শহরের মানুষকে আদিবাসীদের বৈচিত্র্যময় খাবার ও শস্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে রাজধানীতে শুরু হয়েছে ‘আদিবাসী খাদ্য ও শস্য মেলা’।
শুক্রবার (২০ ডিসেম্বর) মিরপুর ১৩-তে বনফুল আদিবাসী গ্রিনহার্ট কলেজ প্রাঙ্গণে এই মেলার উদ্বোধন করেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। দুই দিনের এই মেলা শনিবার রাতে শেষ হবে বলে জানিয়েছে মেলার আয়োজক ‘নাগরিক উদ্যোগ’ ও ‘মহা প্রজ্ঞা এডুকেশন ট্রাস্ট’।
উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, খাদ্য তো কেবল খাদ্য নয়। এই খাদ্যকে সাধুরা বলেন, ‘শরীরের সেবা করা’। খাদ্য মানে শুধু ভক্ষণ করা নয়। আমাদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে হলে সুস্থ খাবারই খেতে হবে। সেজন্য আমাদের খাবার উৎপাদন করতে হবে। আধুনিক খাদ্য উৎপাদনে যে সার দেওয়া হয়, এতে করে বীজটাকেও নষ্ট করে ফেলা হয়। আমাদের বীজের পরিচর্যা করতে হবে।
কাপ্তাই হ্রদে ৮২ প্রজাতির মাছ আছে জানিয়ে ফরিদা আখতার বলেন, কিছু প্রজাতির মাছ হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের মন্ত্রণালয়ের কাজ হচ্ছে হারিয়ে যাওয়া মাছ ফিরিয়ে আনা, মাছের অভয়ারণ্য তৈরি করে বিপন্ন মাছকে রক্ষা করা। এটা নিয়ে আমরা কাজ করছি। পাহাড়ি মুরগি শহরে এসে আধুনিক দোকানে ‘প্রোটিন প্যাকড’ বলে বিক্রি করা হচ্ছে। পাহাড়ি মুরগি বললে সমস্যা কি? বিশ্বে যত মুরগি আছে, এই পাহাড়ি মুরগি তাদের আদি প্রজাতি।
পাহাড়ে জুম চাষের জমিতে তামাক চাষ বাড়ছে জানিয়ে ফরিদা আখতার বলেন, পাহাড়ি এলাকায় হাইব্রিড চলে গেছে। হাইব্রিড মানেই বিষ। পাহাড়ে তামাক চাষ বাড়ছে। আমাদের তামাক চাষ বন্ধ করতে হবে।
বাজার সিণ্ডিকেট এখনো নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি বলেও মন্তব্য করেন উপদেষ্টা। তিনি বলেন, খাদ্যে কীটনাশক ব্যবহার হচ্ছে, এটা এখনো নিয়ন্ত্রণ হয়নি। পোল্ট্রি এখন অ্যান্টিবায়েটিক মুক্ত, এটা বলতে পারি। এছাড়া বাজার অস্থিরতা কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা গেছে। কিন্তু বাজারে এখনো সিন্ডিকেট আছে। মাঝখানে হাতবদলের মাধ্যমে যে দামটা বাড়ে, এটা এখনো আছে। আমরা চেষ্টা করছি, তা বন্ধ করতে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ধান আমাদের বৈচিত্র্য, নানা ধরণের বীজ আমাদের ঐতিহ্য। এসব ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে। তা রক্ষা করতে হবে। পৃথিবীতে বহু মানুষ না খেয়ে রাতে ঘুমুতে যান। আবার অনেক মানুষ প্রচুর খাবার অপচয় করেন। আমাদের বড় বড় হোটেলে বাফেট খাবারের আয়োজন করা হয়, সেখানে প্রচুর খাবার অপচয় হয়। যা দিয়ে অনেক মানুষের খাদ্য চাহিদা মেটানো যেত। যেটুকু তুমি খেতো পার, সেটুকুই নাও। বেশি নিও না।
‘মহা প্রজ্ঞা এডুকেশন ট্রাস্ট’ এর সভাপতি ভদন্ত প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো বলেন, আমরা আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজটার মধ্যদিয়ে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মাঝে একটা সেতুবন্ধন তৈরি করার কাজটি করছি।
অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য দেন কিশোরগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক দিলীপ কুমার বড়ুয়া, নাগরিক উদ্যেগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন। পরে অতিথিরা বেলুন উড়িয়ে মেলার উদ্বোধন করেন এবং মেলা প্রাঙ্গণে বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখেন।
আয়োজকরা জানান, মেলায় বাহারি আদিবাসী খাবারের স্বাদ নেওয়ার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আয়োজনও থাকছে। শুক্রবার সন্ধ্যায় মেলায় গান শোনাবে আদিবাসী নারীদের ব্যান্ড ‘এফ মাইনর’। আদিবাসীদের ঐতিহ্যমণ্ডিত তেল ও মসলামুক্ত খাবারের অনেকগুলো স্টল রয়েছে মেলায়।
গারো সাহিত্য পত্রিকা ‘থকবিরিম’ সম্পাদক মিঠুন রাকসাম বলেন, আমাদের প্রত্যেক জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব ঐতিহাবাহী খাবার রয়েছে, কিন্তু নানান আগ্রাসনে সেই খাবারের ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। এই মেলার মধ্য দিয়ে আমাদের ঐতিহ্যবাহী খাবারের সঙ্গে নগরের মানুষের পরিচয় ঘটবে।
পাহাড়ের জনপ্রিয় ‘ব্যাম্বু শুট’, কলা পাতায় রান্না করা বিভিন্ন পদের ‘হেবাঙ’, পাহাড়ি মুরগি ও কাপ্তাই হ্রদের মাছসহ নানা ধরনের জুমিয়া সবজির পদ রয়েছে মেলায়। পার্বত্য অঞ্চলের জনপ্রিয় খাবার ‘পাজনের’ স্বাদও নিতে পারবেন মেলায় আসা দর্শনার্থীরা। সমতলের আদিবাসীদের বৈচিত্র্যময় খাবারের পসরা সজিয়ে বসেছেন মনিপুরী, গারো ও রাখাইনরা। কালো ও সাদা বিন্নি চালের বিভিন্ন প্রকার মুখরোচক পিঠাও আছে মেলায়।
আছে নানা ধরনের ‘মুন্ডি’। বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে আছে পাহাড়ের ‘বাঁশের হুক্কা’, যা ‘বাঁশ দাবা’ নামে বেশি পরিচিত। আছে নানা প্রকার টাটকা ফলের ঝাল খাবার, যা ‘লাকসো’ নামে পরিচিত। এছাড়া শাকসবজি, ফলমূল, বৈচিত্র্যপূর্ণ নানা জাতের কৃষিপণ্যের সমাহার এবং শুঁটকির পসরা নিয়ে বসেছেন উদ্যেক্তারা।
মেলায় আসা দর্শনার্থীরা পাহাড়ি খাবার ও শস্যের বৈচিত্র্যে মুগ্ধ হয়েছেন। আয়োজকরা আশা করছেন, এ আয়োজন শহরবাসীর খাদ্যাভ্যাসে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে এবং পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখবে।
মন্তব্য করুন