‘এক দিন কথা না কইলে ছেলেরও মন ভালো থাকত না। আমার মনও খারাপ থাকত। ছেলে কইত, “মা, তোমার লগে কথা না কইলে রাইতে আমার ঘুম আসে না।” মৃত্যুর আগের দিন রাইতে ছেলের লগে কথা হইছে। ছেলে আমার খোঁজখবর নিছে, জিজ্ঞাসা করছে, “মা, তুমি ভাত খাইছ?” ছোট দুই বোন ঠিকমতো পড়ালেখা করে কি না, সেই খোঁজও নিয়েছে।’
এটাই ছিল শহিদ মো. আরিফের সঙ্গে তার মা ফরিদা বেগমের শেষ কথা। এরপর দিন খবর আসে আরিফ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। এ খবর জানিয়েছে বাসস।
যে সন্তানের মায়ায় দিন কাটে মায়ের, সেই সন্তানের এমন মৃত্যুর খবর কীভাবে বিশ্বাস করবেন মা? কিন্তু মেনে নিলেও আরিফের কথা কিছুতেই ভুলতে পারেন না মা ফরিদা বেগম (৪৫)। নিহতের পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও আজও কান্না থামেনি তার। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে তিনি এখন পাগলপ্রায়।
পাঁচ মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে আরিফ (২৪) ছিলেন চতুর্থ। আরিফের ছোট দুই বোনের মধ্যে সুমাইয়া দশম শ্রেণিতে ও রিপা সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। বড় তিন বোনের বিয়ে হয়েছে।
পরিবারের অভাবের কারণে আরিফকে গত জুলাই মাসের প্রথম দিকে ঢাকায় মামাতো ভাই সাহাবুদ্দিনের খাবার হোটেলে কাজের জন্য পাঠানো হয়। পাশাপাশি আরিফ লালমোহনের রায়চাঁদ এলাকার একটি আলিম মাদ্রাসার আলিম দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।
শহিদ আরিফ ভোলার লালমোহন উপজেলার লর্ডহার্ডিঞ্জ ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের রায়চাঁদ গ্রামের মো. ইউছুফ মিয়ার (৫৫) একমাত্র ছেলে। ইউসুফ মিয়া অন্যের জমিতে বর্গা চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
ফরিদা বেগম বলেন, পাঁচ বোনের একমাত্র ভাই ছিল আরিফ। প্রতিদিন ফোন করে সবার বাসার খোঁজ নিত সে। আরিফকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল সবার। পড়ালেখা করে ভালো কিছু করবে, এটাই ছিল সবার আশা। পরিবারের সবার মুখে হাসি ফোটাবে। মা-বাবাকে নিয়ে আমার ছেলের অনেক স্বপ্ন ছিল। সেসব স্বপ্নের কথা আমার কাছে বলত আরিফ। সে সব সময় বলত আমাদের জন্য পাকা ঘর করবে। আমাদের সেই ঘরে রাখবে। কিন্তু সেটি আর হয়ে ওঠেনি।
ছেলে হত্যার বিচার দাবি করেছেন ফরিদা বেগম। একই সঙ্গে যার নির্দেশে এত মায়ের বুক খালি হয়েছে, সেই শেখ হাসিনার বিচার দেখে মরতে চান তিনি।
শহিদ মো. আরিফের বাবা মো. ইউছুফ বলেন, গত ১৯ জুলাই জুমার নামাজের পর হোটেলের বাজার করার জন্য যাত্রাবাড়ী এলাকায় সবজির পাইকারি আড়তে যায় আরিফ। পরে বিকেলের দিকে মামাতো ভাই সাহাবুদ্দিনের মোবাইলে কল আসে। বলে, আরিফ যাত্রাবাড়ী এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে আছে। খবর পেয়ে দ্রুত সেখানে গিয়ে তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
আরিফের ডান চোখের নিচে একটি গুলি বিদ্ধ হয়ে মাথার পেছন দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। এরপর শনিবার দিবাগত রাতে ঢাকা মেডিকেল থেকে মরদেহ নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে ভোলার উদ্দেশে রওনা দেন তারা। পরদিন রবিবার সকাল ৮টার দিকে জানাজা শেষে তাকে গ্রামের বাড়ির পাশের মসজিদের কবরস্থানে দাফন করা হয়।
ইউছুফ আরও জানান, একমাত্র ছেলেকে নিয়ে পরিবারের সবার অনেক আশা-ভরসা ছিল। পড়ালেখা করে বড় হয়ে চাকরি করে সবার মুখে হাসি ফোটাবেন। কিন্তু এর আগেই তাকে পরপারে চলে যেতে হলো।
যারা তাকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করেছে, তাদের উপযুক্ত বিচার দাবি করেন ইউছুফ। তিনি জানান, জামায়াতে ইসলামী থেকে কিছু আর্থিক সহায়তা ও উপজেলা প্রশাসন থেকে কিছু অনুদান পেয়েছেন।
তিনি বলেন, আমি আর কামলা খাটতে পারি না। শরীরে এখন আর শক্তি পাই না। উপার্জন করার মতো ছেলে আরিফই ছিল আমার পরিবারের ভরসা কিন্তু আমার পোলাডারে ওরা আর বাঁচতে দিল না।
তিনি ছেলে হত্যার সঠিক ও সর্বোচ্চ বিচার দাবি করেন।
মন্তব্য করুন