ঢাবি প্রতিনিধি
প্রকাশ : ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:২২ পিএম
আপডেট : ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:০৬ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

রাজনৈতিক সহিংসতায় আহত-নিহতের সংখ্যা জানাল এইচআরএসএস

এইচআরএসএস সংবাদ সম্মেলনে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ছবি : কালবেলা
এইচআরএসএস সংবাদ সম্মেলনে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ছবি : কালবেলা

দেশে রাজনৈতিক সহিংসতায় ২০২৪ সালে কমপক্ষে ১ হাজার ১৮০ জন নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ৩৭ হাজার ৫১ জন। এ ছাড়া, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর মাধ্যমে দেশে কমপক্ষে ১৫ হাজার ৫২০ রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও সমর্থক গ্রেপ্তারের শিকার হয়েছেন।

বাংলাদেশের ১২টি জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ এবং নিজেদের তদন্তের ভিত্তিতে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে আসে।

মঙ্গলবার (৩১ ডিসেম্বর) রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের জহুর হোসাইন চৌধুরী হলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংগঠনটি। এ সময় উপস্থিত ছিলেন এইচআরএসএসের নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলাম, জয়েন্ট সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট মনিরুজ্জামান, প্রজেক্ট অফিসার সাইফুল ইসলাম, ডকুমেন্টেশন অফিসার জবা ইয়াসমিন প্রমুখ।

এক লিখিত বক্তব্যে সাইফুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৩ বছর অতিবাহিত হলেও এ দেশের মানুষ এখনো স্বাধীনতার প্রকৃত সুফল পায়নি। সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার শব্দগুলো ২০২৪ সালে এসেও বাংলাদেশের মানুষের কাছে স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। স্বাধীনতার পর ২০২৪ সালের বিশেষত আগস্ট মাস পর্যন্ত মানবাধিকার পরিস্থিতি ছিল সবচেয়ে ভীতিকর ও চরম উদ্বেগজনক। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ মানবাধিকার সুরক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকলেও বছরজুড়ে আইনের শাসন, গণতন্ত্র, ভোটাধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সভা-সমাবেশের অধিকার এবং সামাজিক নিরাপত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোতে মানবাধিকার পরিস্থিতির শুধু অবনতিই নয়, বরং চরম উদ্বেগজনক মাত্রায় পৌঁছেছিল। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের বিতর্কিত ও ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনে যেখানে বাংলাদেশের অনেক মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পায়নি সেখানে বিরোধী দলবিহীন আরেকটি অগ্রহণযোগ্য ও প্রশ্নবোধক নির্বাচন এবং ব্যাপক সহিংসতা দিয়ে ২০২৪ সাল শুরু হয়।

তিনি বলেন, জুন মাসে শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জুলাই ও আগস্টে সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর ব্যাপক দমন-পীড়নে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা আহত-নিহত হন। হত্যাযজ্ঞ চলাকালে ছাত্র-জনতার ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে সৃষ্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে তৎকালীন স্বৈরাচার প্রধানমন্ত্রী ৫ আগস্ট পালিয়ে যাওয়ার পর দেশজুড়ে ব্যাপক লুটপাট, অরাজকতা, বাড়িঘর ও ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুর, সংখ্যালঘু নির্যাতন, বিচার-বহির্ভূত হত্যা, গণপিটুনি, লাঞ্ছনা, চাঁদাবাজিসহ নানা ধরনের অপ্রীতিকর এবং অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটতে থাকে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটে ও রাজনৈতিক প্রতিশোধমূলক আক্রমণ ব্যাপকভাবে সংঘটিত হয়। বিশেষ করে, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও যারা শেখ হাসিনা সরকারের সমর্থক হিসেবে পরিচিত ছিল, তাদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়। এরপর গত ৮ আগস্ট নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টায় কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। সরকারকে প্রধানত প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অসহযোগিতার কারণে বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হয়। এ সময়েও দেশজুড়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন হতে থাকে, যা এখন পর্যন্ত পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি।

এইচআরএসএসের প্রতিবেদন বলছে, ২০২৪ সালে উদ্বেগজনকভাবে রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ১১৮০ জন ও আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৩৭০৫১ জন। জুলাই-আগস্টের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে কমপক্ষে ১০১৩ জন নিহত ও আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৩০ হাজার মানুষ। অন্যান্য রাজনৈতিক সহিংসতার অধিকাংশ ঘটনাই আওয়ামী লীগ-বিএনপির সংঘর্ষ ও তাদের অন্তর্কোন্দলীয় আধিপত্য বিস্তারকেন্দ্রিক সংঘর্ষে ঘটে। তাছাড়া আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর দ্বারা কমপক্ষে ১৫৫২০ রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও সমর্থক গ্রেপ্তারের শিকার হয়, তন্মধ্যে অধিকাংশ বিএনপি-জামায়াত ও আওয়ামী লীগের। একই সময়ে, রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে কমপক্ষে ১৩৮৩টি মামলায় অন্তত ৬৬ হাজার জনের নাম উল্লেখ করে এবং আরও কমপক্ষে ৬৬০০০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আওয়ামী লীগ সরকারের দলীয় নেতাকর্মীদের দ্বারা বিরোধীদলীয় কমপক্ষে ৭০৪টি সভা-সমাবেশ আয়োজনে বাধা প্রদানের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় তাদের সঙ্গে সংঘর্ষে কমপক্ষে ৩০ হাজার জন আহত এবং সমাবেশকেন্দ্রিক অন্তত ৬ হাজার জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

সাংবাদিক ও সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও নির্যাতনের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, এ বছর কমপক্ষে ৩০৮টি হামলার ঘটনায় ৭২৬ সাংবাদিক হত্যা, নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। ১০ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন অন্তত ৪৫৯ জন, লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন ৫৯ জন, হুমকির শিকার হয়েছেন ৪৫ জন, গ্রেপ্তার ১৯ জন ও ১৩৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনকেন্দ্রিক ঘটনায় পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে কমপক্ষে ২৭০ সাংবাদিক আহত, হুমকি, গ্রেপ্তার ও লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন এবং নিহত হয়েছেন ৬ জন। একই সময়ে আশঙ্কাজনকভাবে, সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩-এর অধীনে দায়ের করা ৩২টি মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন ২১ জন এবং অভিযুক্ত করা হয়েছে ৭৯ জন। এছাড়া ‘সংখ্যালঘু’ সম্প্রদায়ের উপর কমপক্ষে ১১২টি হামলার ঘটনায় ৫ জন নিহত, আহত হয়েছেন ৮৩ জন এবং ২৮টি মন্দির, ৩১টি প্রতিমা ও ২৮৪টি বসতবাড়ি, ২৪০টি দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছর ‘গণপিটুনির’ অন্তত ২০১টি ঘটনায় নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ১৭৩ জন এবং আহত হয়েছেন ৮৮ জন। এ সময়ে অন্তত ৬০৯টি শ্রমিক নির্যাতনের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে কমপক্ষে ২৪০ জনসহ নিহত হয়েছেন ৪৩৯ জন এবং আহত হয়েছেন ৫৯৫ জন। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং শ্রমিকদের সুরক্ষামূলক সরঞ্জামের অভাবে দুর্ঘটনায় ১৬৮ শ্রমিক তাদের কর্মক্ষেত্রে মারা গেছেন। এ সময়ে ১৩টি গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনায় ৯ জন নিহত ও ৪ জন আহত হয়েছেন। এছাড়াও ‘ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী’ (বিএসএফ) কর্তৃক ৫৭টি হামলার ঘটনায় ২৬ বাংলাদেশী নিহত এবং ২৫ জন আহত, গুলিবিদ্ধ ৪৭ ও ১৫৮ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। এ সময়ে ভারতীয় সীমান্তে আরও ৯ বাংলাদেশির লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়াও ‘মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী’ (বিজিপি) ও আরাকান আর্মি কর্তৃক ১৭টি হামলার ঘটনায় ৬ বাংলাদেশি নিহত এবং ২৫ জন আহত, গুলিবিদ্ধ ১৩ ও ৭৪ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০২৪ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারা/হেফাজতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের কমপক্ষে ২৫টি ঘটনার শিকার হয়েছেন ২৫ জন। যাদের মধ্যে ১ জন তথাকথিত ক্রসফায়ার/বন্দুকযুদ্ধের নামে, ১৩ জন নির্যাতনে এবং ১০ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে থাকা অবস্থায় ১ জন মারা গিয়েছেন। গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত শুধু পুলিশের হামলায় ৫১০ (৭৬ শতাংশ) জন, অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ৬৩ (৯ শতাংশ) জন নিহত হয়েছেন। পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিহতের সংখ্যা ৮৫ শতাংশের বেশি। এছাড়াও কারা হেফাজতে ১০১ জন মারা গেছেন। যাদের মধ্যে ৪১ জন কয়েদি ও ৬০ জন হাজতি।

নারী ও শিশু নির্যাতনের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালে ১৪৯৮ জন নারী ও কন্যা শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৫৫৭ জন, যাদের মধ্যে আশঙ্কাজনকভাবে ২৮৪ জন (৫১ শতাংশ) কম বয়সী শিশু। এটা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় যে, ১৩০ জন (২৩ শতাংশ) নারী ও শিশু গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন এবং ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪০ জনকে যাদের মধ্যে শিশু ২২ জন এবং ১১ জন ধর্ষণের শিকার নারী আত্মহত্যা করেছেন। ৩২২ নারী ও শিশু যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, তন্মধ্যে শিশু ১৩০ জন। যৌতুকের জন্য নির্যাতনের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪৮ নারী এবং শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৩২ জন ও আত্মহত্যা করেছেন ৬ জন। পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন ৩১৯ জন, আহত হয়েছেন ৭৪ জন এবং আত্মহত্যা করেছেন ১২৭ নারী। অ্যাসিড সহিংসতার শিকার হয়েছেন ১৩ নারী। অন্যদিকে, এটি উদ্বেগজনক যে, এ বছর কমপক্ষে ৪৩০০ শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, যাদের মধ্যে ৬৬২ জন প্রাণ হারিয়েছেন এবং ৩৭১৪ জন শিশু শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। জুলাই-আগস্টের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ১৩৬ শিশু নিহত ও কমপক্ষে ৩০০০ জন আহত হয়েছেন।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ছাত্রশিবির কবে থেকে সম্মেলন করছে, জানালেন জাহিদুল

এ সরকারকে পুরো জাতি সমর্থন করে : ব্যারিস্টার খোকন

‘তরুণ প্রজন্মের ত্যাগ বৃথা যেতে দেওয়া যাবে না’

বিপিএলে বড় জয়ে পয়েন্টের খাতা খুললো চিটাগাং

কয়েক দফা ভর্তি শেষেও শাবিপ্রবিতে আসন ফাঁকা

ইউল্যাব ক্যাম্পাসে আন্দোলনের শান্তিপূর্ণ সমাধান

শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার কথা উঠে এলো পাঠ্যবইয়ে

শহীদ ওয়াসিম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে টোল আদায় শুরু

সংসারের হাল ধরা হোসাইনকে কেড়ে নিল ওরা

সিডনিতে বোলান্ডের আগুনে বোলিংয়ে অস্ট্রেলিয়ার দাপট

১০

ডাকসু নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবিতে আলটিমেটাম

১১

শৈতপ্রবাহে বিপর্যস্ত লালমনিরহাটের জনজীবন

১২

শীত নিয়ে আবহাওয়া অফিসের নতুন তথ্য

১৩

রাবির আইসিটি সেন্টারের পরিচালকের পদত্যাগের ঘোষণা

১৪

ঢাবি প্রশাসনের সঙ্গে সাদা দলের নতুন কমিটির সৌজন্য সাক্ষাৎ ও মতবিনিময়

১৫

একই মঞ্চে বয়ান দেবেন আজহারী-আহমাদুল্লাহ

১৬

‘ভোট নিয়ে ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করা হবে’

১৭

উসমানের ঝড়ো সেঞ্চুরিতে মিরপুরে বিপিএলের নতুন রেকর্ড

১৮

সড়ক দুর্ঘটনায় আ.লীগ নেতা নিহত

১৯

জয়পুরহাটে হত্যা মামলায় আ. লীগ নেতা নাদিম গ্রেপ্তার

২০
X