মঙ্গলবার, ০১ এপ্রিল ২০২৫, ১৮ চৈত্র ১৪৩১
কালবেলা ডেস্ক
প্রকাশ : ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:১৪ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

‌‘জনগণকে ধাঁধায় ফেলে উচ্চ প্রবৃদ্ধির কাল্পনিক গল্প শোনানো হয়’

ছবি : সংগৃহীত
ছবি : সংগৃহীত

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের আমলে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে যে অর্জন ছিল, তাকে অতিরঞ্জিত বলে মনে করে গত ১৬ বছরের অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি।

পরিসংখ্যান জালিয়াতির প্রচুর আলামত পেয়েছে জানিয়ে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি বলছে, পরিসংখ্যানগত দিক থেকে ব্যতিক্রমী হলেও তা ছিল এক অলীক বিষয়। এ সময় জনগণকে এক ধাঁধার মধ্যে ফেলে ‘উচ্চতর প্রবৃদ্ধি’র কাল্পনিক গল্প শোনানো হয়। এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে বাসস।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনীতির পরিস্থিতি নিরূপণ এবং গত ১৬ বছরের অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করে। সেই কমিটি গত ১ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন পেশ করে। সেখানে প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান নিয়ে এসব কথা বলা হয়েছে।

কমিটি জানায়, ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে যে উচ্চ প্রবৃদ্ধি হয়েছে, সমপর্যায়ের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার ছিল বেশি। কমিটি মনে করে, রাজনৈতিকভাবে বাহাবা পাওয়ার জন্য জিডিপির হার ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছে, যা বাস্তবতার সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। তথ্য-উপাত্ত নিবিড়ভাবে খতিয়ে দেখা হলে বোঝা যায়, এই পরিসংখ্যান ভুল।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশ উচ্চহারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। কিন্তু অর্থনীতির অন্যান্য সূচকের সঙ্গে প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান মেলে না, এই অভিযোগ অর্থনীতিবিদরা অনেক দিন ধরেই করে আসছিলেন। অর্থনীতি নিয়ে কাজ করা সংবাদকর্মীরা প্রবৃদ্ধির হিসাব নিয়ে নানা সময়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ফলে এই উচ্চহারের প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়।

প্রতিবেদনে শ্বেতপত্র কমিটি উচ্চ প্রবৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধান করে বলেছে, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার তৃতীয় পক্ষের স্বাধীন পর্যালোচনা ছাড়াই প্রকাশ করা হয়েছে। সরকারিভাবে সংগৃহীত পরিসংখ্যানের ভিত্তিতেই কেবল তা করা হয়েছে। শুধু সরকারি পরিসংখ্যানের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণে দেখা গেছে, দুঃসময় বা দুর্যোগের সময়ও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার ছিল অত্যন্ত চাঙা।

আর্থিক খাতের পরিসংখ্যান কারসাজির বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা র‌্যাপিডের চেয়ারম্যান ড. এম এ রাজ্জাক বলেন, ‘জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু জাতীয় আয়, মূল্যস্ফীতিসহ আর্থিক খাতের যে পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে, তার হিসাব নিয়ে আগে থেকে সন্দেহ করা হচ্ছিল। রাজনৈতিক স্বার্থে পরিসংখ্যান কারসাজি করা হয়েছে এবং ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বলা হয়েছে। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি এই কারসাজি চমৎকারভাবে উন্মোচন করেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘উন্নয়নের যে গল্প শোনানো হয়েছে, তা-ও বাস্তবিক ছিল না। সেটি ছিল অলীক।’ এখন থেকে যেন প্রকৃত পরিসংখ্যান পাওয়া যায়, সরকারকে সেই পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ জানান তিনি।

শ্বেতপত্রের প্রতিবেদনের ভাষ্য, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার নিরূপণের বিভিন্ন মডেল আছে, যেসব মডেলে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের মধ্যে তাত্ত্বিক সম্পর্ক থাকে যেমন : শ্রম, পুঁজি, উৎপাদনশীলতা। কিন্তু এসব প্রথাগত মডেলে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির উচ্চহার ব্যাখ্যা করা যায় না। ফলে শ্বেতপত্র কমিটি মনে করছে, এসব তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত পক্ষপাত ছিল।

কোভিড-১৯ মহামারির যে সরলরৈখিকভাবে উচ্চ প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তথ্য-উপাত্ত ও পদ্ধতিগতভাবে তা ব্যাখ্যা করা যায় না। এই সরলরৈখিক উচ্চ প্রবৃদ্ধির কারণ হিসেবে শ্বেতপত্র কমিটি মনে করে, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক প্রচারণার স্বার্থে রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তিরা প্রবৃদ্ধির গতি বাড়িয়ে দেখিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে যে রাজনৈতিক কর্তা সবচেয়ে উৎসাহী ও প্রভাবশীল ছিলেন, তার প্রস্থানের পরও পরিসংখ্যান ব্যুারোর মধ্যে সেই রেশ থেকে গিয়েছিল। ওপর মহলের ক্রোধের ভয়ে পরিসংখ্যান ব্যুারো ধারাবাহিকভাবে ভুল পরিসংখ্যান প্রকাশ করে গেছে। টেকনিক্যাল কমিটির মাধ্যমে বিবিএসের তথ্য-উপাত্তের যে পর্যালোচনা হতো, ২০১৫ সালের পর তা একেবারে ভেঙে পড়েছে। শ্বেতপত্র কমিটি দেখিয়েছে, আন্তর্জাতিক প্যানেল ডেটা ব্যবহার করে দেখা গেছে, কোভিড-১৯ মহামারির চার-পাঁচ বছর আগেই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি কমে গিয়েছিল। কমিটি গত ১৬ বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে ১৯৯৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করেছে। এতে দেখা গেছে, এই সময় প্রকৃত প্রবৃদ্ধির হার ধারাবাহিকভাবে আনুষ্ঠানিক প্রবৃদ্ধির চেয়ে কম ছিল। এই প্রবণতা উত্তরোত্তর কেবল বেড়েছে। অর্থাৎ এই বাড়িয়ে দেখানোর প্রবণতা ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে।

প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান নিয়ে বিশ্বব্যাংকও সময় সময় আপত্তি তুলেছে। বিবিএসের প্রকাশিত তথ্যের সঙ্গে বিশ্বব্যাংক ও এডিবির তথ্যগত পার্থক্য ক্রমাগত বেড়েছে। ২০১৮ সালে প্রবৃদ্ধির তথ্যে বিস্তর ফারাক নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়ান তৎকালীন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। যদিও ‘লোটাস কামাল’ ওই বছরের এপ্রিলে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ হবে বলে দাবি করেন।

অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস ছিল, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে বড়জোর ৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এডিবির পক্ষ থেকেও সরকারের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করা হয়।

দেখা যায়, উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও কর-জিডিপির অনুপাত বাড়েনি। সেই সঙ্গে প্রবৃদ্ধি বেশি হলে বিনিয়োগ ও রাজস্ব আয় যেমন ভালো হয়, তেমনি কর্মসংস্থানেও গতি থাকে। কিন্তু প্রবৃদ্ধির হারের সঙ্গে এসব সূচকের মিল ছিল না।

কেবল জিডিপি প্রবৃদ্ধি নয়, মাথাপিছু জাতীয় আয়, মূল্যস্ফীতিসহ আর্থিক খাতের অন্যান্য পরিসংখ্যান কারসাজির আলামত পেয়েছে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি। রাজনৈতিক সুবিধা ও আন্তর্জাতিকভাবে বাহবা নেওয়ার জন্য এই মিথ্যা পরিসংখ্যান জাতির কাছে প্রকাশ করেছে তৎকালীন সরকার।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ভূমিকম্প বিধ্বস্ত মিয়ানমার / মিয়ানমারে উদ্ধারকারী দল পাঠাল বাংলাদেশ

গ্রেপ্তার আতঙ্কে ঈদ আনন্দ নেই বিএনপি নেতাকর্মীদের পরিবারে

‘আ.লীগের এক লাখের বেশি নেতাকর্মী দিল্লিতে বসে ষড়যন্ত্র করছে’

মুক্তির প্রথম দিনই পাইরেসির কবলে শাকিবের ‘বরবাদ’ 

আ.লীগকে কোনো দিন রাজনৈতিকভাবে দাঁড়াতে দেব না : উপদেষ্টা মাহফুজ

ঈদের রাতে অস্ত্রের মুখে নৈশপ্রহরীর স্ত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ

ইসরায়েলি হামলায় গাজায় শেষ ১০ দিনে ৩২২ শিশু নিহত : জাতিসংঘ

অসংখ্য পরিবারের ঈদ আনন্দ কেড়ে নিয়েছে ফ্যাসিস্ট আ.লীগ : রেজাউল করিম

জুলাই বিপ্লবের মাধ্যেমে আল্লাহ জমিনকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে : মাওলানা মমতাজ

তীব্র কালবৈশাখী ঝড়ের শঙ্কা

১০

ইসলামিস্টদের উত্থান নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন বিভ্রান্তিকর: সিএ প্রেস উইং

১১

মাদারীপুরে দুই মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে ৪ যুবক নিহত

১২

আবারও ভারতে বিমান বিধ্বস্ত

১৩

বিএনপির দুই গ্রুপের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি, ১৪৪ ধারা জারি

১৪

‘দাগি’ ঈদের আনন্দ কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে : নিশো

১৫

দেশের তাপমাত্রা উঠতে পারে ৪১.৯ ডিগ্রি পর্যন্ত

১৬

ভূমিকম্পে মিয়ানমারের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় তীব্র খাদ্য ও আশ্রয় সংকট

১৭

এপ্রিলে ঢাকায় আসছে আইএমএফের দল

১৮

হবিগঞ্জে সালিশ বৈঠকে দুপক্ষের সংঘর্ষে আহত ৩০

১৯

সেভেন সিস্টার্স নিয়ে ড. ইউনূসের মন্তব্যে ভারতীয় রাজনীতিবিদদের প্রতিক্রিয়া

২০
X