দিনটি ছিল বছরের ৪ আগস্ট ২০২৪। তখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে উত্তাল সারাদেশ। বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ দেখার স্বপ্নে বিকেলে ঢাকার বাইপালের আশুলিয়ায় বন্ধুদের সঙ্গে আন্দোলনে রাস্তায় নেমেছিলেন পোশাক কারখানার শ্রমিক নাঈম বাবু (১৮)। সেদিনের একটি বুলেট কেড়ে নেয় তার প্রাণ। সেই সঙ্গে ভেঙে যায় পরিবারের সব স্বপ্ন।
পরিবারের পরিকল্পনা ছিল কিছুটা সচ্ছলতা ফিরলেই নাঈমকে বিয়ে দেওয়ার। এরপর সেলাই মেশিন কিনে বাড়ির কাছে স্থায়ী একটি সেলাইয়ের (দর্জি) দোকান দেওয়ার। সে আয়ে পরিবারে ফিরবে সচ্ছলতা। এ জন্য জমিয়েছিলেন ২৬ হাজার টাকা। সে টাকায় পালনের জন্য একটি গরু কিনেছিলেন। আর কিছুটা টাকা জমলেই লক্ষ্য অর্জনের দিকে আগাবেন তিনি।
এ জন্য সময় নিয়েছিলেন এক বছর। কিন্তু একটি বুলেটের আঘাতে সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে পরিবারটির।
নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার রণচণ্ডী ইউনিয়নের সোনাকুড়ি গ্রামে শহীদ নাঈম বাবুর বাড়ি। আশুলিয়ার একটি পোশাক কারখানায় কর্মরত ছিলেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই থাকতেন মামা আনিছুর রহমান ও মামি রোখসানা বেগমের পরিবারের সঙ্গে।
গত ৪ আগস্ট পোশাক কারখানার ছুটির পর বিকেলে কয়েক বন্ধু মিলে বৈষম্যবিরোধী মিছিলে অংশ নেন নাঈম বাবু। এরপর পেটে গুলি লাগলে তাকে আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৫ আগস্ট রাত ২টার দিকে তার মৃত্যু হয়। ৬ আগস্ট বেলা ১১টার দিকে বাড়িতে তার মরদেহ এসে পৌঁছালে আসরের নামাজের পর পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
তার মামি রোখসানা বেগম জানান, ছয় বছর বয়সে নাঈমের বাবা মারা যায়। এর দুই বছর পর মা হাছনা বানুর অন্যত্র বিয়ে হয়। এক বোন তিন ভাইয়ের মধ্যে নাঈম সবার ছোট। তার বাবার মৃত্যুর আগে বড়বোন নাজমিনের বিয়ে হয়েছে। জীবিকার তাগিদে বড়ভাই নাজমুল ইসলাম চট্টগ্রামে এবং মেজোভাই আব্দুল হাকিম ঢাকায় থাকেন।
রোখসানা বেগম বলেন, জন্মের পর থেকে আমি তাকে লালনপালন করেছি সন্তানের মতো করে। আমার দুই সন্তানের সঙ্গে তাকে আমি বড় সন্তান মনে করতাম। সেও ধরে নিয়েছিল এটিই তার পরিবার। আমাদের মামা-মামি ডাকলেও বাবা-মায়ের মতোই মনে করতো। আমার দুই সন্তানকেও নিজের ছোট ভাই মনে করে দেখাশোনা করতো। তার ইচ্ছা ছিল বড় হয়ে আয় রোজগার করে দুই ছোটভাইকে লেখাপড়া শিখিয়ে অনেক বড় করবে। কিন্তু সে সাধ আর পূরণ হলো না তার।
গ্রামের একটি হাফেজিয়া মাদ্রাসায় মোহতামিম হিসেবে কাজ করেন নাঈমের মামা। মামি বাড়িতে দর্জির কাজ করেন। তাদের সংসার এই সামান্য আয়ে অনেক অভাব অনটনে চলত।
এমন কষ্টের সংসারে নাঈম লেখাপড়া করেছেন চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত। পরে একটি মাদ্রাসায় কোরআন হেফজ করেন ১৫ পারা। শেষে সংসারের অভাব দূর করতেই ঢাকায় পোশাক কারখানায় কাজ নিয়েছিলেন তিনি।
মামা আনিছুর রহমান জানান, এক বছর পর বাড়িতে নতুন একটা ঘর তুলে বিয়ে দেওয়ার কথা ছিল নাঈমের। এরপর সেলাই মেশিন কিনে বাড়ির কাছে তার মামিসহ একটি দর্জির (সেলাই) দোকান দেওয়ার কথা ছিল। এ জন্য নাঈম টাকা জোগাড় করতে ঢাকায় যায়। সেখানে প্রতি মাসে যে আয় হতো নিজের খরচের পর কিছুটা সঞ্চয় এবং কিছু টাকা মামা-মামির খরচের জন্য পাঠিয়ে দিত। তার সঞ্চয়ের টাকায় বাড়িতে পালনের জন্য ২৬ হাজার টাকায় একটি গরু কেনা হয়। আর কিছু টাকা জমলেই বাড়িতে চলে আসার কথা ছিল নাঈমের। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে একটি বুলেটের আঘাত সব তছনছ করে দিয়েছে। সবাইকে কাঁদিয়ে বিদায় নিয়েছে নাঈম।
তিনি বলেন, আন্দোলন চলাকালে তাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলাম আমি। এ জন্য সেদিন (৪ আগস্ট) দুপুরে ফোন করেছিলাম। সে বলেছিল মামা ব্যস্ত আছি। সন্ধ্যায় তোমাকে ফোন দেব। সে ফোনের অপেক্ষায় থেকে শেষ পর্যন্ত গুলিতে আহত হওয়ার খবর পাই।
জীবিত আছেন নাঈমের নানি আবেদা খাতুন। নানা তছকিন আলী মারা গেছেন দেড় বছর আগে। আদরের নাতিকে নিয়ে ছিল অনেক স্বপ্ন। কিন্তু সে স্বপ্ন পূরণের আগে নাতিকে হারানোর শোক যেন বইতে পারেছেন না নানি আবেদা খাতুন। নাতির কথা স্মরণ করলেই ভারী হয়ে ওঠে তার কণ্ঠ। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময় ঘটেছিল তেমনটাই।
তিনি বলেন, ‘ওর (নাতি) নানা তো চলি গেইল। মুই (আমি) আশা করিছিনু নাতির সুখ দেখি তার পরোত মরিম। এলা মোর আগোত নাতি দুনিয়া ছাড়ি গেইল’।
পারিবারিক সূত্র জানায়, জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী অফিসারের দপ্তর এবং একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষে কিছু অর্থনৈতিক সহযোগিতা করা হয়েছে পরিবারকে। নাঈমের চিকিৎসার সময়ে হওয়া বিভিন্ন ধারদেনা পরিশোধ করতে হচ্ছে এখন পরিবারটিকে।
মন্তব্য করুন