দিয়ে রিকশা যাওয়ার কোনো উপায় নেই। বাসায় একটি মাত্র রুম। রুমে নেই কোনো খাট, আলমিরা, এমন কী নেই কোনো আসবাবপত্র। আছে শুধু একটি মাদুর বিছানো। রুমের মধ্যে স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ। সেখানেই রাতে থাকেন শহীদ মনিরুল ইসলামের স্ত্রী আমেনা বেগম (৫২) ও বড় সন্তান রবিউল ইসলাম শাওন (২৪)। তাদের রাতে থাকার জন্য নেই কোনো লেপ বা তোশক। এই তীব্র শীতের মধ্যে এভাবেই তাদের রাত কাটছে।

শহীদ মনিরুল ইসলাম অপুর বড় ছেলে শাওন বলেন, আসবাবপত্র, খাট ও আলমিরা কয়েকটা ছিল। কিন্তু আব্বা শহীদ হওয়ার পর তা বিক্রি করে ঘর ভাড়া দিয়েছি। এখনো ঘর ভাড়া বাকি। কোনো দিন এক বেলা, কোনো দিন দুই বেলা খেয়ে দিন চলছে আমাদের। শুনেছি অনেক পরিবার অনেক সহযোগিতা পাচ্ছে। কিন্তু আমাদের অবস্থা সব থেকে খারাপ। অথচ আমরা এখনো কিছু পাইলাম না।

সম্প্রতি রাজধানীর কোতোয়ালি থানার ৩৫নং ওয়ার্ডের ৭নং গোলকপাল লেনের ভাড়া বাসায় রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস’র প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপ হয় শহীদ মনিরুল ইসলাম অপুর স্ত্রী আমেনা বেগম ও ছেলে শাওনের।

মনিরুল ইসলাম অপুর বাড়ি চাঁদপুর জেলার সদর উপজেলার নতুন বাজার থানায় হলেও তিনি বড় হয়েছেন ঢাকাতেই। বাবা ফজল বেপারি ও মা শহর বানু মারা গেছেন অনেক বছর আগে। মনিরুল ইসলামরা ছিলেন পাঁচ ভাই। তার মধ্যে চার ভাই মারা গেছেন। যে একজন বেঁচে আছেন তিনি থাকেন চাঁদপুরে।

মনিরুল ইসলামের দ্বিতীয় স্ত্রী আমেনা বেগমের ঘরে দুটি সন্তান ছিল। ছোট ছেলে মুন্না ইসলাম ২০২০ সালে ওয়ারিতে কিশোর গ্যাং এর হাতে নিহত হয়। মনিরুলের প্রথম সংসারে স্বপ্না (২৮) নামে একটি মেয়ে ও রিয়াদ ইসলাম (১৭) নামে ছেলে সন্তান রয়েছে।

মনিরুল ইসলাম ৫ আগস্ট শহীদ হলেও তাকে ৬ আগস্ট দুপুর ২টার দিকে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়। পরে অবশ্য ১৭ ডিসেম্বর ময়না তদন্তের জন্য লাশ উত্তোলন করা হয়। ময়না তদন্ত শেষে ওই দিন রাতেই আবার লাশ দাফন করা হয়।

ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এরপর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান ভারতে। এ খবর শোনার পর থেকে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে লাখ লাখ ছাত্র-জনতা ও সাধারণ মানুষ উল্লাস শুরু করে। তবে সারাদেশে যখনই চলছিল বিজয় উৎসব, তখনও বংশাল চৌরাস্তায় চলমান ছিল পুলিশ ও সাধারণ জনতার মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া এবং গোলাগুলি। এর একপর্যায়ে গোলকপাল লেনের মুখে পুলিশের গুলিতে নিহত হন ঝালমুড়ি বিক্রেতা মনিরুল ইসলাম অপু।

পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে অকূলপাথারে পড়েছেন শহীদ মনিরুল ইসলামের স্ত্রী ও সন্তান। শাওন আগে একটি গ্যারেজে কাজ করলেও বাবা মারা যাওয়ার পর বিভিন্ন জায়গায় দৌড়াদৌড়ি করতে হয়, তাই কাজ ছেড়ে দিয়েছেন।

সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে শাওন বলেন, ৫ আগস্ট সারাদিন ঝালমুড়ি বিক্রি শেষে সন্ধ্যার আগে আব্বা বাসায় আসেন। এসে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে এশার নামাজ পড়তে বের হন। তখনও বংশাল চৌরাস্তায় পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-জনতার ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া এবং গোলাগুলি চলছিল। আব্বা মাত্র লোহার গেটের সামনে দাঁড়ান, তখনই একটা গুলি এসে আব্বার পেটে লাগে। তিনি সেখানে পড়ে যান। একটু পরে মহল্লার লোকজন আমাদের খবর দেয়, আমি গিয়ে দেখি আব্বার পেট থেকে অনেক রক্ত বের হচ্ছে। আমি তখন আমার জামা খুলে পেটে বাঁধি এবং মেডিকেলে নেওয়ার চেষ্টা করি।

তিনি বলেন, বংশাল চৌরাস্তায় তখনও অনেক গোলাগুলি চলছিল। এর মধ্যে আমি আব্বাকে মেডিকেলে কীভাবে নেব? পরে মহল্লার একজনের কাছ থেকে একটি ভ্যান গাড়ি চেয়ে নিয়ে আব্বাকে ভেতরের রাস্তা দিয়ে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাই। নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে এসে দেখি আমার ভ্যানটি নেই, চুরি হয়ে গেছে।

নিজের পাসপোর্ট দেখিয়ে রবিউল ইসলাম শাওন বলেন, আমাকে আব্বার বিদেশে পাঠানোর ইচ্ছা ছিল। এই জন্য আমার পাসপোর্ট করা ও মেডিকেলও করা হয়েছিল। কিন্তু তা আর আমার হবে না। আমাকে কে টাকা দেবে? সংসারের হাঁড়িই চলে না। বাড়ি ভাড়া বাকি পাঁচ মাসের। বাড়ির মালিক বাসা থেকে বের হয়ে যেতে বলেছেন। এখন কী করব তাই ভাবছি।

সে দিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে শহীদ মনিরুলের স্ত্রী আমেনা বেগম বলেন, শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর আমার স্বামী ভেবেছিলেন সব স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আর গোলাগুলি হবে না কোথাও। কিন্তু সেইদিন গভীর রাত পর্যন্ত বংশাল চৌরাস্তায় গোলাগুলো হলো। খবর শুনে ছুটে যাই লোহার গেটে। গিয়ে দেখি আমার স্বামী পড়ে আছে। অনেক রক্ত বের হচ্ছে। আমি আমার স্বামীকে পানি খাওয়াই। পরে আমার ছেলে ওর বাবার লাশ ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যায়।

তিনি বলেন, ঝালমুড়ি বিক্রি শেষ করে সন্ধ্যার দিকে আমার স্বামী বাসায় আসে। বাসায় যা ছিল তা দিয়ে খেতে দেই। খাওয়া শেষে বলেন, এশার নামাজ পড়তে গেলাম। আর বাইরের অবস্থাটাও একটু দেখে আসি। এই বলে সে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। এর একটু পরে খবর আসে তার শরীরে গুলি লাগছে।

ক্ষোভ প্রকাশ করে আমেনা বেগম বলেন, আমি রাজনীতি করিও না, বুঝিও না। আমরা সাধারণ মানুষ। স্বামীকে হারিয়েছি। কয়েক বছর আগে ছোট ছেলেটাকে হারিয়েছি। আমার পরিবারের অবস্থা খুব খারাপ। কীভাবে চলবে আমার সংসার? বাসা ভাড়া পাঁচ মাস বাকি, কীভাবে পরিশোধ করবো? বাড়ির মালিক বাসা ছেড়ে দিতে বলেছেন। ছেলেটাকে নিয়ে কোথায় যাব? ছেলেটা বাবা ও ভাইকে হারিয়ে পাগলের মত হয়ে গেছে। এখনো সরকার বা জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে কোনো সাহায্য দেয় নাই। শুধু বলে এই কাগজ লাগবে, সেই কাগজ লাগবে। শাওন সেই কাগজ পত্র সংগ্রহ করতে বিভিন্ন জায়গায় দৌড়াদৌড়ি করছে। এ কারণে সে কাজও করতে পারছে না। এখন সংসারটা কীভাবে চলে?

রবিউল ইসলাম শাওন বলেন, আমি আমার বাবা হত্যার বিচার চাই। যারা আমাকে বাবাহারা করেছে আমি তাদের বিচার চাই। যে পুলিশ আমার বাবাকে গুলি করে হত্যা করেছে, আমাকে এতিম করেছে, মাকে বিধবা করেছে তার বিচার চাই। সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই, আমাদের পরিবারের জন্য যেন এটা ব্যবস্থা করা হয়, যাতে আমরা কোনো রকমে খেয়ে পরে বাঁচতে পারি।

তিনি বলেন, আমার বাবা মৃত্যুতে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা কখনো পূরণ হওয়ার নয়। তবে সরকার যদি আমার একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিতো তাহলে মাকে নিয়ে কোনোভাবে আমি বাঁচতে পারতাম।

শাওনের মা আমেনা বেগম বলেন, আসলে সেদিনের অবস্থা ও কষ্টের কথা বলা খুবই কঠিন। ছেলেটার মুখের দিকে তাকাতে পারি না। আর কোনো পরিবারকে যেন এমন সমস্যায় পড়তে না হয় আল্লাহর কাছে এই প্রার্থনা করি।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে প্রত্যাশার বিষয়ে তিনি জানান, আমার ও ছেলেটার নিরাপদ ভবিষ্যৎ চাই। শাওনের জন্য একটা চাকরি চাই। মহল্লার মানুষের কাছে শুনি সরকার বিভিন্ন শহীদ পরিবারকে সাহায্য-সহযোগিতা করছে। আমরা তো কোনো সহযোগিতা পাই নাই। সরকার অবস্থা বিবেচনা করে যেন আমাদের সহযোগিতা করে।

শহীদ মনিরুল ইসলাম অপুর শ্যালক মো. খোকন বলেন, এই পরিবারের শুধু দুলাভাই আয়-রোজগার করতো। এদের তো আর দেখার কেউ নেই। আমার আপা ও ভাগিনাটার মুখের দিকে তাকাতে পারি না। আমি যেটুকু পারি সাহায্য সহযোগিতা করছি। আমি চাই সরকারের পক্ষ থেকে যেন এই অসহায় পরিবারটির জন্য যেন কিছু করা হয়।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ঢাকা কলেজের উপাধ্যক্ষের রুমে তালা

সরকারি সার-বীজ বিক্রির সময় ধরা খেলেন কৃষি কর্মকর্তা

রাষ্ট্র সংস্কারে খেলাফত আন্দোলনের ১৫ দফা প্রস্তাবনা 

রামগড় স্থলবন্দর চালুর বিষয়ে কমিটি গঠন হবে : নৌপরিবহন উপদেষ্টা

সিলেটের টানা ‍দ্বিতীয় জয়

৪০ কোটি মানুষ আসবে এ মেলায়, প্রস্তুত ভারত

অল ব্রডকাস্টার্স কমিউনিটির ফ্যামিলি ডে অনুষ্ঠিত

ভারত থেকে এবার জাহাজে যা এলো

চলতি বছর প্রথম এইচএমপিভি শনাক্ত

বিয়ে নিয়ে মুখ খুললেন পড়শী

১০

ভবিষ্যতের উন্নয়ন এবং সুরক্ষায় দরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ

১১

পূর্বাচলে ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্লট, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

১২

ছাত্রদল নেতাকে গ্রেপ্তারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ

১৩

শিক্ষানবিশ ড্রাইভিং লাইসেন্সের বিষয়ে নতুন নির্দেশনা

১৪

আ.লীগ নেতার অবৈধ মার্কেট গুঁড়িয়ে দিল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ

১৫

এইচএমপিভি : আতঙ্ক নয়, প্রয়োজন সতর্কতা এবং কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা

১৬

পিএসসির ৩ ‘বিতর্কিত’ সদস্যের নিয়োগ বাতিলে আলটিমেটাম  

১৭

চেকপোস্টে দাঁড়ানো মোটরসাইকেলে বাসের ধাক্কা, নিহত ২

১৮

রাজশাহীতে চাকরিচ্যুত বিডিআর সদস্যদের পুনর্বহালের দাবি

১৯

নিমিষেই পুড়ে ছাই ২০৪ কোটি ডলারজয়ী ব্যক্তির প্রাসাদ

২০
X