ধানচাষের কথা ভাবলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিস্তীর্ণ উঁচু-নিচু ও সমতল ভূমির কথা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ধান চাষের এটাই স্বাভাবিক চিত্র। তবে শহরে-বাড়ির ছাদেও যে ধানচাষ সম্ভব, সেটি বাস্তবে করে দেখিয়েছেন বরিশাল নগরীর একজন চিকিৎসক। তার নাম ডা. নাফিসা জাহান।
তিনি বাড়ির ছাদে পরিত্যক্ত প্লাস্টিক বোতলে ধানচাষ করে শহরে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। তবে অবাক করার বিষয় তিনি কৃষি বিজ্ঞানের ছাত্রী নন, কিংবা পরীক্ষামূলক কোনো কাজও নয়। পেশায় চিকিৎসক হলেও তার এ ধরনের উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে স্থানীয় কৃষি বিভাগ।
ডা. নাফিসা জাহান বরিশাল ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন অ্যান্ড অ্যালাইড সায়েন্সেসের (ইনমাস) পরিচালক। কর্মস্থল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রতিষ্ঠান ইনমাসের চলছে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড। এ জন্য তার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠানটির মাঠ ব্যবহারের সুযোগ নেই।
ডা.নাফিসা বলেন, ‘কিন্তু আমার মাথায় চাপে কৃষিকাজের বিষয়টি। তাই নিজের শখ পূরণে ভবনের ছাদে ধানচাষ করা হয়েছে। সাফল্যও পেয়েছি।’
উদ্যোগটির শুরুর বিষয়ে সম্প্রতি এক আলাপচারিতায় তিনি বলেন, চিন্তা করছিলাম শুরুটা কীভাবে করবো? একদিন চিন্তা করলাম জায়গা নেই, তাতে কী? যদি প্লাস্টিকের বোতলকে ব্যবহার করি ফিল্ড হিসেবে-কেমন হয়! যেই ভাবনা সেই কাজ। তাই ভাঙাড়ির দোকানি থেকে ২ ও ৫ লিটারের প্লাস্টিকের ৫০০ বোতল সংগ্রহ করি। কালিজিরা জাতের এক কেজি ধানের বীজ সংগ্রহ করে এসব বোতলে আবাদ করা হয়। দেখি, এখানে বেশ ভালোভাবেই গাছগুলো বেড়ে উঠছে।
ডা. নাফিসার বলেন, ফি বছরই ইনমাস কার্যালয়ের সামনে সমতল ভূমিতে (জমি) বিভিন্ন কৃষিবাগান করি। এবারও বাগানের বার্ষিক বাজেট থেকেই ছাদে ধানচাষের ব্যয় করা হয়।
তবে এই সাফল্যের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব দিতে চান ইনমাসের মালি আনোয়ার হোসেনকে। ধানচাষে এই পরিচর্যাকারী বলেন, উন্নয়নমূলক কাজ চালু থাকায় নিচে বাগান তৈরি সম্ভব ছিল না। তাই কর্মকর্তাদের সঙ্গে মূল ভবনের ছাদে বাগান করার বিষয়ে পরামর্শ করি। এতে পরিচালকসহ কর্মকর্তারা সায় দেন। পরে বীজ ও অন্যান্য উপকরণ দিয়ে ধানচাষ করা হয়।
আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এর আগে এই ছাদে আখ লাগানো হয়েছে। আখের ফলন ভালো হওয়ায় ধানচাষের কথা মাথায় আসে। পরীক্ষামূলক উদ্যোগে সফল হওয়ায় খুবই ভালো লাগছে। যা ভবিষ্যতে হয়তো বিভিন্ন অঞ্চলে কিংবা এলাকায় শুরু করা যাবে।’
তিনি বলেন, জমিতে ধানচাষের ক্ষেত্রে যে পরিমাণ পোকামাকড়ের বালাই থাকে, ছাদে তেমন একটা নেই। পাশাপাশি বোতলে ধানচাষ করার কারণে মাটির সঙ্গে পানিও ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে। পাশাপাশি ছাদের ওপর কোনো প্রকার আগাছা না থাকায় দ্রুত সময়ের মধ্যেই ধানের চারাগুলো বেড়ে উঠেছে।
তিনি আরও বলেন, ‘সম্প্রতি সেখানে পাকা ধান কাটা হয়েছে। প্রথম বছরে প্রায় ৫০ কেজির মতো ধান পাওয়া গেছে। এটা বৃহৎ আকারে করলে ফলন আরও বাড়বে।’
এ বিষয়ে ইনমাসের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মাহাতাব উদ্দিন আল মাহাবুব বলেন, চিকিৎসা কেন্দ্রের পার্শ্ববর্তী চত্বরে সাধারণতও ফুল, ফল ও সবজির চাষাবাদ করা হয়। এতে পরিবেশ সৌন্দর্যের পাশাপাশি আগতদের মনও ভালো থাকে। কিন্তু এবার মাঠে সেটা করা সম্ভব হয়নি।
‘তাই প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক নাফিসা জাহান ছাদে বাগান করার বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন। প্রথমে আমাদের বিশ্বাসই হয়নি। অনেকে হাসাহাসিও করেছেন। কিন্তু ফলন হওয়ার পর মনে হচ্ছে তার উদ্যোগটি বেশ ভালো ছিল।’
তিনি বলেন, ছাদে ধানচাষের বিষয়টি এখন কোনো অংশেই খারাপ লাগছে না। বরং ছাদে ধান চাষের বিষয়টি আমাদের একটা অন্যরকম আনন্দ দিয়েছে। এ ছাড়া ছাদে ধানচাষের খবর ছড়িয়ে পড়ায় অনেকেই এটি দেখতে আসছেন।
তেমনই একজন মেডিকেল কলেজ সংলগ্ন বান্ধ রোডের বাসিন্দা মুশফিক সৌরভ। যিনি পেশায় একজন সাংবাদিক। সৌরভ বলেন, ভবনের ছাদে প্লাস্টিক বোতলে ধানচাষের বিষয়টি একেবারেই অভিনব। আর এটি করে ডা. নাফিসা জাহান বরিশালে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। অনেকেই প্রতিদিনই আসছেন তার প্রদর্শনী দেখতে। অনেকেই অনুপ্রাণিত হচ্ছেন। আমিও এই পদ্ধতিতেই বাড়ির ছাদে ধানচাষের চিন্তা করছি।
জানতে চাইলে ইনমাসেদর পরিচালক ডা. নাফিসা জাহান বলেন, ছাদে এত বড় পরিসরে ধানচাষের কথা দেশের অন্য কোথাও হয়েছে এমনটি শুনিনি। দু-একটা শখ করে অনেকই লাগাতে পারেন, তবে এতগুলো চারা বা ছাদের ওপর এত বড় ধানক্ষেত করার সাহস কেউই করেননি।
নাফিসা জাহান আরও বলেন, ‘আমার এই উদ্যোগের পুরো কৃতিত্ব যারা বাগান পরিচর্যা করেছেন তাদের। তাদের আগ্রহ আমায় আরও বেশি অনুপ্রাণিত করেছে। ভবিষ্যতেও আমরা এ ধরনের কাজে হাত দেব।’
যোগাযোগ করা হলে কৃষি অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মুরাদুল হাসান বলেন, ছাদবাগানের জন্য আমরা সাধারণত ফলমূল, শাকসবজি চাষের জন্য বাড়ির মালিকদের আগ্রহী করে তুলি। কিন্তু ছাদে ধানচাষ একটি নতুন উদ্যোগ। এই উদ্যোগকে কৃষি বিভাগ সাধুবাদ জানায়। কৃষি বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, এ পদ্ধতিতে এক শতাংশ জমিতে ৪০ কেজি ধান উৎপাদন হয়।
এক প্রশ্নের উত্তরে এই কৃষি কর্মকর্তা বলেন, বাড়ির ছাদে ধান উৎপাদন করতে চায়- এমন ব্যক্তিদের আমরা সাধুবাদ জানাই। কৃষি বিভাগ থেকে এ পদ্ধতিতে ধানচাষে প্রযুক্তিগত যে কোনো ধরনের সহযোগিতা ও পরামর্শ দেওয়া হবে।
মন্তব্য করুন